হান্নান সরকার | হিলনিউজবিডি
পার্বত্য বান্দরবান জেলার রোয়াংছড়ি উপজেলার খামতাম পাড়ায় সম্প্রতি একটি বিতর্কিত ঘটনার সূত্র ধরে সেনাবাহিনীকে জড়িয়ে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। কথিত ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগে স্থানীয় এক নির্মাণ শ্রমিককে প্রথাগত সামাজিক শাস্তির আওতায় আনার পরও, ঘটনাটিকে নতুনভাবে সামনে এনে সেনাবাহিনীকে বিতর্কিত করার অপকৌশল চালাচ্ছে কিছু স্বার্থান্বেষী মহল।
ঘটনার সূত্রপাত ১০ মার্চ সন্ধ্যায়, যখন অভিযোগ ওঠে যে মো. জামাল হোসেন নামের এক নির্মাণ শ্রমিক মানসিক ভারসাম্যহীন এক খিয়াং তরুণীকে ধর্ষণের চেষ্টা করেছেন। তবে স্থানীয়দের মতে, এই অভিযোগ সন্দেহজনক, কারণ তরুণীর শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি, এবং তার মানসিক অসুস্থতার কারণে ঘটনার সত্যতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। অভিযোগ অনুযায়ী, জামাল হোসেন তরুণীকে নির্জন স্থানে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন, কিন্তু এলাকাবাসী তৎক্ষণাৎ সেখানে উপস্থিত হয়ে মেয়েটিকে উদ্ধার করেন এবং অভিযুক্ত ব্যক্তি পালিয়ে যান।
পরদিন ১১ মার্চ সকালে স্থানীয় জনগণ জামাল হোসেনকে আটক করে, মাথার চুল কেটে, গলায় জুতার মালা পরিয়ে গ্রাম ঘোরানোর শাস্তি দেয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় সমাজে প্রচলিত বিচার ব্যবস্থার আওতায়, এমন ঘটনাগুলোর নিষ্পত্তি সামাজিকভাবে কার্বারী এবং স্থানীয় নেতাদের মাধ্যমে করা হয়। এই ঘটনায়ও সেই রীতির ব্যত্যয় ঘটেনি।
স্থানীয় হেডম্যান ও কার্বারীদের উপস্থিতিতে কথিত অপরাধী জামাল হোসেনকে প্রকাশ্যে শাস্তি দেওয়া হয়। উপস্থিত ব্যক্তিরা ছিলেন: ১. পাইশৈ খিয়াং (কার্বারী), ২. পাইন্য খিয়াং (VDP কমান্ডার), ৩. রতন খিয়াং (শিক্ষক), ৪. থোয়াইমং প্রু খিয়াং (কার্বারী), ৫. শোকক্রাং খিয়াং (কার্বারী), ৬. কেরি খিয়াং (সমাজসেবক), ৭. থুইসা খিয়াং (ছাত্র সমাজ প্রতিনিধি)
এছাড়া, মেয়েটির ভাই রেভন খিয়াং রোয়াংছড়ি থানাকে নিজেই লিখিতভাবে জানান যে, তার বোন ধর্ষিত হয়নি এবং পরিবার এই ঘটনা নিয়ে আর কোনো আইনি ব্যবস্থা নিতে চায় না। সমাজের প্রচলিত বিধি অনুযায়ী এই বিচার সম্পন্ন হয়েছে, এবং ঘটনাটি এখানেই নিষ্পত্তি হয়েছে। কিন্তু পুলিশ আইনগত ব্যবস্থা নিয়েছে।
সেনাবাহিনীকে জড়িয়ে অপপ্রচার কেন? অবশ্য, এখানেই বিষয়টি শেষ হয়নি। উপজাতীয় সন্ত্রাসী সংগঠন কেএনএফ (KNF), জেএসএস (JSS), এবং ইউপিডিএফ (UPDF)-এর সহযোগী সংগঠনগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারণা চালাচ্ছে যে সেনাবাহিনীর চাপে বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে। তারা দাবি করছে, রোয়াংছড়ি খামতাম পাড়া ক্যাম্পের কমান্ডার মো. সারোয়ার এই ঘটনার নিষ্পত্তিতে ভূমিকা রেখেছেন এবং ভুক্তভোগী পরিবারকে অভিযোগ প্রত্যাহার করতে বাধ্য করেছেন।
