খাগড়াছড়ির সিঙ্গিনালা ঘটনার অন্তর্নিহিত সত্য।

0

অন্তত অসীম 

পার্বত্য চট্টগ্রামে অপরাধ, আন্দোলন ও রাজনৈতিক অপপ্রচার, এই ত্রিমুখী বাস্তবতার মাঝে এক কিশোরী শিক্ষার্থী ধর্ষণের শিকার হওয়ার সাম্প্রতিক ঘটনা নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। ঘটনাটি ঘটেছে খাগড়াছড়ি সদর পৌরসভার সিঙ্গিনালা গ্রামে, যেখানে মারমা সম্প্রদায়ের এক সপ্তম শ্রেণির ছাত্রীকে জোরপূর্বক গণধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। মঙ্গলবার (২৩ সেপ্টেম্বর) রাত আনুমানিক ১০টার দিকে প্রাইভেট পড়া শেষে বাড়ি ফেরার পথে কয়েকজন বখাটে তাকে অপহরণ করে পাশের জমিতে নিয়ে গিয়ে নৃশংসভাবে ধর্ষণ করে। ঘটনাটি মুহূর্তেই এলাকায় তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার করে।

পরদিন (২৪ সেপ্টেম্বর) সকালে সেনাবাহিনীর সদর জোনের সহযোগিতায় পুলিশের হাতে আটক হয় মূল অভিযুক্ত শয়ন শীল, যিনি সিঙ্গিনালা গ্রামের বাসিন্দা বাপ্পী শীলের ছেলে। বাকিদের গ্রেপ্তারের জন্যও অভিযান অব্যাহত রয়েছে। স্থানীয় জনগণ এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে অপরাধীদের দ্রুত আইনের আওতায় আনার দাবি জানান।

ঘটনার প্রতিবাদে “জুম্ম ছাত্র জনতা” ব্যানারে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশের আয়োজন করা হয়। খাগড়াছড়ি সরকারি কলেজ গেট থেকে শুরু হওয়া মিছিলটি মুক্তমঞ্চে গিয়ে শেষ হয়। সমাবেশে বক্তারা দোষীদের গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন। পাশাপাশি কর্মসূচির অংশ হিসেবে বৃহস্পতিবার ভোর ৬টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত আধাবেলা সড়ক অবরোধের ঘোষণা দেওয়া হয়। শুধু তাই নয়, ২৫ ও ২৬ সেপ্টেম্বর তিন পার্বত্য জেলায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বর্জনেরও ডাক দেওয়া হয়।

তবে এখানেই প্রশ্ন উঠছে, একটি ধর্ষণ ঘটনার প্রতিবাদ কর্মসূচি কেন সেনাবাহিনী হঠাও স্লোগানে রূপ নিল? বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি নিছক প্রতিবাদ নয়; বরং পার্বত্য অঞ্চলে সক্রিয় ইউপিডিএফের রাজনৈতিক কৌশল। ধর্ষণের নিন্দা ও বিচারের দাবির পরিবর্তে আন্দোলনকে সেনা বিরোধী রূপ দেওয়ার প্রচেষ্টা স্পষ্টভাবে ইউপিডিএফ সমর্থিতদের ইঙ্গিত বহন করে।

ঘটনাটিকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার প্রচেষ্টা: সচেতন মহল মনে করেন, ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হচ্ছে। সেনাবাহিনী বরং এই ঘটনায় ইতিবাচক ভূমিকা রেখে মূল অভিযুক্ত শয়ন শীলকে আটক করতে সহায়তা করেছে এবং বাকিদেরও ধরতে অভিযান চালাচ্ছে। অথচ ইউপিডিএফপন্থীরা এই ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে জনমত গঠনের চেষ্টা করছে।

তথ্য-সন্ত্রাস এবং অপপ্রচারের এই ধারা পার্বত্য চট্টগ্রামে নতুন কিছু নয়। অতীতেও দেখা গেছে, যেকোনো অপরাধ, বিশেষ করে ধর্ষণ, হত্যাকাণ্ড বা নিখোঁজের ঘটনার সঙ্গে সেনাবাহিনীকে জড়িয়ে বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণা চালানো হয়। উদ্দেশ্য স্পষ্ট—পাহাড় থেকে সেনা প্রত্যাহারের দাবিকে জোরালো করা।

