পার্বত্য চট্টগ্রামে ধর্ষণ ইস্যু: অপরাধের বিচার নাকি জাতিগত পক্ষপাত?

0

পারভেজ মারুফ | পার্বত্য চট্টগ্রাম

পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘটিত ধর্ষণ কিংবা যৌন নিপীড়নের মতো জঘন্য অপরাধের প্রতিক্রিয়া যেন অপরাধীর জাতিগত পরিচয়ের ওপর নির্ভর করে। একদিকে, রাঙামাটিতে উপজাতীয় এক বৃদ্ধ কর্তৃক তিন বছরের শিশু ধর্ষণের ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা; অন্যদিকে, বান্দরবানে এক বাঙালি শ্রমিকের বিরুদ্ধে ধর্ষণের কথিত অভিযোগ ঘিরে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া—এই বৈপরীত্য পার্বত্য চট্টগ্রামের বিচার ব্যবস্থার ভয়াবহ পক্ষপাতমূলক চরিত্রকে উন্মোচিত করেছে।

প্রথম ঘটনাটিতে আশ্চর্যজনক নীরবতা বিরাজ করলেও দ্বিতীয় ঘটনাটিতে উপজাতীয় সমাজের প্রতিক্রিয়া ছিল চরম প্রতিশোধপরায়ণ। এভাবে জাতিগত পরিচয়ের ভিত্তিতে অপরাধের বিচার কিংবা প্রতিক্রিয়া নির্ধারিত হওয়া নিঃসন্দেহে পার্বত্য চট্টগ্রামের সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতাকে অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরে। প্রশ্ন হলো, আইন কি এখানে সবার জন্য সমান? নাকি এটি ক্ষমতার ভারসাম্যের উপর নির্ভরশীল একটি রাজনৈতিক অস্ত্র মাত্র?

রাঙামাটিতে তিন বছরের শিশু যৌন নিপীড়নের শিকার: কোথায় উপজাতীয় সমাজের প্রতিবাদ?

১১ মার্চ, সোমবার, সকাল ১০টা। রাঙামাটি শহরের ভেদভেদী মৌনতলা এলাকায় এক নির্মম ও লজ্জাজনক ঘটনা ঘটে। মাত্র তিন বছরের একটি নিষ্পাপ শিশু তারই আপন দাদুর দ্বারা পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়। অভিযুক্ত সুবাস কুমার চাকমা (৬০) শিশুটিকে ঘরে একা পেয়ে জঘন্য লালসার শিকার বানায়।

ঘটনাটি জানাজানি হলে স্থানীয়দের মধ্যে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয় এবং দ্রুত সুবাস কুমারকে পুলিশে সোপর্দ করা হয়। রাঙামাটি কোতোয়ালী থানার পুলিশ তাকে দুপুরের মধ্যেই গ্রেপ্তার করে। শিশুটির মা জানান, তার শ্বশুর দীর্ঘদিন ধরে মদ্যপ অবস্থায় থাকেন এবং অসংলগ্ন আচরণ করেন। তিনি চরম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “আমি আমার সন্তানের জন্য ন্যায়বিচার চাই। কিন্তু কেউ কি আমার পক্ষে দাঁড়াবে?”

এদিকে, রাঙামাটি সদর হাসপাতালের চিকিৎসকরা নিশ্চিত করেন, শিশুটির শরীরে গুরুতর ক্ষতচিহ্ন রয়েছে, এবং যৌন নিপীড়নের সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে। শিশুটি বর্তমানে গুরুতর মানসিক আঘাত নিয়ে চিকিৎসাধীন রয়েছে।

কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, এত ভয়াবহ একটি অপরাধ সংঘটিত হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামের তথাকথিত ‘মানবাধিকার সংগঠনগুলো’ নীরব রয়েছে। উপজাতীয় রাজনৈতিক দল, ছাত্র সংগঠন বা স্বঘোষিত মানবাধিকার কর্মীদের কেউই এ নিয়ে কোনো প্রতিবাদ করেনি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও উপজাতীয় সমাজের কোনো ক্ষোভ বা প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি।

প্রশ্ন জাগে—কেন?

উত্তর সহজ—যেহেতু অপরাধী একজন উপজাতীয় ব্যক্তি, তাই বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়া হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে দীর্ঘদিন ধরেই উপজাতীয় সংগঠনগুলোর ‘অপরাধী রক্ষার’ এই প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। তারা কেবল তখনই সরব হয়, যখন অপরাধী একজন বাঙালি হয়। কিন্তু নিজ সম্প্রদায়ের কেউ ধর্ষণের মতো অপরাধ করলেও তারা নির্বিকার, নীরব এবং দায়িত্ব এড়িয়ে চলে।

বান্দরবানে ধর্ষণের অভিযোগ: ন্যায়বিচার নয়, প্রতিশোধের প্রতিচিত্র

একদিন আগে, ১০ মার্চ সন্ধ্যা ৭টা, বান্দরবানের রোয়াংছড়ি উপজেলার খামতাম পাড়ায় আরেকটি ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। কিন্তু এখানে চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন।

