লামা যে নামটা একদিন মুখে আনলেই বুকের ভিতর সবুজ ঝরনার শব্দ হতো, আজ সেই নামটা উচ্চারণ করলে গলায় ধুলো জমে।
আমি ছোটবেলায় প্রথম লামায় গিয়েছিলাম বাবার কোলে চড়ে। মাতামুহুরী নদী তখন এমন নীল ছিল যে, আকাশ লজ্জায় মেঘ হয়ে লুকিয়ে যেত। পাহাড়গুলো এত ঘন সবুজে ঢাকা ছিল যে, সূর্যোদয়ের আলো গাছের পাতায় আটকে থেকে সোনালি ফোয়ারা হয়ে ঝরত। মিরিঞ্জা পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়ালে মনে হতো পুরো পৃথিবীটা আমার পায়ের তলায় শুয়ে আছে, আর তার বুকের ধুকপুক শুনতে পাচ্ছি। তখন লামা মানে ছিল অক্ষয় সবুজের একটা চিরন্তন প্রতিশ্রুতি। আজ সেই প্রতিশ্রুতি ভাঙা কাঁচের মতো আমাদের পায়ের তলায় কনকন করছে।
গত বছর গিয়েছিলাম। রাস্তায় ওঠার আগেই ধুলোর ঝড় এসে চোখ-মুখ বন্ধ করে দিল। মিরিঞ্জার দিকে তাকিয়ে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল। যে পাহাড়টা একদিন আমার শৈশবের স্বপ্ন ছিল, সে আজ ক্ষত-বিক্ষত, রক্তাক্ত একটা মৃতদেহের মতো পড়ে আছে। গাছ নেই, ছায়া নেই, পাখির ডাক নেই। শুধু লালচে মাটি আর ধারালো পাথরের ক্ষতচিহ্ন। যেন কেউ ছুরি দিয়ে পাহাড়ের বুক চিরে হৃৎপিণ্ডটা বের করে নিয়ে গেছে।

আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম সানরাইজ পয়েন্টে। সূর্য ওঠার কথা, কিন্তু সূর্য লজ্জায় উঠতে চাইছিল না। শুধু ধুলোর মেঘ আর ন্যাডা পাহাড়, ইটভাটার কালো ধোঁয়া মিশে একটা বিষাক্ত কম্বল বিছিয়ে দিয়েছিল আকাশে। আমার পাশে দাঁড়ানো এক বুড়ো লোক ফিসফিস করে বলল, “বাবু, এই পাহাড়টা একদিন আমাদের মা ছিল। আজ সে আমাদের অভিশাপ দিচ্ছে।”
আমি কিছু বলতে পারিনি। শুধু চোখ দিয়ে জল পড়ছিল। কান্না না, ধুলো।
লামার বাঙালিরাও বদলে গেছে। একদিন যারা অচেনা পথিককে বাড়িতে ডেকে নিয়ে ভাত-মাছ-ঝোল আর আনারস, কাঁঠাল, আম, লিচু, কলা খাইয়ে বলত, “আরেকটা রাত থাকেন না ভাই?”, সেই বাঙালিরাই আজ নিজেদের মধ্যে কাঁটাতার টাঙিয়ে দিয়েছে। এক গ্রাম আরেক গ্রামকে চিনে না। এক ভাই আরেক ভাইকে বিশ্বাস করে না। যে ঐক্য একদিন শান্তিবাহিনীর গুলির সামনে দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছিল, সেই ঐক্য আজ ছিন্নভিন্ন। এখন শুধু আছে “আমারটা”, “তোমারটা”, “ওরটা”।
