পাহাড়ে শান্তি বিপর্যস্ত, ইউপিডিএফের সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও অপপ্রচার।

0

অনন্ত অসীম | পার্বত্য চট্টগ্রাম

পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক বাস্তবতা আজ আবারও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে ইউপিডিএফ মূলদল এবং এর ভাঙন থেকে জন্ম নেওয়া ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক)-এর লাগাতার সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে। পাহাড়ি জনগণের অধিকার আদায়ের দোহাই দিয়ে তারা একদিকে যেমন অবিরাম চাঁদাবাজি, অস্ত্রবাজি ও আধিপত্য বিস্তার করছে, অন্যদিকে নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযান ঠেকাতে গুজব, অপপ্রচার এবং নারী সংগঠন কিংবা কথিত পিসিপি নামক ছাত্রসংগঠনকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে। ফলশ্রুতিতে যে শান্তি প্রক্রিয়া বহু রক্ত ও ত্যাগের বিনিময়ে এগিয়ে যাচ্ছিল, তা বারবার হুমকির মুখে পড়ছে।

গুইমারায় নিরাপত্তা বাহিনীর গাড়িবহর ঘেরাওয়ের চেষ্টা: গত ৭ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ির গুইমারার কালাপানিতে যে ভয়াবহ ঘটনা ঘটল, তা ইউপিডিএফের নৃশংসতা ও কৌশলী প্রতারণার আরেকটি উদাহরণ। প্রসীত গ্রুপের সন্ত্রাসীদের উসকানিতে সাধারণ গ্রামবাসীকে ব্যবহার করে নিরাপত্তা বাহিনীর গাড়িবহর ঘেরাও ও হামলার চেষ্টা চালানো হয়।

এর আগে সকালে মানিকছড়ির বাটনাতলী ইউনিয়নের তবলা পাড়ায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের সময় ইউপিডিএফ সন্ত্রাসীরা গ্রামবাসী, এমনকি স্কুলশিক্ষার্থীদের চাপ প্রয়োগ করে সামনে ঠেলে দেয়। নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের আটকে রাখার মতো অমানবিক কাজও তারা ঘটায়। পরে অতিরিক্ত সেনা গিয়ে উদ্ধার অভিযান চালালে কালাপানিতে ফের আরেক দফা ঘেরাও ও হামলার চেষ্টা হয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে নিরাপত্তা বাহিনী ফাঁকা গুলিবর্ষণ ও লাঠিচার্জ করতে বাধ্য হয়।

অভিযোগ আছে, ইউপিডিএফ সর্বদা জনগণকে মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করে। মারমা উপজাতিসহ স্থানীয়রা জানিয়েছেন—ইউপিডিএফের নির্দেশ অমান্য করলে তাদের মারধর, জরিমানা বা হত্যার শিকার হতে হয়। তাই ভয়ে সাধারণ মানুষ নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে বাধ্য হয়।

অভিযানের পরপরই ইউপিডিএফ নিয়ন্ত্রিত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে গুজব ছড়ানো শুরু হয়। তারা দাবি করে, সেনারা নাকি গ্রামবাসীর ওপর হামলা ও গুলি চালিয়েছে। অথচ বাস্তবে সত্যটি উল্টো—নিজেদের চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাস আড়াল করতেই এসব অপপ্রচার চালানো হয়।

সৃষ্ট ঘটনাকে কেন্দ্র করে গাছ কেটে অবরোধ, সাধারণ মানুষের ভোগান্তি: গত ১০ সেপ্টেম্বর ইউপিডিএফ ঘোষিত আধাবেলা অবরোধে খাগড়াছড়ি জেলার বিভিন্ন সড়ক যেন যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়। সাজেক সড়ক, দীঘিনালা, পানছড়ি, মহালছড়ি, গুইমারা ও মানিকছড়িতে গাছ কেটে সড়ক অবরোধ, টায়ারে আগুন এবং যানবাহন আটকে চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটে।

এতে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে রোগীবাহী অ্যাম্বুলেন্স ও জরুরি মালামাল পরিবহন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। সবচেয়ে ভয়াবহ ছিল রামগড়ের যৌথখামার এলাকায় শতাধিক ফলদ বৃক্ষ কেটে সড়কে ফেলে রাখা। স্থানীয় বাগান মালিক আজাদ ক্ষোভে বলেন, “ইউপিডিএফ আমার গাছ কেটে কোটি টাকার ক্ষতি করেছে। আমি বিচার চাই।”

