বান্দরবান পার্বত্য জেলার লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নের বনাঞ্চল রাতের আঁধারে যেনো অচেনা এক বিপর্যয়ের মুখোমুখি। সন্ধ্যার পর থেকেই অবৈধ কাঠ ও জ্বালানি কাঠ পাচারে বেপরোয়া হয়ে ওঠে সিন্ডিকেট চক্র। স্থানীয় বনাঞ্চল থেকে বান্দরবান ও চট্টগ্রামের সীমান্তবর্তী ইটভাটাগুলোর দিকে কাঠের গাড়ি চলাচল শুরু হয়, আর প্রতিটি গাড়ি থেকে উত্তোলিত হয় বিপুল অর্থ, প্রতিটি লাকড়ীর গাড়ি থেকে ৪০০ টাকা, এবং কাঠ ভর্তি গাড়ি থেকে ১৫০০ টাকা। এই সিন্ডিকেট চক্রের নাম ব্যবহার করা হচ্ছে বন বিভাগের কর্মকর্তাদের, যেমন ডলু ছড়ি রেঞ্জের কেয়াজুপাড়া বিট কর্মকর্তা আব্দুল করিম, যার নাম ভাঙিয়ে পাচারকারীরা কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, লুলাইং ও মেরাইত্তা সহ আশেপাশের বনাঞ্চল দিন-রাত অবৈধভাবে উজাড় করা হচ্ছে। বন বিভাগের কর্মচারীরা কার্যত এই অবৈধ সিন্ডিকেটকে অর্থের বিনিময়ে সহায়তা প্রদান করছেন। স্থানীয়রা অভিযোগ করছেন, যারা কাঠ পাচার বন্ধ করার দায়িত্বে আছেন, তারাই এই চক্রকে সহযোগিতা করে এবং অর্থ গ্রহণ করে পাচারকারীদের জন্য পথ প্রশস্ত করছে।
বনসংরক্ষণের কথিত নীতিতে বাগান সৃজন করা ব্যক্তিরা নিজ বাগান থেকে ঘর-বাড়ির জন্য গাছ কাটতে পারে না। ফরেস্ট মামলার ভয় দেখায়। তদুপরি, মান্দার আমলের বন আইন প্রয়োগ করে বনাঞ্চলে জটিলতা সৃষ্টি করে অর্থ আদায় করা হচ্ছে। জোত পারমিটের নামে গাছ কাটার অনুমতি প্রদর্শন করে একাধিক বাগান থেকে গাছ কেটে পারমিটে ঢুকানো হয়। বাস্তবে তা হচ্ছে অসংগঠিত ও অবৈধ কাঠ পাচারের একটি ঢাকনা। এই প্রক্রিয়া বন বিভাগের দায়বদ্ধতাকে প্রশ্নের মুখে ফেলে।
পরিবেশের ওপর বন উজাড়ের প্রভাব মারাত্মক। বনাঞ্চলের গাছ কাটা, পাহাড় ন্যাড়া করা ও পাথর উত্তোলন প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করছে। পরিবেশবাদীরা সতর্ক করছেন, এ ধরনের কার্যক্রমে জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের পাশাপাশি পাহাড়ের পানির উৎস কমে যাচ্ছে। বনাঞ্চল ধ্বংসের ফলে স্থানীয় জলবায়ু পরিবর্তন, মাটি ক্ষয়, বন্যপ্রাণীর অবহেলা এবং মানবজীবনে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব সৃষ্টি হচ্ছে।
একজন পরিবেশবিদ মন্তব্য করেছেন, “ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১৩ (৫৯ নং আইন) অনুযায়ী ইটভাটায় কাঠ ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। আইনের ১৪(৬) ধারায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে—‘কোনো ব্যক্তি ইটভাটায় ইট পোড়ানোর কাজে জ্বালানি হিসেবে কাঠ ব্যবহার করতে পারবেন না’। তবে বাস্তবে এই আইন কার্যকর হচ্ছে না। ইটভাটাগুলো নির্বিচারে জ্বালানি কাঠ ব্যবহার করছে, যা পরিবেশের জন্য ভয়ঙ্কর হুমকি।”
