পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অন্তরালে লুকিয়ে আছে ভয়ংকর সন্ত্রাসবাদ। পাহাড়ি ভূখণ্ডের অবারিত প্রান্তরে আঞ্চলিক সশস্ত্র সংগঠনগুলোর উত্থান, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, চাঁদাবাজি, অপহরণ ও খুন-গুম আজ নিত্যদিনের বাস্তবতায় পরিণত হয়েছে। এ অবস্থায় নিরাপত্তা বাহিনীর উপস্থিতি এখানে শুধু প্রয়োজন নয়, বরং জনগণের অস্তিত্ব রক্ষার একমাত্র ভরসা। পাহাড়ে নিরাপত্তা বাহিনী হ্রাস করা হলে তা কেবল ভৌগোলিক নিরাপত্তাকেই বিপন্ন করবে না, বরং স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে গভীর নিরাপত্তাহীনতায় ঠেলে দেবে।
পাহাড়ে ইউপিডিএফ মূলদল প্রসীত, জেএসএস মূলদল সন্তু, জেএসএস সংস্কার এম.এন, ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক বর্মা, এমএলপি (মগ পার্টি), কেএনএফসহ অসংখ্য আঞ্চলিক সংগঠন জন্ম নিয়েছে। এরা মূলত নিজেদের অধিকার ও রাজনৈতিক অবস্থান টিকিয়ে রাখার অজুহাতে চাঁদাবাজি, মুক্তিপণ আদায়, খুন-গুম ও সশস্ত্র প্রদর্শনকে হাতিয়ার হিসেবে নিয়েছে।
২০১৭ সালে ইউপিডিএফ থেকে দলছুট নেতাকর্মীদের নিয়ে ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক বর্মা গঠিত হয়। তাদের জন্মই হয়েছিল দুর্নীতি, লুটপাট ও স্বজনপ্রীতির প্রতিবাদ থেকে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে তারাও রূপান্তরিত হয়েছে আরেক সশস্ত্র চাঁদাবাজ দলে। একইভাবে জেএসএস মূলদল থেকে আলাদা হয়ে এম.এন. লারমার আদর্শের নাম ব্যবহার করে গড়ে উঠেছে জেএসএস সংস্কার। এরা মূলত ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিকের সাথে মিলে প্রতিপক্ষ সংগঠনের ওপর দমন-পীড়নে জড়িত।
মগ লিবারেশন আর্মি (এমএলপি) প্রকাশ্যে চাঁদাবাজি চালায়। এমনকি ইউপিডিএফ মূলদলও এই প্রবণতায় পিছিয়ে নেই। তারা চুক্তির বিরোধিতা করে স্বায়ত্তশাসন দাবিতে পাহাড়ে সন্ত্রাসবাদ কায়েম করছে। আর জেএসএস সরকারের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদিত করে এখনো অবৈধ অস্ত্র নিয়ে পাহাড় অশান্ত করছে। এভাবে প্রতিটি সংগঠন একে অপরের বিরুদ্ধে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে। এর শিকার হচ্ছে সাধারণ জনগণ, শিক্ষক, ব্যবসায়ী, ছাত্র-ছাত্রী, এমনকি কৃষকও।
রামগড় নাপাকা বাজারর সাম্প্রতিক অস্ত্র শক্তি প্রদর্শনের মাধ্যমে অপহরণ ঘটনা ঘটে৷ অপহরণের ভিডিও নিয়ে তৈরি হয়েছে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি উপর নেতিবাচক মনোভাব৷
খাগড়াছড়ি জেলার রামগড় উপজেলার নাপাকা বাজারে ১ সেপ্টেম্বর ২০২৫-এ ঘটে এক ভয়াবহ ঘটনা। ৫৮ বছর বয়সী বাসনা চাকমাকে দিনের আলোয় অস্ত্রের মুখে তুলে নিয়ে যায় ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক। তার পিতার নাম বড়পেদা চাকমা, তিনি মানিকছড়ি উপজেলার ২ নং ইউনিয়নের গুজা পাড়ার বাসিন্দা। অভিযোগ ছিল বাসনা চাকমা ইউপিডিএফ মূলদলের সহযোগী অঙ্গসংগঠনের কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেছেন।
এখানে প্রশ্ন জাগে, তিনি কেন মানিকছড়ি উপজেলা থেকে এসে রামগড়ের কর্মসূচিতে যোগ দেবেন? যদিও ইউপিডিএফ তাকে ‘নিরীহ’ বলে দাবি করছে, সন্দেহ থেকেই যায়। তবে বয়সের কারণে তার অপহরণ নিঃসন্দেহে মানবাধিকারবিরোধী। আবার এটাও সত্য যে ইউপিডিএফ প্রায়ই সাধারণ মানুষকে জোর করে কর্মসূচিতে নিয়ে যায়, ফলে দায় তাদেরও কম নয়। অন্যদিকে ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক দাবি করছে যে বাসনা চাকমা ইউপিডিএফের গুপ্তচর হিসেবে কাজ করছিলেন।
