কবুলিয়তের ফাঁদে বন্দি পার্বত্য বাঙালি: আটকে আছে জমি রেজিষ্ট্রেশন।

0
ছবি: জমি রেজিষ্ট্রেশন দিতে গিয়ে হয়রানির শিকার মুক্তার আলী

অনন্ত অসীম | পার্বত্য চট্টগ্রাম

পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রশাসনিক নীতিনির্ধারণে যে কত গভীর বৈষম্য লুকিয়ে আছে, রাঙামাটির কাউখালীর নাইল্যাছড়ি গ্রামের হতদরিদ্র মুক্তার আলীর ঘটনা তার এক নির্মম উদাহরণ। রাষ্ট্রের আইন যেখানে নাগরিকের অধিকার সুরক্ষার নিশ্চয়তা দেয়ার কথা, সেখানে আজ তা হয়ে উঠেছে এক বিভীষিকাময় উপহাস।

দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ মুক্তার আলী জীবনের শেষ প্রান্তে এসে নিজের জমি বিক্রি করে চিকিৎসার টাকা জোগাড় করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য! তার জমি রেকর্ডভুক্ত থাকা সত্ত্বেও জেলা প্রশাসকের কার্যালয় কবুলিয়তের অজুহাতে সেই জমির রেজিষ্ট্রেশন বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে, ক্রেতা অর্থ দিতে পারছেন না, আর মুক্তার আলী হাসপাতালের শয্যায় মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন। গত ৩ মাস ধরে জমি বেচা-কেনা করতে গিয়ে রাঙামাটিতে এধরণের হয়রানির শিকার হাজারো বাঙালি। এই সৃষ্ট জটিলতার সমাধান পেতে রাঙামাটি জেলা প্রশাসকের অফিসের বারান্দায় ঘুরছে বাঙালিরা।

পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি প্রশাসনে দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত প্রথা হলো, জমাবন্দিই হচ্ছে জমির মালিকানার সর্বশেষ ও বৈধ দলিল। এটি কেবল ভূমির কর আদায় বা খাজনা প্রদানের দলিল নয়; এটি রাষ্ট্রীয়ভাবে জমির মালিকানা ও উত্তরাধিকার প্রমাণেরও চূড়ান্ত প্রমাণপত্র।

ঘটনাটিকে কেন্দ্র করে স্থানীয় সংবাদকর্মী আরিফুল হক মাহবুব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ক্ষোভ প্রকাশ করে মুক্তার আলীর চিকিৎসার অর্থ সংগ্রহে জমি রেজিষ্ট্রেশন সম্পন্নের দাবি জানান।

১৯৭৯ সালে সরকার যখন রাস্ট্রের স্বার্থে পুনর্বাসন কর্মসূচির অংশ হিসেবে পাহাড়ে বাঙালি পুনর্বাসন শুরু করে, তখন হাজার হাজার পরিবারকে কবুলিয়তের মাধ্যমে সরকারি খাস জমি বন্দোবস্ত করে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে এই কবুলিয়তের ভিত্তিতেই প্রশাসন তাদের নামে জমাবন্দি রেকর্ড তৈরি করে, যা আজও সেই পরিবারের জমির স্বত্বের একমাত্র প্রমাণ হিসেবে স্বীকৃত।

তাহলে প্রশ্ন জাগে, যে ব্যক্তি সরকারের মাধ্যমে রেকর্ডভুক্ত মালিক, তিনি কেন পুনরায় কবুলিয়ত দেখাবেন?

আশির দশকে অধিকাংশ বাঙালিরা কবুলিয়ত সংরক্ষণ করেননি৷ দীর্ঘ বছর পর বাঙালিদের জমি রেজিষ্ট্রেশন করতে কবুলিয়তের প্রয়োজনীয়তা দেখাচ্ছে জেলা প্রশাসন৷ বর্তমানে এই সমস্যায় সবচেয়ে বেশি মুখামুখি বাঙালিরা। কারণ পার্বত্য চট্টগ্রামে জমি বেচা-কেনায় উপজাতিদের চেয়ে বাঙালিদের সংখ্যা বেশি। তাই জটিলতা উপজাতিদের চেয়ে বাঙালিরা হয়রানি বেশি হচ্ছে।

গত তিন মাস ধরে রাঙামাটি জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে এক অদ্ভুত জটিলতা সৃষ্টি করা হয়েছে। জানা গেছে, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) স্ব-ইচ্ছায় জমির রেজিষ্ট্রেশনের পূর্বে পুরনো কবুলিয়ত প্রদর্শনের নির্দেশ দিয়েছেন। অথচ আইন বা নীতিমালায় এ ধরনের কোনো শর্ত নেই। এই হয়রানি থেকে বাঁচতে অনেকেই কবুলিয়তের জন্য আবেদন করেও পাচ্ছে না। এদিকে সৃষ্ট জটিলতায় বন্ধ হয়ে গেছে জমি বেচা-কেনা।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এই সিদ্ধান্তটি কেবল প্রশাসনিক খামখেয়ালিপনা নয়; বরং এর পেছনে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সাম্প্রদায়িক ইন্ধন থাকতে পারে। পার্বত্য অঞ্চলের বাঙালি জনগোষ্ঠীকে ভূমি ব্যবস্থাপনায় ধীরে ধীরে প্রান্তিক করে দেওয়ার যে কৌশল কিছু গোষ্ঠী চালিয়ে যাচ্ছে, এটি তারই এক আধুনিক রূপ।

রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের হাজারো বাঙালি পরিবার ৪০ বছরের অধিক সময় ধরে জমাবন্দির ভিত্তিতে জমি ক্রয়-বিক্রয় করে আসছে। কিন্তু হঠাৎ করে কবুলিয়ত ছাড়া রেজিষ্ট্রেশন বন্ধ, এমন একটি নীতি কেবল প্রশাসনিক জটিলতা নয়; এটি রাষ্ট্রীয় বৈষম্যের এক নিদর্শন।

আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, কবুলিয়ত মূলত সরকারের প্রাথমিক বন্দোবস্তের একটি দলিল মাত্র। পরবর্তীতে জমাবন্দি যখন সরকারের রেকর্ডে অন্তর্ভুক্ত হয়, তখন সেটিই হয়ে ওঠে মালিকানার চূড়ান্ত নথি। অতএব, কবুলিয়ত প্রদর্শনের দাবি আইনি ভিত্তিহীন এবং প্রশাসনিক ক্ষমতার অপব্যবহার।

হাসপাতালের শয্যায় মৃত্যুপথযাত্রী মুক্তার আলী এখন এক প্রতীকি নাম। তার জমি বিক্রি আটকে রাখা মানে, এক অসহায় নাগরিকের জীবন বাঁচানোর সুযোগ কেড়ে নেওয়া। অথচ তিনি সরকারের নিয়মে প্রাপ্ত জমির মালিক, কর-খাজনা নিয়মিত পরিশোধকারী।

তবু, প্রশাসনিক কার্যালয়ে তার আবেদন পড়ে থাকে দিনের পর দিন। “কবুলিয়ত আনেন, না হলে রেজিষ্ট্রেশন হবে না”—এই এক বাক্যে তার জীবনের প্রতিটি আশা ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে।

সরকারি পুনর্বাসন নীতির বিপরীতে প্রশাসনের অবস্থান: ১৯৭৯ সালের পর থেকে পার্বত্য অঞ্চলে যে বাঙালি পুনর্বাসন নীতি গৃহীত হয়, তা ছিল রাষ্ট্রীয় কৌশলের অংশ, জাতীয় নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক পুনর্গঠন ও জনসংখ্যাগত ভারসাম্য রক্ষার উদ্দেশ্যে। কিন্তু আজ সেই নীতির ফলভোগকারীদেরই ‘কাগজের জটিলতায়’ আটকে ফেলা হচ্ছে।

এ যেন রাষ্ট্রের এক অংশ অন্য অংশের সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত। একদিকে সরকার উন্নয়ন ও অন্তর্ভুক্তির কথা বলছে, অন্যদিকে মাঠ পর্যায়ের কিছু আমলা তাদের ব্যক্তিগত মনোভাব ও গোষ্ঠীগত প্রভাবের কারণে প্রশাসনিক বাধা তৈরি করছেন।

পাহাড়ের বাঙালিরা এখন এক ভয়াবহ অনিশ্চয়তায় দিন কাটাচ্ছে। উপজাতিদের প্রথাগত অধিকার, হেডম্যান প্রতিবেদন, সার্কেল চীপ সনদ এবং ডিসি সনদের মত অপ্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমি বেচা-কেনা এমনিতেই সমস্যা তৈরি করেছে। যে জমিতে বাঙালিরা ৪ দশকের বেশি সময় ধরে বসবাস করছে, তার মালিকানা আজ প্রশ্নবিদ্ধ। এই অন্যায্য ও বৈষম্যমূলক নীতির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রকে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে।

সরকারের উচিত—
১. পার্বত্য অঞ্চলে জমাবন্দি-কেই একমাত্র বৈধ মালিকানা দলিল হিসেবে পুনঃনিশ্চিত করা।
২. অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের এ ধরনের ক্ষমতাচর্চা অবিলম্বে স্থগিত করা।
৩. মুক্তার আলীসহ সকল ভুক্তভোগীর জমি রেজিষ্ট্রেশন অবিলম্বে সম্পন্ন করা।
৪. প্রশাসনের মধ্যে যে গোষ্ঠীগত প্রভাব ও পক্ষপাত রয়েছে, তা তদন্ত করে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া।

একটি কবুলিয়তের অজুহাত, এক জাতির বঞ্চনা: পার্বত্য চট্টগ্রাম শুধু পাহাড় নয়, এটি বাংলাদেশের ভূখণ্ডের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সেখানে বসবাসকারী প্রতিটি নাগরিক চায় তিনি বাঙালি হোন বা উপজাতীয়, রাষ্ট্রের সমান নাগরিক অধিকার পাওয়ার দাবিদার।

কিন্তু আজ দেখা যাচ্ছে, প্রশাসনের একাংশের খামখেয়ালিপনা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নীতি পাহাড়ের বাঙালিদের ক্রমে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। একটি কবুলিয়তের অজুহাতে হাজারো জমির মালিক এখন অধিকারহীন হয়ে পড়ছেন।

রাঙামাটির মুক্তার আলীর জমি বিক্রির বাধা কেবল একটি ব্যক্তিগত দুঃখের গল্প নয়, এটি রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থাপনা, বৈষম্য ও প্রশাসনিক দুর্নীতির প্রতিচ্ছবি। তার মতো অসংখ্য মুক্তার আলী আজও নীরবে প্রশ্ন করছেন: “আমার জমাবন্দি যদি রাষ্ট্রীয় নথিতে স্বীকৃত হয়, তবে কেন আমি মালিক নই?” এই প্রশ্নের উত্তর রাষ্ট্রের নিকটই প্রত্যাশিত।

 

আগের পোস্টসেনা অভিযানে ইউপিডিএফ এর গোপন আস্তানা সন্ধান: অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার।

রিপ্লাই দিন

আপনার কমেন্ট লিখুন
আপনার নাম লিখুন