অন্তত অসীম
পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিগত বছরগুলোর একাধিক গোয়েন্দা প্রতিবেদন স্পষ্ট করে তুলছে, আঞ্চলিক সশস্ত্র দলসমূহ ইউপিডিএফ (মূল) ও জেএসএস (সন্তু), ক্রমশ প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের দিকে আরও ঝুঁকছে। কখনও গোপন যোগাযোগ, কখনও অর্থনৈতিক লেনদেন, আবার কখনও স্থায়ী আশ্রয়ের প্রয়াস—সবই নির্দেশ করছে যে, শান্তিচুক্তির বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন এই দলগুলো ভারতীয় নিরাপত্তা বলয়ের ভেতরে নিজেদের পুনর্গঠন ও শক্তিবৃদ্ধির চেষ্টা করছে। এই প্রবণতা কেবল বাংলাদেশের সার্বভৌম নিরাপত্তার জন্য নয়, বরং ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের জন্যও এক গভীর হুমকি হিসেবে দেখা দিচ্ছে।
২০২০ ও ২০২১ সালের ধারাবাহিক প্রতিবেদনে প্রমাণিত হয়েছে যে, ইউপিডিএফ (মূল)-এর সশস্ত্র শাখার নেতৃবৃন্দ নিয়মিতভাবে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে যাতায়াত করছে। তাদের কার্যক্রম সীমিত আকারে নয়; বরং স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন, সিআইডি, এমনকি বিএসএফ কর্মকর্তাদের সাথেও সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করা হয়েছে।
ত্রিপুরার প্রশাসনিক মহলে অনুপ্রবেশ: গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে যে ইউপিডিএফ নেতারা আগরতলা শহরে সিআইডি ও পুলিশ কর্মকর্তাদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ করেছে।
এসডিপিও অভিজিৎ, এসপি সুশান্ত যাদব, ওসি সুমিত্র চ্যাটার্জী, এএসআই তনুমনি চাকমা সহ একাধিক কর্মকর্তা এ নেটওয়ার্কের অন্তর্ভুক্ত।
এমনকি বিএসএফ-এর গোয়েন্দা বিভাগেও প্রসেনজিৎ ডামাই ও ঋষি কাপুর নামের কর্মকর্তাদের সাথে ইউপিডিএফ নেতৃত্বের সম্পর্ক স্থাপনের খবর পাওয়া গেছে।
অস্ত্র ক্রয়-বিক্রয় ও লেনদেন: ২৬ এপ্রিল ২০২১ তারিখে বিপ্লব চাকমা আগরতলার বটতলা এলাকায় সমীর বনিক নামের এক ব্যক্তির কাছ থেকে বিশ লক্ষ টাকা সংগ্রহ করে।
পরদিন বিপ্লব ও তপন নামের আরেক নেতা আগরতলায় অবস্থান করে অস্ত্র ক্রয়ের চেষ্টা চালায়।
ইউপিডিএফ এর তৎকালীন সশস্ত্র শাখার কমান্ডার সমাজ প্রিয় চাকমা এই সমগ্র প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব দেয় এবং নিয়মিতভাবে সহযোগী ব্যক্তিদের মাসিক অর্থ প্রদান করে।
গ্রেফতার ও নেটওয়ার্ক: ত্রিপুরার রাধানগর প্রগতি সংঘ ক্লাব সংলগ্ন এলাকা থেকে ইউপিডিএফ সদস্য সুরশ চাকমাকে গ্রেফতার করা হয়, যে অস্ত্র ক্রয়ের উদ্দেশ্যে সীমান্ত অতিক্রম করেছিল। এ ঘটনাই প্রমাণ করে, ইউপিডিএফ কেবল আদর্শগত নয় বরং লজিস্টিক, আর্থিক ও সামরিক দিক থেকেও ভারতের ভেতরে সক্রিয়।
জেএসএস (সন্তু): সীমান্তপারে ভূমি ক্রয় ও উচ্চপর্যায়ের বৈঠক: অন্যদিকে, ২০২১ সালের শেষভাগে আরও গুরুতর তথ্য উন্মোচিত হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক দল জেএসএস-এর বিভিন্ন শাখার প্রভাবশালী নেতারা ভারতের মাটিতে বিপুল পরিমাণ ভূমি ক্রয় করেছে। এর উদ্দেশ্য কেবল নিরাপদ আশ্রয় নয়; বরং দীর্ঘমেয়াদে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা এবং সম্ভাব্য সংঘাতের জন্য সামরিক ঘাঁটি গড়ে তোলা।
ভূমি ক্রয়ের তথ্য: শান্তি লারমা (প্রভাত চন্দ্র সরকার) কলকাতায় ভূমি ক্রয় করেছে।
- উষাতন তালুকদার সাবেক এমপি রাঙামাটি (জেএসএস সন্তুর সহ-সভাপতি) আগরতলায় ২ কানি জমি কিনেছে।
শক্তিপদ ত্রিপুরা, সংগঠনিক সম্পাদক, আগরতলায় ২ কানি জমি অধিগ্রহণ করেছে।
গায়নন্দু বিকাশ চাকমা, সহকারী মহাসচিব, নন্দনগরে ভূমি কিনেছে।
সঞ্জীব চাকমা মিজোরামের আওইজল এলাকায় জমি কিনেছে।
বিশাল চাকমা ত্রিপুরার কাঞ্চনপুরে ১০ কানি রাবার বাগানসহ একাধিক সম্পত্তির মালিক হয়েছে।
অংশুমান চাকমা, বিমল কান্তি চাকমা ও জুপিটার চাকমা—এদের প্রত্যেকেই কলকাতা, আগরতলা ও ত্রিপুরায় জমি ক্রয়ের মাধ্যমে প্রমাণ করেছে যে, ভারতই এখন জেএসএস নেতৃত্বের বিকল্প ঘাঁটি।
