হান্নান সরকার
পার্বত্য চট্টগ্রাম, যা একদিকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য সুপরিচিত, অন্যদিকে দীর্ঘদিন ধরে সাম্প্রদায়িক বৈরিতা, উগ্রবাদী কর্মকাণ্ড এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী রাজনীতির কারণে রক্তাক্ত হয়ে আছে। সাম্প্রতিক তিনটি পৃথক ঘটনা আবারও প্রমাণ করেছে যে, এই অঞ্চলে পরিকল্পিতভাবে বাঙালি জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে মিথ্যা অপপ্রচার চালানো হচ্ছে এবং পাহাড়ি উগ্রবাদী সংগঠনগুলো তাদের রাজনৈতিক হীন উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য নারী ও কিশোরীদের ব্যবহার করছে।
বান্দরবানে বাঙালি যুবকের উপর হামলার ঘটনাটি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভিডিওটি ঘুরতে। ঘটনাটি ঘটে ২৪ সেপ্টেম্বর, বুধবার, দুপুর ১২টা ৫০ মিনিটে বান্দরবান কথিত রাজার মাঠ সংলগ্ন এলাকায় (উজানি পাড়া ধর্মীয় স্থাপনার সামনে)। নু শ্যাও ইয়ি মারমা নামের এক মারমা উপজাতি নারী তার স্কুলপড়ুয়া বোনের সঙ্গে সম্পর্কের জেরে এক বাঙালি যুবকের বিরুদ্ধে মিথ্যা যৌন হয়রানির অভিযোগ তোলে। তিনি প্রথমে নিজেই প্রকাশ্যে যুবককে মারধর করেন, পরে উগ্র উপজাতি যুবকদের সমবেত করে একটি মব সৃষ্টি করেন।
বাঙালি যুবককে প্রকাশ্যে বেধড়ক মারধর করা হয় এবং সেই নির্যাতনের ভিডিও ধারণ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেয় বিচ্ছিন্নতাবাদীরা। ভিডিওটি ছড়িয়ে পড়লে নেটিজেনরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, দেশে আইন-আদালত থাকা সত্ত্বেও প্রকাশ্যে কাউকে পিটিয়ে শাস্তি দেওয়া নিঃসন্দেহে আইন লঙ্ঘন ও মানবাধিকার পরিপন্থী কাজ।
তারা প্রশ্ন তোলেন, যদি কোনো বাঙালি উপজাতি নারীর সঙ্গে এমন আচরণ করতো, তবে তথাকথিত মানবাধিকার সংগঠন ও বুদ্ধিজীবীরা তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখাতেন। অথচ উপজাতি উগ্রবাদীদের ঘটনায় তারা রহস্যজনক নীরবতা পালন করছে। স্থানীয়রা দোষীদের শনাক্ত করে কঠোর শাস্তির দাবি তুলেছেন।
এরপরের দীঘিনালায় ষাটোর্ধ মানসিক ভারসাম্যহীন বৃদ্ধকে ঘিরে অপপ্রচার সম্পর্কিত ঘটনাটি ঘটে ২৫ সেপ্টেম্বর, বৃহস্পতিবার, সকাল ৯টার দিকে দীঘিনালা উপজেলার বোয়ালখালী বাজারে। জামতলী মুসলিম বাঙালি পাড়ার বাসিন্দা আব্দুর রাজ্জাক (৬০), যিনি বহুদিন ধরে মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন, তাকে কেন্দ্র করে আরেকটি নাটক সাজায় উগ্রবাদীরা। অভিযোগ তোলা হয়, তিনি এক পাহাড়ি দশম শ্রেণীর ছাত্রীকে শ্লীলতাহানি করেছেন।
এই অভিযোগকে কেন্দ্র করে উগ্রবাদীরা মব গড়ে তোলার চেষ্টা করে। তবে স্থানীয়দের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া হয় এবং আব্দুর রাজ্জাককে থানায় সোপর্দ করা হয়।
সচেতন মহলের মতে, এটি ছিল পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র, পাহাড়ি নারীকে ঢাল বানিয়ে বাঙালিদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানো। সাম্প্রতিক সময়ে একের পর এক এই ধরনের মিথ্যা অভিযোগের নাটক সাজিয়ে উগ্রবাদীরা বাঙালি বিদ্বেষ উসকে দিচ্ছে। তারা সেনাবাহিনী বিরোধী স্লোগান দিয়ে নৈরাজ্য সৃষ্টি করছে, যা পার্বত্য অঞ্চলে সন্ত্রাসবাদকে আরও শক্তিশালী করতে পারে।
এরপর ২৬ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়িতে সমাবেশে ডেকে সেনাবাহিনীর গাড়ি ভাংচুর করা হয়। সেনাবাহিনী সাধারণ মানুষদের ক্ষয়ক্ষতি হবে এমন বিবেচনায় পরিস্থিতি ধৈর্যের সাথে মোকাবেলা করে।
এর ঠিক আগে ২৩ সেপ্টেম্বর, সোমবার রাতে খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার সিঙ্গিনালায় এক উপজাতি অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থীকে গণধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। সেনাবাহিনী দ্রুত অভিযুক্তকে আটক করে। অথচ আইনগত পদক্ষেপ নেওয়ার পরও ইউপিডিএফ ঘটনাটিকে পুঁজি করে ২৫ সেপ্টেম্বর জেলায় অঘোষিত অবরোধ ডেকে বসে।