অবশেষে জানা যায়, বিকালে মারধর করার পর তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। অপহরণে জড়িতদের নামও প্রকাশ্যে এসেছে, সুলের চাকমা, মঞ্জু ইসলাম (পাতাছড়া), সাগর বড়ুয়া (মানিকছড়ি) এবং মো. বাপ্পি (মানিকছড়ি)। এই ঘটনা স্পষ্ট করে যে পাহাড়ে চাঁদা ও মুক্তিপণ আদায়ের জন্য অপহরণ এখন এক নিয়মিত কৌশলে পরিণত হয়েছে।
সন্ত্রাসীদের দ্বিমুখী খেলা:
আঞ্চলিক সংগঠনগুলো একদিকে সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায় করছে, অন্যদিকে নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে। যখনই সেনা বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান চালায়, তখন সন্ত্রাসীরা ‘জাতিগত নিপীড়ন’ কিংবা ‘মানবাধিকার লঙ্ঘন’-এর নামে আন্তর্জাতিক মহলে প্রচারণা চালায়। অথচ সত্য হলো, পাহাড়ে যদি নিরাপত্তা বাহিনী না থাকত, তাহলে চাঁদাবাজ গোষ্ঠীগুলোর দ্বন্দ্বে পাহাড় রক্তস্নাত হয়ে উঠত।
প্রকাশ্যে বাজার থেকে অস্ত্রের মুখে মানুষ অপহরণ করা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; বরং এটি প্রতিদিনকার বাস্তবতা। স্থানীয় জনগণ জানে, একবার নিরাপত্তা বাহিনী না থাকলে তাদের জীবনযাপন প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠবে।
ভৌগোলিক সংকটের অনিবার্যতা:
পার্বত্য চট্টগ্রামের ভৌগোলিক অবস্থান বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্য কৌশলগতভাবে অতি গুরুত্বপূর্ণ। সীমান্তঘেঁষা এ অঞ্চল মিয়ানমার ও ভারতের সাথে যুক্ত, যা বহিঃশক্তির প্রভাব বিস্তারের জন্যও সংবেদনশীল। যদি পাহাড়ে নিরাপত্তা বাহিনীর সংখ্যা হ্রাস করা হয়, তবে শুধু অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসই নয়, বরং বহিঃশক্তির অনুপ্রবেশও ত্বরান্বিত হবে। সীমান্ত অরক্ষিত হয়ে পড়বে, চোরাচালান, অস্ত্র ব্যবসা ও আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের জন্য এটি উন্মুক্ত ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়াবে।
জনগণের আশ্রয় নিরাপত্তা বাহিনী:
অতীত অভিজ্ঞতা প্রমাণ করেছে, নিরাপত্তা বাহিনী থাকলেই জনগণ কিছুটা হলেও নিশ্চিন্তে জীবনযাপন করতে পারে। পাহাড়ে প্রতিদিন যে আতঙ্কের ছায়া নেমে আসে, তা প্রতিহত করার একমাত্র শক্তি হলো রাষ্ট্রীয় বাহিনী। সাধারণ মানুষ একদিকে আঞ্চলিক সংগঠনের চাপ, অন্যদিকে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে বন্দি। নিরাপত্তা বাহিনী থাকায় অন্তত তারা জানে, কোনো বিপদ ঘটলে রাষ্ট্র তাদের পাশে আছে।
পাহাড়ে নিরাপত্তা বাহিনীর উপস্থিতি কোনো বিলাসিতা নয়; এটি জনগণের অস্তিত্ব রক্ষার অনিবার্য শর্ত। যারা নিরাপত্তা বাহিনী প্রত্যাহারের দাবি তোলে, তারা মূলত আঞ্চলিক সন্ত্রাসীদের স্বার্থ রক্ষা করছে। গত ১ সেপ্টেম্বরের নাপাকা বাজারের মতো প্রকাশ্য অপহরণই প্রমাণ করে যে পাহাড়ে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছাড়া জনগণ সম্পূর্ণ অসহায়।
পাহাড়ে নিরাপত্তা বাহিনী হ্রাস মানে শুধু জনগণকে বিপন্ন করা নয়, বরং সমগ্র রাষ্ট্রকে এক ভয়াবহ ভৌগোলিক সংকটে ঠেলে দেওয়া। তাই পাহাড়ে শান্তি, নিরাপত্তা ও ভৌগোলিক অখণ্ডতা রক্ষার জন্য নিরাপত্তা বাহিনীর উপস্থিতি অপরিহার্য ও অবিচ্ছেদ্য।