পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম পাহাড়ী অঞ্চলে, যেখানে প্রকৃতির সৌন্দর্য অস্ত্রের ধ্বনিতে বিষাক্ত হয়ে ওঠে, সেখানে এক অদৃশ্য যুদ্ধের ডামাডোল ঘনীভূত হয়েছে। গত এক সপ্তাহ ধরে, রাঙামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলাধীন সাজেক ইউনিয়নের গন্ডাছড়া এলাকায়, ভারতীয় সীমান্তের অদূরে, এক বিপুল অস্ত্রের চালান অপেক্ষমান। এই চালান, যা পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র মিজোরামের নহাবা বিএসএফ ক্যাম্পের নিকটে লুক্কায়িত, যেকোনো মুহূর্তে বাংলাদেশের পার্বত্য ভূমিতে প্রবেশ করতে পারে। স্থানীয় নিরাপত্তা বাহিনীর বিশ্বস্ত সূত্রসমূহ এই তথ্য নিশ্চিত করলেও, আটকের কোনো সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপের সন্ধান মেলেনি। এই অস্ত্রসমূহের আগমন, যেন এক অভিশপ্ত ঝড়ের পূর্বাভাস, পাহাড়ের শান্তিকে বিপর্যস্ত করার অভিসন্ধি বহন করে।
এই ঘটনার মূল অভিযুক্ত হলো পার্বত্য চুক্তি-বিরোধী সংগঠন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ), যারা তাদের সশস্ত্র তৎপরতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ভারত থেকে এই চালান সংগ্রহ করেছে। বিশ্বস্ত সূত্রগুলো জানায়, চালানটিতে ত্রিশ হাজারের অধিক ৭.৬২ বোরের গোলাবারুদ রয়েছে, সঙ্গে একে-৪৭, সাবমেশিন গান, চায়না রাইফেল এবং এম-১৬ ধরনের অন্তত তেইশটি আগ্নেয়াস্ত্র। এই অস্ত্রসমূহ, যেন মৃত্যুর দূত, পাহাড়ের অস্থিরতাকে আরও গভীরতর করার প্রয়াসে সজ্জিত। ইউপিডিএফের ১৩৫ জনের একটি সশস্ত্র দল ইতিমধ্যে এই চালান বুঝে নেওয়ার জন্য প্রস্তুত। এই দলের নেতৃত্বে রয়েছেন সিনিয়র কোম্পানি কমান্ডার রঞ্জন মনি চাকমা (আদি বাবু) এবং সহকারী কোম্পানি কমান্ডার ডা. প্রীতি। তারা বর্তমানে ভারতের মিজোরাম সীমান্তবর্তী নহাবা বিএসএফ ক্যাম্পের নিকটবর্তী এলাকায় এবং বাংলাদেশের বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক ইউনিয়নের গন্ডাছড়া বিজিবি বিওপির আওতাধীন ‘পিত্তিছড়া’ নামক স্থানে অবস্থান করছেন। স্থানীয় বাসিন্দাদের সূত্রগুলো নিশ্চিত করে যে, তারা বাংলাদেশ থেকে চালসহ বিপুল রসদপত্র সংগ্রহ করে রেখেছেন, যেন এক দীর্ঘকালীন অভিযানের প্রস্তুতি।
কিন্তু এই অস্ত্রের চালানের তথ্য জানতে পেরে, প্রতিদ্বন্দ্বী সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সংহতি সমিতি (জেএসএস) এর সদস্যরা লুটের লক্ষ্যে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। গত এক সপ্তাহ ধরে, জেএসএসের শতাধিক সশস্ত্র সদস্যের একটি দল শিয়ালদহ এবং পিত্তিছড়া এলাকায় অবস্থান করছে। এই দলের নেতৃত্বে রয়েছেন মনিময় চাকমা, সায়মন চাকমা এবং বরুন চাকমা। এই বিবাদের ফলে, গত এক সপ্তাহে অন্তত চারবার আমছড়ি, গন্ডাছড়া এবং উদলছড়ি এলাকায় উভয় পক্ষের মধ্যে বন্দুকযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। রোববার সকালে, এই গোলাগুলিতে অন্তত চারজন ইউপিডিএফ সদস্য গুলিবিদ্ধ হয়েছেন এবং দুজন প্রাণ হারিয়েছেন বলে গ্রুপের সূত্রগুলো জানিয়েছে, যদিও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এই তথ্য নিশ্চিত করতে পারেনি। এই যুদ্ধের ধ্বনি, পাহাড়ের নীরবতাকে বিদীর্ণ করে, যা আগুনের পূর্বাভাস।
