মোঃ সোহেল রিগ্যান | মুক্তমত
পার্বত্য চট্টগ্রাম—এক রহস্যময়, অগ্নিগর্ভ ও দীর্ঘকালীন সংঘাতমণ্ডিত ভূখণ্ড। পাহাড়ের অস্থিরতা কোনো আকস্মিক উদ্ভূত সংকট নয়, বরং ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সম্পাদিত পার্বত্য চুক্তির এক বিপজ্জনক ধারা থেকে এর উৎপত্তি। সেই চুক্তিতে বলা হয়েছিল, ৬টি সেনানিবাস ব্যতীত অস্থায়ী সকল সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হবে। এই শর্ত বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে সরকার ইতোমধ্যে ২৩৯টি সেনা ক্যাম্প সরিয়ে নিয়েছে। ফলাফল ভয়াবহ, যেসব এলাকায় সেনাশূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে, সেসব অঞ্চল পরিণত হয়েছে ইউপিডিএফ, জেএসএস, কেএনএফসহ বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলোর আস্তানা ও অস্ত্রাগারে। পাহাড়ি-বাঙালি উভয় জনগোষ্ঠীই আজ সেই নৈরাজ্য ও নিরাপত্তাহীনতার করালগ্রাসে।
চুক্তির অভিশাপ ও পাহাড়ের অস্থিরতা:
প্রশ্ন জাগে, এই সেনা প্রত্যাহার আদৌ কতটা ফলপ্রসূ হলো? দুই দশক পেরিয়ে প্রমাণিত হয়েছে, সেনাবাহিনীর অনুপস্থিতি শান্তি বয়ে আনে নি; বরং সহিংসতা, খুন, অপহরণ, চাঁদাবাজির অভিশাপ ডেকে এনেছে। আজকে পাহাড়ে উপজাতিরাই সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী তাদেরই স্বজাতি সংগঠনের হাতে। অথচ বিভ্রান্তিকর প্রচারণায় সাধারণ মানুষকে বোঝানো হচ্ছে, সেনাবাহিনীই নাকি সমস্যার মূল।
অথচ বাস্তবতা ভয়ংকর, আজ সাজেক কিংবা নীলগিরি ভ্রমণে সেনা স্কর্ট ছাড়া যাওয়া যায় না। যদি সেনাবাহিনী পুরোপুরি প্রত্যাহার হয়, তবে দিন আসবে যখন পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রবেশ করতে ভিসা-পাসপোর্ট লাগবে। এই অশুভ ইঙ্গিত উপেক্ষা করা মানে রাষ্ট্রীয় আত্মহত্যার পথ প্রশস্ত করা।
আঞ্চলিক দলগুলোর বিভাজনমুখী রাজনীতি:
চুক্তির পর থেকে জেএসএস ও ইউপিডিএফ, দুটি মুখ্য শক্তি পাহাড়কে শান্তি নয়, বরং বিশৃঙ্খলা উপহার দিয়েছে। জেএসএস প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে; ৪৫ দিনের মধ্যে সব অবৈধ অস্ত্র জমা দেওয়ার শর্ত তারা উপহাস করেছে। মরিচাধরা কিছু পুরনো অস্ত্র জমা দিয়ে বাকি অস্ত্র পাহাড়ে রেখে দিয়েছে। ফলশ্রুতিতে নতুন নতুন উপ-দল জন্ম নিয়েছে, যারা অধিকার আদায়ের নাম করে খুন, অপহরণ, আধিপত্য বিস্তার ও চাঁদাবাজির নগ্ন রাজনীতিতে নিমগ্ন।
অন্যদিকে ইউপিডিএফ, যাদের জন্মই হয়েছিল ১৯৯৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর, চুক্তির বছর পর ঢাকায় এক সম্মেলনে। তারা সেনা প্রত্যাহার, স্বায়ত্তশাসন ও উগ্র স্লোগান দিয়ে পাহাড়ি তরুণদের বিভ্রান্ত করেছে। অথচ ২৭ বছরের ব্যবধানে তাদের অর্জন কী? কিছুই নয়, বরং জনগণের ওপর আর্থিক শোষণ, অপহরণ বাণিজ্য এবং প্রতিপক্ষ দমনে রক্তস্নান।