অভিযুক্ত ব্যক্তি মো. জামাল হোসেন, যিনি স্থানীয় একজন নির্মাণ শ্রমিক। অভিযোগ ওঠে, তিনি এক মানসিক ভারসাম্যহীন খিয়াং তরুণীকে ধর্ষণ করেছেন। তবে স্থানীয়দের বক্তব্য অনুযায়ী, ভুক্তভোগী তরুণী মানসিকভাবে সুস্থ ছিলেন না, তার শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি, এবং অভিযোগটি সন্দেহজনক বলে মনে হচ্ছে।

পরদিন, আজ ১১ মার্চ সকাল ১১টা, উপজাতীয় তরুণদের একটি উগ্র গোষ্ঠী জামাল হোসেনকে আটক করে। কিন্তু তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার পরিবর্তে প্রকাশ্যে গলায় জুতার মালা পরিয়ে চরমভাবে লাঞ্ছিত করা হয়। ব্যাপক মারধরের অভিযোগ উঠে। শুধুমাত্র একটি অভিযোগের ভিত্তিতে বিনা বিচারে এক ব্যক্তিকে অপমান করা হয় এবং তার এই দুর্দশার ভিডিও ধারণ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। মুহূর্তের মধ্যে এটি ভাইরাল হয়ে যায় এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় সমাজ এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ব্যাপক উস্কানি সৃষ্টি করতে থাকে। স্থানীয় সামাজিক ব্যক্তিরা প্রথাগত নিয়ম অনুযায়ী বিষয়টি মিমাংসা করে দেন। মেয়েটির ভাই থানায় অভিযোগ করবে না বলে লিখিতভাবে জানান। তারপরও পুলিশ ৫৪ ধারায় গ্রেফতার দেখিয়েছে।

এই ঘটনার পরপরই বিভিন্ন উপজাতীয় সংগঠন বিক্ষোভ মিছিল বের করে, প্রতিবাদ করে, সোশ্যাল মিডিয়ায় বাঙালির চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করে এবং বাঙালি শ্রমিকদের পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে উচ্ছেদের দাবি জানায়।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, এখনও পর্যন্ত কোনো মেডিকেল রিপোর্ট প্রকাশিত হয়নি। ধর্ষণের সত্যতা নিশ্চিত হওয়ার আগেই কীভাবে একজনকে ‘অপরাধী’ সাব্যস্ত করা হলো? মেয়েটির ভাইয়ের জবানবন্দি তার বোন ধর্ষিত হয়নি।

এটাই পার্বত্য চট্টগ্রামের বাস্তবতা। এখানে বিচারব্যবস্থা নয়, বরং জাতিগত বিদ্বেষই অপরাধের শাস্তি নির্ধারণ করে।

জাতিগত পক্ষপাত: বিচার নাকি প্রতিহিংসা?

এই দুটি ঘটনা পাশাপাশি রাখলে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিচারের নামে চলমান জাতিগত বৈষম্যের নগ্ন রূপ ফুটে ওঠে। যদি ধর্ষক উপজাতীয় হয় কোনো প্রতিবাদ নেই, বরং ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চলে।
যদি ধর্ষক বাঙালি হয় প্রতিবাদ, লাঞ্ছনা, রাজনৈতিক প্রচারণা, এবং পুরো জাতির বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়ানো হয়।

এই বিচারহীনতা কেবল একটি সম্প্রদায়কে রক্ষা করার জন্যই নয়, বরং পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতীয় আধিপত্য বজায় রাখার জন্য একটি কৌশলমাত্র। বাঙালিদের প্রতি এই বৈষম্যমূলক আচরণ শুধুমাত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী রাজনীতিরই অংশ নয়, এটি একটি সুপরিকল্পিত ‘বাঙালি বিতাড়নের’ নীতি।

প্রশ্ন হচ্ছে, পার্বত্য চট্টগ্রামে কি আইন সবার জন্য সমান? নাকি এটি ক্ষমতাধর গোষ্ঠীর জন্য একটি সুবিধাজনক হাতিয়ার মাত্র?

যদি ধর্ষণের শিকার শিশুর পরিচয় বিচার ব্যবস্থার জন্য গুরুত্বপূর্ণ না হয়, তবে অপরাধীর পরিচয় কেন এত গুরুত্বপূর্ণ? কেন একজন উপজাতীয় অপরাধী দোষী প্রমাণিত হয়েও রেহাই পায়, অথচ একজন বাঙালি শুধুমাত্র সন্দেহের বশে চরম লাঞ্ছনার শিকার হয়? পার্বত্য চট্টগ্রামে এমন অনেক ঘটনা আছে।

এই প্রশ্নগুলোর উত্তর সহজ—পার্বত্য চট্টগ্রামে ‘ন্যায়বিচার’ কেবলমাত্র একটি পক্ষের জন্য বরাদ্দ, অন্যদের জন্য নয়। এখানে অপরাধের বিচার হয় না, হয় প্রতিহিংসার শাসন।

 

আগের পোস্টরাঙামাটিতে চার রাজনৈতিক দলের ঐক্য।
পরের পোস্টমাহে রমজান উপলক্ষে লংগদু জোন কর্তৃক ইফতার সামগ্রী বিতরণ ও আর্থিক সহায়তা প্রদান।

রিপ্লাই দিন

আপনার কমেন্ট লিখুন
আপনার নাম লিখুন