গোপন বৈঠক ও ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর সম্পৃক্ততা: ২০২১ সালের ১ আগস্ট উষাতন তালুকদারসহ জেএসএস নেতারা ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠক করে। বৈঠকে অস্ত্র সরবরাহ, গেরিলা প্রশিক্ষণ এবং রাজনৈতিক আশ্রয় নিশ্চিত করার জন্য ভারতের সহযোগিতা কামনা করা হয়।
একই বছর ৪ জুন শক্তিপদ ত্রিপুরা ও বাচু চাকমা ত্রিপুরা পুলিশের আইজি’র সাথে বৈঠক করে, যেখানে বাংলাদেশে অভিযুক্ত জেএসএস নেতাদের ভারতে নিরাপদ থাকার অনুমতি, পুনরায় প্রশিক্ষণ ক্যাম্প চালু করা এবং রাজনৈতিক কার্যক্রমের অনুমোদনের বিষয়ে আলোচনা হয়। ১৪ জুন আরেক বৈঠকে ত্রিপুরা পুলিশের ডিরেক্টর জেনারেল ও আইজি অংশ নেয়, যেখানে ইউপিডিএফ (প্রসিত) গোষ্ঠীর কর্মীদেরও ভারতে আশ্রয় দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয় বৈঠকের পর ভারতীয় পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছে নগদ পাঁচ লাখ রুপি প্রদান করা হয়।
আঞ্চলিক প্রেক্ষাপটে বিশ্লেষণ:
১. নিরাপত্তা হুমকি: বাংলাদেশের ভেতরে সক্রিয় এই আঞ্চলিক দলগুলো সীমান্তপারে আশ্রয় নিয়ে কেবল অস্ত্র সংগ্রহ করছে না; বরং দীর্ঘমেয়াদী রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তি সঞ্চয় করছে।
২. বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের উপর প্রভাব: ভারতের কিছু প্রভাবশালী নিরাপত্তা কর্মকর্তার সাথে এ ধরনের যোগাযোগ দ্বিপাক্ষিক সৌহার্দ্যের জন্য ক্ষতিকর। এটি প্রমাণ করে, এখনও সীমান্ত অঞ্চলে ভারতের মাটিকে ব্যবহার করে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা সক্রিয়।
৩. আদর্শ বনাম বাস্তবতা: যে দলগুলো পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষার নামে আন্দোলন করে, তারা এখন ভারতের শহর-গ্রামে জমি কিনে ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বিকল্প শক্ত ঘাঁটি গড়ে তুলছে। এর মাধ্যমে বোঝা যায়, তাদের আন্দোলনের সাথে সাধারণ মানুষের অধিকারের যোগসূত্র ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসছে।
৪. ইউপিডিএফ ও জেএসএস এর সম্ভাব্য আঁতাত: দুই প্রতিদ্বন্দ্বী গোষ্ঠী হলেও ভারতীয় ভূখণ্ডে আশ্রয় ও অস্ত্র প্রশিক্ষণ প্রাপ্তির স্বার্থে তারা পরস্পরের সাথে নেটওয়ার্ক স্থাপন করছে। বিশেষত জেএসএস নেতাদের ভারতীয় পুলিশের সাথে আলোচনায় ইউপিডিএফ (প্রসিত) সদস্যদের আশ্রয়ের বিষয়টি ইঙ্গিতবহ।
পার্বত্য চট্টগ্রামের সশস্ত্র রাজনীতি আজ একটি নতুন মাত্রায় প্রবেশ করেছে। ইউপিডিএফ (মূল) ত্রিপুরা পুলিশের সাথে লেনদেন করে অস্ত্র সংগ্রহ করছে, আর জেএসএস নেতৃত্ব কলকাতা-ত্রিপুরায় জমি কিনে ভবিষ্যতের জন্য ঘাঁটি গড়ে তুলছে। দুই পক্ষই ভারতের নিরাপত্তা সংস্থার একটি অংশের সাথে যোগাযোগ রাখছে, যা বাংলাদেশের ভৌগোলিক অখণ্ডতা ও নিরাপত্তার জন্য বিপজ্জনক।
এটি স্পষ্ট যে, পার্বত্য অঞ্চলের এই গোপন ভারতমুখী কার্যক্রম কেবল বিচ্ছিন্নতাবাদী রাজনীতির পুনরুত্থান নয়; বরং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, কূটনৈতিক সম্পর্ক ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য এক গভীর সংকট। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশ রাষ্ট্র এ বিষয়ে কতটা সজাগ এবং সীমান্তবর্তী রাষ্ট্র ভারতের নীতি-নির্ধারক মহল এই অস্থিতিশীলতাকে প্রশ্রয় দেবে, নাকি সীমান্ত শান্তির স্বার্থে কার্যকর ব্যবস্থা নেবে।
সূত্র:
ক। আর্মি সিকিউরিটি ইউনিট পত্র নং ২৩.০১.৯০১.৭১৯.০৬.০৪১.০৪.০৬.০২.২০ তারিখ ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০।
খ। আর্মি সিকিউরিটি ইউনিট পত্র নং ২৩.০১.৯০১.৭১৯.০৬.০৪১.০২.১২.০৫.২১ তারিখ ১২ মে ২০২১।
AHQ GS Br MO Dte
23.01.901.024.04.041.01.28.12.21
28 December 2021
সোশ্যাল সূত্র: জুলকারনাইন সায়ের