সেনাবাহিনীর উদারতা বনাম মিথ্যাচার:
পাহাড়ে যখনই কোনো অপরাধ বা ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে, সেনাবাহিনী দ্রুত ব্যবস্থা নিয়ে অভিযুক্তকে পুলিশের হাতে সোপর্দ করেছে। গত ২৩ সেপ্টেম্বরে খাগড়াছড়ি ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনায় ৬/৭ ঘন্টার মধ্যে শয়ন শীলকে আটক করে। এরপরও সেনাদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়ানো হয়েছে। বিশ্বের যেকোনো উন্নত রাষ্ট্রেও প্রাথমিক তদন্ত ছাড়াই তাৎক্ষণিক গ্রেপ্তারের নজির বিরল, অথচ পাহাড়ে সেনারা বারবার মানবিক দায় থেকে সেটি করেছে।
কিন্তু প্রশংসা নয়, বরং কৃতঘ্নতার প্রতিদান মিলেছে। সেনা হঠাও আন্দোলন, অশ্লীল স্লোগান আর সহিংস অবরোধই এর উত্তর। মূলত এ আন্দোলনের পেছনে ছিল ইউপিডিএফের পুরনো কৌশল, ঘোলা পানিতে মাছ শিকার।
আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র ও সুশীল সমাজের ভণ্ডামি:
উপজাতি সংগঠনগুলো কখনো প্রকাশ্যে, কখনো আড়ালে পাহাড় থেকে সেনা অপসারণ চায়। কারণ সেনাবাহিনী থাকলে তারা চূড়ান্ত লক্ষ্য—“জুম্মল্যান্ড”— “কুকিল্যাণ্ড”— অর্জনে ব্যর্থ হয়। তাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত হয়। এজন্য তারা প্রতিটি ঘটনা—ধর্ষণ, হত্যা, অপহরণ, সাম্প্রদায়িক রূপ দিয়ে বাঙালি ও সেনাবাহিনীর ঘাড়ে চাপায়।
অবাক করার মতো বিষয় হলো, দেশের একাংশ বামপন্থি ও তথাকথিত সুশীল সমাজ এদেরই সমর্থন জোগায়। তারা অর্থ, সুবিধা ও আন্তর্জাতিক দালালি থেকে ভাগ পায়। বিদেশি মিশনারি ও পশ্চিমা শক্তি পাহাড়ে বহুদিন ধরেই রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডে মদদ দিচ্ছে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হওয়া আটকাতে, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান নিতে এবং আজ স্বপ্নের জুম্মল্যান্ড গড়তে, তাদের কৌশল এক ও অভিন্ন।
জাতিগত বিভাজনের বিষবীজ:
পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, ম্রো, বম, খিয়াংসহ ডজনখানেক উপজাতি বসবাস করে। কিন্তু তাদের ঐক্যের বদলে প্রতিনিয়ত বিভাজন বাড়ছে। চাকমারা “জুম্ম জাতীয়তাবাদ” নামে এক কৃত্রিম ধারণা চাপিয়ে দিচ্ছে। সাম্প্রতিককালে তারা “জুম্ম ছাত্র জনতা” ব্যানারে মারমা তরুণদেরও যুক্ত করেছে। এর ফলস্বরূপ গুইমারা ও রামসু বাজারে ভয়াবহ সংঘাত সংঘটিত হয়েছে, যেখানে সেনা ও বাঙালি নাগরিক আক্রান্ত হয়েছেন, তিন উপজাতি নিহত হয়েছেন, এবং বহু আহত হয়েছেন।