রাতে লামা বাজারে বসে এক কাপ চা খাচ্ছিলাম। পাশের টেবিলে দুজন যুবক কথা বলছিল। একজন বলছিল, “আরে, ওই পাহাড়টা কেটে পর্যটন কটেজ, তামাক চাষ বা রাবার বাগান করলে কত টাকা আসবে জানিস?” আরেকজন হাসছিল, “হ্যাঁ রে, আর দশ বছর পর এখানে মরুভূমি হলে আমরা দুবাইয়ের মতো এসি লাগিয়ে থাকব।”

আমার চায়ের কাপটা হাতে কাঁপছিল।
আমি জানি, এই ধ্বংসের পেছনে শুধু বহিরাগত নয়, আমরাও আছি। আমাদের লোভ, আমাদের নিষ্ক্রিয়তা, আমাদের “আমি কী করব একা” ভাবনা। আমরা নিজের চোখের সামনে সেগুন, গামারি ও বিলুপ্ত শিউরি গাছ কাটা দেখেছি, পাহাড় কাটা দেখেছি, ঝিরি ভরাট হতে দেখেছি। কিন্তু চুপ করে গেছি। কারণ চুপ থাকলে পকেট ভারী হয়।
রাতে ঘুম আসছিল না। জানালা খুলে তাকালাম। দূরে মাতামুহুরী নদীটা এখনো বয়ে চলেছে। কিন্তু তার গানটা আর আগের মতো নয়। এখন সে কাঁদছে। প্রতিটি বাঁকে সে বলছে, “আমাকে বাঁচাও।” কিন্তু কেউ শুনছে না।
আমি চোখ বন্ধ করলাম। মনে পড়ল ছোটবেলার সেই সবুজ লামা, লাইনঝিরি, গজালিয়া, রূপসীপাড়া, ফাঁসিয়াখালী, আজিজনগর, সরই, এবং মারমা, মুরং, খেয়াং, তংচঙ্গ্যা, ত্রিপুরাসহ আরও অনেক পাহাড়ি পাড়া, মনে পড়ল মাতামুহুরী নদীর দুই তীর, মিরিঞ্জার চূড়ায় দাঁড়িয়ে বাবার সঙ্গে চিৎকার করে বলেছিলাম, “বাবা, আমি যখন বড় হব, এই পাহাড়টা আমি কিনে নেব!” বাবা হেসে বলেছিলেন, “পাহাড় কেনা যায় না বাবা, পাহাড় ভালোবাসা যায়।”

আজ বুঝি, আমরা ভালোবাসতে ভুলে গেছি। লামা এখনো মরেনি। তার বুকের ভিতর এখনো কিছু সবুজ লুকিয়ে আছে। কিছু ঝরনা এখনো গোপনে কাঁদছে। কিছু পাখি এখনো ফিরে আসার স্বপ্ন দেখছে। কিন্তু সময় খুব কম।
যদি আজ না জেগে উঠি, যদি আজ না বলি “থামো”, তবে কাল আমাদের সন্তানরা জিজ্ঞেস করবে, “বাবা, তোমরা কী দেখেছিলে সেই লামা? যেটা এখন শুধু ছবিতে আছে?”
আমি উত্তর দিতে পারব না। লামা, আমার লামা। তোমাকে ফিরিয়ে আনার আর সময় আছে কি? নাকি তুমি চলে যাচ্ছ, আমাদের চোখের সামনে দিয়েই, একটা নিঃশব্দ মৃত্যুতে?