অবরোধ চলাকালে ইউপিডিএফ ও তাদের সহযোগী সংগঠন, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ, গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম, হিল উইমেন্স ফেডারেশন, “জুম্ম ছাত্র জনতা” ব্যানারে নেমে আসে। তারা সড়কে গাছ কেটে ফেলে, ইট-পাথর ফেলে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয় এবং কোমলমতি শিক্ষার্থীদের দিয়ে সেনাবাহিনীর গাড়ি আটকানোর চেষ্টা করায়। রামগড় সড়কে বিজিবি’র গাড়িকে পর্যন্ত পিছু হটতে বাধ্য করা হয়।
নিরাপত্তা বাহিনীকে উত্তেজিত করার জন্য উপজাতি নারীদের ব্যবহার করার কৌশল নেয় ইউপিডিএফ, তবে সেনারা ধৈর্য্যের সাথে পরিস্থিতি সামাল দেন। স্পষ্টতই বোঝা যায়, ইউপিডিএফ ধর্ষণের ঘটনাকে ন্যায্য বিচার পাওয়ার পথ ধরে না এগিয়ে, বরং সেটিকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে।
তিন ঘটনার মিলিত চিত্র: এই তিনটি ঘটনার তারিখ, স্থান ও প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে একটি সুস্পষ্ট চিত্র ভেসে ওঠে।
২৩ সেপ্টেম্বর, সিঙ্গিনালা (খাগড়াছড়ি), ধর্ষণ ঘটনা ও ইউপিডিএফের অবরোধ।
২৪ সেপ্টেম্বর, বান্দরবান পুরাতন বাজার, মিথ্যা অভিযোগে বাঙালি যুবকের উপর হামলা।
২৫ সেপ্টেম্বর, দীঘিনালা বোয়ালখালী বাজার, ষাটোর্ধ মানসিক ভারসাম্যহীন বৃদ্ধকে ঘিরে অপপ্রচার।
মাত্র তিন দিনের ব্যবধানে তিনটি স্থানে সংঘটিত এই ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্ন নয়। বরং এগুলো পরিকল্পিতভাবে সাজানো একটি চেইন অপারেশন, যার লক্ষ্য—
বাঙালি জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানো,
উপজাতি নারীকে ব্যবহার করে আবেগ উসকে দেওয়া, সেনা ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীকে দুর্বল ও বিতর্কিত করা, পার্বত্য চট্টগ্রামে বিচ্ছিন্নতাবাদী রাজনীতিকে আরও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া। আইন, মানবাধিকার ও রাষ্ট্রীয় কর্তব্য প্রশ্ন উঠছে, কেন এ ধরনের ঘটনাগুলোতে মানবাধিকার সংগঠনগুলো নিরব থাকে? কেন বাঙালির বিরুদ্ধে সাজানো মিথ্যা নাটক ও নির্যাতনের ঘটনায় আন্তর্জাতিক মহল সাড়া দেয় না?
যদি সত্যিই মানবাধিকার রক্ষার দাবি থাকে, তবে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া, প্রকাশ্যে কাউকে মারধর, মানসিকভাবে অসুস্থ বৃদ্ধকে ফাঁসানো বা শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা, এসব কর্মকাণ্ডকে কঠোরভাবে নিন্দা জানাতে হবে।
রাষ্ট্রের জন্য এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, প্রতিটি ঘটনার সঠিক তদন্ত, উস্কানিদাতা ও মিথ্যা অভিযোগকারীদের শনাক্তকরণ, ইউপিডিএফসহ উগ্রবাদী সংগঠনগুলোর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের লাগাম টেনে ধরা, এবং বাঙালি জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
পার্বত্য চট্টগ্রাম আজও অশান্ত, কারণ উগ্রবাদীরা নারী, শিশু ও শিক্ষার্থীদের আবেগকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। ২৩ থেকে ২৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বান্দরবান, দীঘিনালা ও খাগড়াছড়িতে ঘটে যাওয়া তিনটি ঘটনা এই সত্যকে আরও প্রকট করে তুলেছে।
যদি রাষ্ট্র যথাসময়ে কঠোর পদক্ষেপ না নেয়, তবে মিথ্যা অভিযোগ, অপপ্রচার ও উগ্রবাদী রাজনীতি পাহাড়ে আরও সহিংসতা উসকে দেবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষায় প্রয়োজন নিরপেক্ষ বিচার, দৃঢ় আইন প্রয়োগ এবং সব সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।