এর আগে অবরোধের ডাক দেয় ইউপিডিএফের সহযোগী সংগঠন পিসিপি, হিল উইমেন্স ফেডারেশন ও যুব ফোরাম। স্পষ্টতই দেখা যায়, তারা শুধু অস্ত্রবাজি নয়, ছাত্র ও নারী সংগঠনকেও ব্যবহার করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করছে।

এই ঘটনার ২ দিন আগে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) চাঁদাবাজির নতুন রূপ দেখিয়েছে রাঙামাটিতে। এখানকার কথিত রাজপরিবারের সদস্য, প্রবীণ আইনজীবী ও পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট প্রতীম রায় পাম্পুকে একাধিকবার ফোনে ও সরাসরি হুমকি দেওয়া হয়।

০১৮৮৩৬০৪২৭৬ নম্বর থেকে ফোন করে তাকে বলা হয়, রিসোর্ট ব্যবসায় কোনো বাঙালি অংশীদার করা যাবে না, করলে খারাপ পরিণতি ভোগ করতে হবে। শুধু তাই নয়, তার রিসোর্টের জমি দখল করতেও চাপ প্রয়োগ করা হয়।

এ ঘটনা প্রমাণ করে, ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) আর শুধু বাঙালি ব্যবসায়ী বা ঠিকাদারদের নয়, নিজস্ব চাকমা রাজপরিবারের সদস্যদেরও চাঁদার ফাঁদে ফেলছে। স্থানীয়রা বলছে, এখন চাঁদার হার গত বছরের তুলনায় পাঁচগুণ বেড়েছে। বিনিয়োগকারীরা আতঙ্কে কোনো প্রকল্প হাতে নিতে সাহস পাচ্ছেন না। ফলে পর্যটন খাতসহ সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি মারাত্মক সংকটে পড়েছে।

ইউপিডিএফের অধিকারের মুখোশে অপরাধের সাম্রাজ্য: ইউপিডিএফ বা এর ভাঙন থেকে জন্ম নেওয়া ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) দীর্ঘদিন ধরে জাতির অধিকার, আত্মনিয়ন্ত্রণ ও স্বায়ত্তশাসনের স্লোগান তোলে। কিন্তু বাস্তবে তারা পাহাড়ের সাধারণ মানুষকে মানবঢাল বানিয়ে চাঁদাবাজি, অস্ত্রবাজি ও দখলবাজি চালাচ্ছে।

তাদের প্রতিটি কর্মকাণ্ডে লক্ষ্য হচ্ছে অর্থ আদায় ও আধিপত্য বিস্তার। যখন নিরাপত্তা বাহিনী তাদের লাগাম টানতে এগিয়ে আসে, তখনই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে সেনাবাহিনীকে দোষারোপ করা হয়। একই সঙ্গে নারী সংগঠন ও ছাত্র সংগঠনকে সামনে ঠেলে দিয়ে নিজেদের অপরাধ আড়াল করা হয়।

পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা:
আজ পাহাড়ের মানুষ সবচেয়ে বেশি চায় নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা ও উন্নয়ন। কিন্তু ইউপিডিএফের অব্যাহত সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজির কারণে সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। গ্রাম থেকে শহর, বাজার থেকে ব্যবসা, সবখানেই তাদের দৌরাত্ম্য।

এ অবস্থায় রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি সাধারণ মানুষের সচেতনতা ও ঐক্যবদ্ধ অবস্থান জরুরি। যারা অধিকার ও শান্তির নামে পাহাড়কে বারবার রক্তাক্ত করছে, তাদের মুখোশ উন্মোচন করতে হবে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের চুক্তির পর থেকে বারবার আশার আলো জেগেছে, এ অঞ্চলে একদিন শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু জেএসএস- ইউপিডিএফ ও এর ভাঙন থেকে জন্ম নেওয়া গোষ্ঠীগুলোর চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী তৎপরতা ও অপপ্রচারের কারণে সেই আশা প্রতিবারই ভেঙে যাচ্ছে।

স্থানীয়রা বলছেন, এখন সময় এসেছে স্পষ্ট করে বলার, যে কোনো সংগঠন যদি জনগণের নামে অপরাধের সাম্রাজ্য কায়েম করে, তাকে কঠোরভাবে দমন করতে হবে। পাহাড়ের সাধারণ মানুষকে আর বলির পাঁঠা হতে দেওয়া যাবে না।

আগের পোস্টগণমাধ্যম সংস্কার কমিশনে আদিবাসী শব্দ ব্যবহারের প্রতিবাদে বিক্ষোভ।
পরের পোস্ট১৪ লাখ টাকা মুক্তিপণে মুক্তি পেলেন বান্দরবানে অপহৃত দুই শ্রমিক।

রিপ্লাই দিন

আপনার কমেন্ট লিখুন
আপনার নাম লিখুন