রাঙামাটির পুলিশ সুপার ড. ফরহাদ হোসেনের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি জানান যে, পাহাড়ের বিশৃঙ্খলাকারীদের বিরুদ্ধে সমন্বিত কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে এবং সার্বিক পরিস্থিতি নজরদারিতে রাখা হয়েছে। কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী যদি পাহাড়ের জনজীবনকে বিপর্যস্ত করার অপচেষ্টা করে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে তিনি হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। কিন্তু এই অস্ত্রের চালান যদি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে, তাহলে অস্ত্রের ঝনঝনানি পুনরায় শুরু হবে এবং অনেক তাজা প্রাণ ঝরবে বলে নিরাপত্তা বাহিনীর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন। ইউপিডিএফের অন্যতম প্রধান ক্যাম্প হলো ভূয়াছড়ি, যেখানে তাদের সশস্ত্র তৎপরতার কেন্দ্রস্থল। এছাড়া দুরদুরিছড়া, থালকুম্বো এবং লক্ষিছড়িতে অন্তত পাঁচটি ক্যাম্প রয়েছে। শীলছড়ায় তাদের অফিসারদের ব্যারাক অবস্থিত, যেখানে সমস্ত আগ্নেয়াস্ত্র এবং গোলাবারুদ সংরক্ষিত, এবং সাধারণ জনগণের প্রবেশ নিষিদ্ধ। থালকুম্বো এলাকায় তাদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে, যেন এক অন্ধকার বিদ্যালয় যেখানে মৃত্যুর শিক্ষা দেওয়া হয়।
এই ক্যাম্পসমূহ সাজেক ইউনিয়নের মাচালং আর্মি ক্যাম্প থেকে নৌপথে ত্রিশ কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব দিকে, লক্ষিছড়ি আর্মি ক্যাম্প থেকে উত্তর-পূর্ব দিকে আঠারো কিলোমিটার এবং শহীদ লেফটেন্যান্ট মুশফিক টিলা আর্মি ক্যাম্প থেকে উত্তর-পূর্ব দিকে বিশ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। পাহাড়ের চূড়ায়, বাঁশবাগানের মাঝখানে, ছড়ার উপরে এই ব্যারাকসমূহে শতাধিক সশস্ত্র ক্যাডার অবস্থান করছে বলে বিশ্বস্ত সূত্র নিশ্চিত করেছে। এই এলাকার কাছাকাছি উল্টোদিকে, উত্তর-পশ্চিম দিকে দিঘিনালা উপজেলার নাড়াইছড়ি আর্মি ক্যাম্প এবং পাংখোপাড়া আর্মি ক্যাম্প অবস্থিত। নিরাপত্তা বাহিনীর দায়িত্বশীল সূত্র জানায় যে, সরকারের উচ্চমহলের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায়, এই ক্যাম্পসমূহকে সক্রিয় করে ড্রোন দিয়ে রেকনেসাঁস করে পরিকল্পিত অভিযান পরিচালনা করলে সন্ত্রাসীদের নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব।
পানছড়িতে ইউপিডিএফের চলমান যুদ্ধ স্থগিত রাখার একমাত্র কারণ হলো গোলাবারুদের সঙ্কট। পর্যাপ্ত অর্থের অভাবে তারা দীর্ঘদিন ধরে অস্ত্র এবং গোলাবারুদ সীমান্তপার থেকে আনতে পারেনি। কিন্তু গত কয়েকদিন আগে, রবি কোম্পানির কয়েকজন অপহৃত ব্যক্তিকে মুক্তি দেওয়ার বিনিময়ে ইউপিডিএফ ছয় কোটি টাকার কাছাকাছি মুক্তিপণ গ্রহণ করেছে। এছাড়া সেই কোম্পানি থেকে প্রতি মাসে চৌত্রিশ লক্ষ টাকা মাসোহারা পাচ্ছে। এই অর্থ দিয়ে তারা এই অস্ত্রের চালান সংগ্রহ করছে বলে নিরাপত্তা বাহিনীর সূত্র জানিয়েছে। সম্প্রতি, ইউপিডিএফের অন্যতম প্ল্যাটফর্ম ‘জুম্ম ছাত্র জনতা’ ব্যানারে আহূত অবরোধে গুইমারায় নিহত, আহত এবং ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারগুলোর জন্য ত্রাণ দেওয়ার নামে গ্রাম থেকে নগদ টাকা সংগ্রহের পরিকল্পনা নিয়েছে। এই উত্তোলিত অর্থের একটি সিংহভাগ তাদের অস্ত্র এবং গোলাবারুদ ক্রয়ের জন্য ব্যয় করা হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র নিশ্চিত করেছে।
এই সকল ঘটনা, পার্বত্যাঞ্চলের শান্তিকে এক অভিশপ্ত ছায়ায় আচ্ছাদিত করেছে। যেখানে প্রকৃতির সৌন্দর্য অস্ত্রের ধ্বনিতে বিষাক্ত হয়, সেখানে মানুষের জীবন এক অস্থির স্বপ্নের মতো। নিরাপত্তা বাহিনীর সক্রিয়তা এবং সরকারী নীতির কঠোরতা যদি এই বিবাদকে নিয়ন্ত্রণ করে, তাহলে হয়তো পাহাড়ের শান্তি ফিরে আসবে। কিন্তু এই অস্ত্রের চালানের ছায়া, যেন এক অন্ধকার কাহিনীর অংশ, যা আগুনের পূর্বাভাসের মধ্য দিয়ে পার্বত্য জীবনের নানন্দিকতাকে বিষাদময় করে তুলেছে।