আমি এখনো তোমার নাম মুখে আনি।
কিন্তু এখনো সবুজ ঝরনার শব্দ হয় না।
শুধু ধুলো জমে গলায়
তাই এবার আর রেহাই নেই। এবার লামার মৃত্যু-পত্রিকা লিখছি, যেখানে প্রতিটি ক্ষতের নাম-ঠিকানা-তারিখ থাকবে।
একটু জেনে নিই লামা সম্পর্কে-
লামা ৬৭১.৮৪ বর্গকিলোমিটারের মধ্যে ৩৩২.৮২৭ বর্গকিলোমিটার ছিল সংরক্ষিত বন।
আজ স্যাটেলাইট ছবিতে দেখা যায়, ২০১৫ থেকে ২০২৫ মাত্র দশ বছরে লামা-আলীকদম-থানচি অঞ্চলে ৬৮% বনাচ্ছাদন হারিয়েছে। মিরিঞ্জা রেঞ্জে বনাচ্ছাদন ৯৪% কমেছে। যে পাহাড়টা ২০১৮ পর্যন্ত গুগল আর্থে গাঢ় সবুজ ছিল, ২০২৫-এর ছবিতে সে লালচে-বাদামী ক্ষতচিহ্ন।
শিউরি (Shorea robusta-এর স্থানীয় নাম ‘লালি’) পার্বত্য চট্টগ্রামের ‘সি’ শ্রেণির সংরক্ষিত প্রজাতি। ২০১৯ সালে লামা রেঞ্জে এই প্রজাতির পরিপক্ক গাছ ছিল আনুমানিক ১৮,০০০। ২০২৪-এর বন বিভাগের অভ্যন্তরীণ জরিপে সংখ্যা নেমেছে ৮৭০-তে। অর্থাৎ ৯৫% বিলুপ্ত। এই গাছগুলো কাটা হয়েছে মূলত ইঞ্জিনবোটের কিল আর চকরিয়া-কক্সবাজারের ইটভাটার জ্বালানির জন্য।
মাতামুহুরী নদীর পানির প্রবাহ ২০০৫ সালে গড়ে ১৮৫ কিউমেক। ২০২৪ সালে শুষ্ক মৌসুমে তা নেমেছে ৩৮ কিউমেকে। কারণ: ১৮৭টি অবৈধ পাথর উত্তোলন স্পট (লামা বন বিভাগের গোপন রিপোর্ট, ২০২৪) নদীর উৎসমুখ ও ঝিরিগুলো ধ্বংস করেছে। শিলের ঝিরি, পালং ঝিরি, লাঙ্গিপাড়া, ক্যজুপাড়া প্রতিটি নাম এখন শুধুই কঙ্কাল।
লামায় অনেক স্থানে এখন অবৈধভাবে বালু উত্তোলন হয়, যা দেখার কেউ নেই।
লামা উপজেলায় ২০২৪ পর্যন্ত ৩৮৪টি রাবার বাগান রেজিস্টার্ড। আরো ৬০০+ অবৈধ। প্রতি হেক্টর রাবার বাগানের জন্য গড়ে ১৮০০-২২০০ গাছ কাটা পড়েছে। মোট হিসেবে গত পনেরো বছরে ১৪ লক্ষের বেশি পরিপক্ক গাছ ধ্বংস। তামাক চাষের জন্য আরো ৪২,০০০ হেক্টর বন উজাড়। প্রতি হেক্টর তামাক চাষে ১২-১৫ টন কাঠ পোড়ে জ্বালানি হিসেবে।
ইটভাটা: লামা উপজেলা সদর থেকে চকরিয়া-রামু সীমানায় ৩২৭টি ইটভাটা সরাসরি লামার বনের কাঠের ওপর নির্ভরশীল। ২০২৩-২৪ মৌসুমে এই ভাটাগুলোতে পোড়ানো হয়েছে আনুমানিক ৮৭,০০০ টন কাঠ, যার ৭৮% এসেছে লামার সংরক্ষিত বন থেকে। বিস্ময়কর হচ্ছে, লামার ৪০ট ইটভাটা যৌথবাহিনী বন্ধ করতে গেলে স্থানীয়রা বাধা হয়ে দাঁড়ায়৷ পরবর্তীতে ফিরে আসতে বাধ্য হয়।
জনসংখ্যা ও আবাসন শুমারি ২০২২ অনুসারে, বান্দরবান জেলার লামা উপজেলার মোট জনসংখ্যা ১,৩৯,৬৮৯ জন। এর মধ্যে বাঙালি জনসংখ্যার হার ৭৬.২%। অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর বিবরণ: মারমা (১১.৩%), ম্রো (৭.৭২%), ত্রিপুরা (৪.১২%) এবং অন্যান্য (০.৬২%)। পার্বত্য চট্টগ্রামের মধ্যে সবচেয়ে জনবহুল উপজেলা হচ্ছে এই লামা।