সচেতন মারমারা বুঝে গেছে, এটি চাকমাদের ষড়যন্ত্র, কিন্তু সহজ-সরল মারমারা প্রতারিত হয়েছে। এভাবেই ইউপিডিএফ এবং জেএসএস নিজেদের আধিপত্য বিস্তারে অন্যান্য উপজাতিদের ব্যবহার করছে। ২৮ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ মারমা উন্নয়ন সংসদের বিবৃতিতে এটিই স্পষ্ট হয়েছে।
অর্থনৈতিক বৈষম্য ও ক্ষোভ:
চুক্তির সুযোগ-সুবিধা সমবণ্টিত হয়নি। চাকমা-মারমা-ত্রিপুরারা সব সুবিধা ভোগ করলেও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বঞ্চিত। তারা উন্নয়ন থেকে দূরে থেকে গেছে, শিক্ষা-চিকিৎসায় পশ্চাৎপদ রয়েছে। অথচ আঞ্চলিক সংগঠনগুলো নিজেদের স্বার্থে সুবিধা কুক্ষিগত করেছে।
ফলাফল স্পষ্ট, ক্ষোভ, হতাশা ও অনিশ্চয়তা। কিন্তু দায় কে নেবে? আঞ্চলিক দলগুলো জনগণের উন্নতি চায় না, চায় কেবল নিজেদের আধিপত্য ও অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে।
সেনাবাহিনীর অবদান:
সেনাবাহিনী শুধু নিরাপত্তারক্ষী নয়, বরং উন্নয়নেরও সহযাত্রী। তারা শীতবস্ত্র বিতরণ করে, বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা দেয়, পাহাড়ি প্রসূতি মায়েদের চিকিৎসা করে, হতদরিদ্রদের ঘর নির্মাণ করে, স্কুল-সড়ক তৈরি করে। অথচ বারবার তাদের গায়ে হাত তোলা হয়, তাদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়ানো হয়। যে বাঙালি রাষ্ট্র কর্তৃক নিপীড়িত সে বাঙালি জনগণ বরাবরই সেনাবাহিনীর আপদে এগিয়ে আসে৷ পক্ষান্তরে সেনাবাহিনীর সুবিধা ভোগী উপজাতিদের একটি অংশ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে।
প্রশ্ন, এত সহানুভূতির পরও কেন উগ্রপন্থি সংগঠনের ফাঁদে পা দিয়ে জনগণ সেনাবাহিনীর বিরোধিতা করে? এর উত্তর হলো—ভয়, বিভ্রান্তি ও প্ররোচনা।
পার্বত্য চট্টগ্রাম আজ এক জটিল অগ্নিগর্ভ অঙ্গন। সেনা প্রত্যাহারের ফলে নিরাপত্তাহীনতা বেড়েছে, আঞ্চলিক সংগঠনগুলো রক্তাক্ত বিভাজনের খেলায় মত্ত হয়েছে, আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীরা সুযোগ নিচ্ছে, আর তথাকথিত সুশীল মহল ভণ্ডামির চর্চা করছে।
তবুও এই ভূখণ্ড আমাদের, এখানকার প্রতিটি মানুষ আমাদের। চাকমা-মারমা-ত্রিপুরা-কুকি-বাঙালি সবাই মিলেই পার্বত্য চট্টগ্রামের আত্মা। তাই বিভাজন সৃষ্টিকারী শক্তিকে বর্জন করতে হবে।
পরিশেষে পার্বত্য চট্টগ্রামের অখণ্ডতা, শান্তি ও নিরাপত্তার স্বার্থে অবিলম্বে প্রত্যাহারকৃত সেনা ক্যাম্প পুনঃস্থাপন করা জরুরি। অন্যথায় “জুম্মল্যান্ড ও কুকিল্যাণ্ড”-এর স্বপ্নদর্শীরা একদিন এ ভূমিকে দ্বিতীয় দক্ষিণ সুদান বা পূর্ব তিমুরে রূপান্তর করবে, যেখানে রক্ত, অশ্রু ও অগ্নিবীজ ছাড়া কিছু অবশিষ্ট থাকবে না।