স্থানীয় বাসিন্দা নিজাম উদ্দিন বলেন, “বন বিভাগের অসাধু কর্মকর্তারা সরাসরি কাঠ পাচারে জড়িত। যারা কাঠ পাচার বন্ধ করবে, তারাই চাঁদা খেয়ে এই চক্রকে সহযোগিতা করে। আমরা বারবার বন বিভাগের নজরদারির দাবি করেছি, কিন্তু কার্যক্রম অনিশ্চিত ও অব্যবস্থাপনা ছাড়া কিছুই হয়নি।”
উল্লেখযোগ্য যে, সাম্প্রতিক সময়ে হাইকোর্টের রায় বাস্তবায়নের উদ্যোগে লামার ইটভাটাগুলোতে অভিযান শুরু করা হয়। কিন্তু ইটভাটা মালিক ও শ্রমিকরা বাধা সৃষ্টি করে কার্যক্রম বন্ধ করতে বাধা প্রদান করেছে। এখানকার ইটভাটাগুলো চালু রাখার জন্য কাঠ অপরিহার্য। অথচ জ্বালানি কাঠ বন্ধ করে দিলে ইটভাটা বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু তা করা হচ্ছে না। এই পরিস্থিতি বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক হলেও, সিন্ডিকেট ও বন বিভাগের অসাধু কর্মকাণ্ডে পরিস্থিতি আরও জটিল হচ্ছে।

পরিবেশবাদীরা আশঙ্কা করছেন, যদি অবৈধ কাঠ পাচার বন্ধ না হয়, তাহলে বনাঞ্চল আরও দ্রুত উজাড় হবে। এতে পার্বত্য এলাকার প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হওয়া ছাড়াও পাহাড়ি জনপদের মানুষের জীবনযাত্রা, কৃষি ও জলের নিরাপত্তা বিপন্ন হবে। বন বিভাগের দায়বদ্ধতা, সিন্ডিকেট চক্রের অবৈধ কার্যক্রম এবং আইন প্রয়োগে উদাসীনতার কারণে এই বিপর্যয় আরো দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে।
এছাড়া, চাঁদাবাজি ও অর্থের বিনিময়ে কাঠ পাচারকে সহায়তা করার অভিযোগ বন বিভাগের ইমেজকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। বন বিভাগের দায়িত্ব হলো বন সংরক্ষণ ও পরিবেশ রক্ষা করা, কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে বন বিভাগের কিছু কর্মকর্তার অংশগ্রহণ এই দায়িত্বের প্রতি একপ্রকার অবমাননা।
এ পরিস্থিতিতে পরিবেশবিদরা, স্থানীয়রা এবং সচেতন নাগরিকরা দাবী করছেন—বনাঞ্চলে অবৈধ কাঠ পাচার সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করতে হবে। বন বিভাগের সকল কর্মকর্তাকে দায়িত্বশীল হতে হবে এবং মান্দার আমলের জটিল বন আইনকে সংশোধন এবং সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে হবে। জোত পারমিট ব্যবস্থায় কোনো অবৈধ কাঠ উত্তোলন বা চাঁদাবাজি চলতে দেওয়া যাবে না। পাশাপাশি, আইন অনুযায়ী ইটভাটায় কাঠ ব্যবহার বন্ধ করতে প্রশাসন ও বন বিভাগকে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
বান্দরবান পার্বত্য অঞ্চলের বনাঞ্চল এবং পরিবেশ রক্ষার জন্য এখন সময় এসেছে সক্রিয় পদক্ষেপ গ্রহণের। অবৈধ কাঠ পাচার বন্ধ করা, বন বিভাগের দায়িত্বশীলতা নিশ্চিত করা এবং পরিবেশ সংরক্ষণ নীতি কার্যকর করা ছাড়া পাহাড়ের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব নয়। বনাঞ্চলের উজাড়ের ভয়ঙ্কর প্রভাব ও চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণে আনতে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ গ্রহণই একমাত্র সমাধান।