জনগোষ্ঠীগত পরিবর্তন: ১৯৮১ সালে লামায় বাঙালি জনসংখ্যা ছিল ৩৮%। ২০২২ সালে ৭৬.২%।
এই ৪৪ বছরে বাঙালি জনসংখ্যা বেড়েছে ৬ গুণ, কিন্তু শিক্ষার হার বেড়েছে মাত্র ১.৭ গুণ (১৯৮১: ২০% → ২০২২: ৩৪%)। অর্থাৎ জনসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে শিক্ষা, সচেতনতা, ঐক্য কিছুই বাড়েনি; বরং কমেছে।
সশস্ত্র নিয়ন্ত্রণ: লুলাং, লেমুং, মেপাং, ছোট বমো, বড় বমো, পোপা, এই ছয়টি দুর্গম এলাকা এখনো জেএসএস সন্তু গ্রুপ, এবং বিভিন্ন সশস্ত্র গ্রুপ থেকে দলছুট স্প্লিন্টার নিয়মিত উপস্থিতি। বাঙালি ব্যবসায়ীদের থেকে মাসোহারা আদায়ের দায়িত্ব এখন অনেক ক্ষেত্রে স্থানীয় কিছু বাঙালির হাতে। অর্থাৎ আমরা নিজেরাই নিজেদের গলায় দড়ি পরিয়ে দিচ্ছি।
মিরিঞ্জা পাহাড়: উচ্চতা ১৬০০ ফুট। ২০১৯ পর্যন্ত ৭৮% বনাচ্ছাদন।
২০২৫-এ ৪%। ৪০টির বেশি রিসোর্ট-কটেজ-পর্যটন স্পটের নামে কাটা হয়েছে ১৮৭ হেক্টর বন। যদিও সঠিক পরিসংখ্যান আরো বেশি। প্রতিটি রিসোর্টের পেছনে আছে স্থানীয় প্রভাবশালী বাঙালি ও উপজাতি নেতাদের যৌথ সিন্ডিকেট। উপজেলা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণাধীন মিরিঞ্জা পর্যটন কমপ্লেক্সও রয়েছে!
মাতামুহুরী নদীর দুই তীরে গড়ে উঠেছে সুখীয়া ও দুঃখীয়া ভ্যালি। সেখানে এখন সতেজ নিঃশ্বাস নেওয়ার পরিবেশ নেই।
লামা বন বিভাগের স্পেশাল টহল দলের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এ.কে.এম আলতাফ হোসেনের বিরুদ্ধে বনাঞ্চল ধ্বংস করে কাঠ পাচারের সহযোগিতার অভিযোগ রয়েছে। ডিএফও-এর নির্দেশ অমান্য করে ব্যক্তিগত স্বার্থ ও অবৈধ আর্থিক লেনদেনের জন্য তিনি ২০২৩-২০২৪ সালে ১৪টি জব্দ কাঠের ট্রাক ছেড়ে দিয়েছেন। কাগজপত্রগুলো এখনো ডিভিশনাল ফরেস্ট অফিসে ধুলো জমছে।
আমি আর কবিতা লিখছি না।
এটা কবরের শিলালিপি। লামা নামের যে সবুজ মাকে আমরা একদিন মা বলে ডাকতাম, তার গলা টিপে ধরে আমরা নিজেরাই তাকে মেরে ফেলেছি। এখন তার লাশের ওপর দাঁড়িয়ে আমরা ছবি তুলছি আর বলছি, “কী সুন্দর ভিউ!”
তুমি যদি এর পরেও কাঁদতে চাও, কাঁদো।
কিন্তু এবার চোখের জলের সঙ্গে রক্ত মিশে যাবে। কারণ এটা আর শোক নয়,৷ এটা অপরাধ। লামা মরে গেছে। আমরাই তাকে মেরেছি। আর আমরা এখনো বেঁচে আছি। এটাই সবচেয়ে বড় শাস্তি। আজ লামা যেন আগুনে পোড়া এক নগ্ন-দগ্ধ শিলাস্তম্ভ। যেখানকার পথগুলো একসময় শিশুর হাসি, যুবকের স্বপ্ন, চাষির ঘামের সোনা, অতিথির দৃষ্টিবিস্ময় চিহ্ন বহন করত, সেসব পথ এখন ধুলা-বালিতে ঘর্ষিত প্রান্তর, ন্যাড়া গমনের লজ্জায় শীতে কাঁপা রুক্ষ মরুভূমি। লামা আর সবুজ নয়, লামা এখন শুষ্ক রক্তক্ষরণ,যেন প্রাকৃতিক মৃত্যুর খসড়া দলিল।