তথ্য সন্ত্রাস বনাম বাস্তবতা: পার্বত্য চট্টগ্রামের সংকট শুধু সশস্ত্র রাজনীতি বা জাতিগত বিরোধে সীমাবদ্ধ নয়; বরং এর সঙ্গে জড়িত একটি ধারাবাহিক তথ্য যুদ্ধ। ইউপিডিএফ ও তাদের সমর্থিত গোষ্ঠীগুলো প্রমাণিত অপরাধীকে আড়াল করার জন্যও সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালায়। অথচ বাস্তবতা হলো—সেনাবাহিনী পাহাড়ের নিরাপত্তা রক্ষায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সহায়তা করছে, অপরাধীদের ধরছে এবং সন্ত্রাস দমনে কাজ করছে।

এই পরিস্থিতিতে ধর্ষণের মতো সংবেদনশীল ও মানবিক ইস্যুকে রাজনৈতিক হাতিয়ার বানানো নিঃসন্দেহে অনৈতিক। একটি কিশোরী শিক্ষার্থীর জীবনের করুণতম মুহূর্তকে ব্যবহার করে বিভ্রান্তি ছড়ানো মানেই মানবাধিকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া।

সামাজিক ও নৈতিক দায়বদ্ধতা: ধর্ষণ একটি ঘৃণ্যতম অপরাধ, যা কোনোভাবেই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের হাতিয়ার হতে পারে না। এ ধরনের ঘটনায় অপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করা এবং ভুক্তভোগীকে সহায়তা দেওয়া রাষ্ট্র ও সমাজের দায়িত্ব। কিন্তু যখনই কোনো পক্ষ এই ধরনের অপরাধকে বিকৃতভাবে ব্যবহার করে, তখন প্রকৃত অপরাধীরা আড়ালে থেকে যায়, আর ভুক্তভোগীর প্রতি ন্যায়বিচার বিলম্বিত হয়। আর সবচেয়ে দুঃখজনক হচ্ছে, এই ধর্ষণ ঘটনার পরিপূর্ণ তদন্ত না হওয়ার আগে একতরফা বাঙালি বিরোধী অপপ্রচার উদ্দেশ্যপ্রণোদীত। প্রতিটি ঘটনার ভিতরে রহস্য থাকে, যা পরিপূর্ণ তদন্তের আগে উন্মোচন হয়না।

এ প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে অপরাধের সঙ্গে যারা সরাসরি জড়িত তাদের শাস্তি নিশ্চিত করার পাশাপাশি তথ্য সন্ত্রাস মোকাবিলা করাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তথ্য বিকৃত হলে সমাজে বিভ্রান্তি ছড়ায়, আর সেই বিভ্রান্তি অপরাধীদের পক্ষে যায়।

খাগড়াছড়ির সিঙ্গিনালা ঘটনার মূল বিষয় হলো, একজন সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। অভিযুক্তদের মধ্যে একজনকে সেনাবাহিনী ও পুলিশের যৌথ প্রচেষ্টায় আটক করা হয়েছে, বাকিদেরও ধরতে অভিযান চলছে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, মানবিক এই ইস্যুটি রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার অপচেষ্টা চলছে। ইউপিডিএফের মদদপুষ্ট গোষ্ঠীগুলো এই ঘটনায় সেনা হটাও স্লোগান তুলে জনমতকে বিভ্রান্ত করতে চাইছে। এই ধর্ষণ ঘটনার পরিপূর্ণ তদন্ত না হওয়ার আগে একতরফা বাঙালি বিরোধী অপপ্রচার উদ্দেশ্যপ্রণোদীত।

তথ্য সন্ত্রাস ও অপপ্রচারের এই সংস্কৃতি যদি চলতে থাকে, তবে পার্বত্য চট্টগ্রামে অপরাধ দমন ও শান্তি প্রতিষ্ঠার পথ আরও কঠিন হয়ে উঠবে। তাই প্রয়োজন, অপরাধকে অপরাধ হিসেবে দেখা, অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করা এবং মানবিক ইস্যুকে রাজনৈতিক কূটচালে ব্যবহার না করা। সমাজ, রাষ্ট্র ও গণমাধ্যমকেই এ ক্ষেত্রে সজাগ ভূমিকা রাখতে হবে।

 

আগের পোস্টরাঙামাটিতে বাঙালি শিক্ষকের উপর পরিকল্পিত মব-আক্রমণ: পিসিপি’র ষড়যন্ত্র ফাঁস।

রিপ্লাই দিন

আপনার কমেন্ট লিখুন
আপনার নাম লিখুন