তবে বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে এই অপপ্রচার চালানোর মূল কারণ হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামে সন্ত্রাসী কার্যকলাপের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ। সেনাবাহিনী বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলোর অস্ত্র ব্যবসা, চাঁদাবাজি এবং অপহরণ বন্ধে কঠোর ভূমিকা পালন করছে। ফলে, সেনাবাহিনীকে বিতর্কিত করতে ষড়যন্ত্রকারীরা বারবার মিথ্যা অভিযোগের আশ্রয় নিচ্ছে।
পরিকল্পিত মিথ্যাচার ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি: উপজাতীয় সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর দীর্ঘদিনের কৌশল হলো, পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালিদের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব তৈরি করা এবং সেনাবাহিনীকে জনসমর্থনহীন করার চেষ্টা চালানো। এই ঘটনার ক্ষেত্রেও সেটাই হয়েছে।
প্রথমে ঘটনাটিকে ধর্ষণের ঘটনা বলে চালানোর চেষ্টা করা হয়। কিন্তু প্রমাণের অভাবে, সেটি ধোপে টেকেনি। এরপর ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগ আনা হয় এবং স্থানীয়ভাবে এর নিষ্পত্তি করা হয়। তাতেও যখন বিষয়টি আর আলোচনায় থাকছে না, তখন নতুন গল্প তৈরি করে বলা হচ্ছে যে সেনাবাহিনীর চাপে সমঝোতা করা হয়েছে।
যদি সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ থাকত, তাহলে স্থানীয় নেতারা প্রকাশ্যে বিচারের আয়োজন করতে পারতেন না। বরং সেনাবাহিনী এই ধরনের সামাজিক বিচার ব্যবস্থায় কোনোভাবেই হস্তক্ষেপ করেনি।
উপজাতীয় সমাজের দ্বৈত নীতি: পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় সমাজে ধর্ষণের শাস্তি হিসেবে সাধারণত একটি শুকুর দান বা ২০ হাজার টাকা জরিমানা নির্ধারণ করা হয়। কখনো কখনো এ নিয়ে কোনো আপত্তি ওঠে না, কারণ এটি তাদের রীতি অনুযায়ী বৈধ।
কিন্তু যখন অভিযুক্ত ব্যক্তি বাঙালি হয়, তখন বিষয়টিকে ইস্যু বানানো হয় এবং রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে মিথ্যাচার চালানো হয়। ধর্ষণের শাস্তি যদি উপজাতীয় বিচারব্যবস্থা অনুযায়ী হয়ে থাকে, তবে হঠাৎ কেন সেনাবাহিনীকে দোষারোপ করা হলো? কেন শুধু এই ঘটনাতেই সেনাবাহিনীর “চাপ” খোঁজা হচ্ছে?
সত্য উন্মোচনের প্রয়োজন: সেনাবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করছে, অথচ KNF, JSS, এবং UPDF-এর মতো সংগঠনগুলো তাদের বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে অপপ্রচার চালাচ্ছে।
এই ঘটনার মাধ্যমে যে বিষয়গুলো স্পষ্ট হলো: ১. কথিত ধর্ষণের অভিযোগ ছিল সন্দেহজনক। ২. স্থানীয়ভাবে প্রচলিত রীতি অনুযায়ী বিচার সম্পন্ন হয়েছে। ৩. মেয়েটির পরিবার নিজেরাই বিষয়টি এখানেই নিষ্পত্তি করেছে। ৪. ইতোমধ্যে পুলিশ ৫৪ ধারায় গ্রেফতার দেখিয়েছে। ৫. সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অপপ্রচার একটি পূর্বপরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের অংশ।
এখন সময় এসেছে, এসব ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সরব হওয়ার। পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়ন, শান্তি এবং স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে হলে, এই ধরনের মিথ্যাচার ও বিভ্রান্তি ছড়ানোর অপচেষ্টা প্রতিহত করতে হবে।