বিষবৃক্ষের অঙ্কুর: নারী হত্যাকাণ্ড ও একপাক্ষিক জাতিগত অপপ্রচারের দুর্বিষহ পরিণতি।

0

অনন্ত অসীম 

পাহাড় এক অনন্য বৈচিত্র্যের ভূখণ্ড, যেখানে জাতিগত সহাবস্থান কল্পনা করলেও, বাস্তবতা কখনো কখনো রক্তাক্ত ও মিথ্যা ভরা। বান্দরবান জেলার থানচির দুর্গম মংখয় পাড়ায় গত ৫ মে ২০২৫ খ্রি. সংঘটিত এক নারকীয় ঘটনার জের ধরে সম্প্রদায়গত বিভাজনের চিত্র যেন আরও প্রকট হয়ে উঠেছে। চিংমা খিয়াং নামের খেয়াং উপজাতি নারীর লাশ উদ্ধারের পরিপ্রেক্ষিতে জেএসএস ও ইউপিডিএফ সংশ্লিষ্ট অঙ্গসংগঠনসমূহের তাৎক্ষণিক একতরফা বাঙালি দোষারোপমূলক বিবৃতি, শুধু তদন্তের গতিকে বিভ্রান্ত করেনি; বরং তা এক প্রকার অনভিপ্রেত সম্প্রদায়গত প্ররোচনা রূপে প্রতিভাত হয়েছে।

ঘটনার বিস্তার বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, চিংমা খিয়াং (২৮), স্বামী সুমন খিয়াং, প্রতিদিনের ন্যায় নিজ জুমক্ষেতে গমন করেন এবং নির্ধারিত সময়ে গৃহে প্রত্যাবর্তন না করায় পরিবারের উদ্বেগ চরমে পৌঁছে। সন্ধানকালে তাঁর মৃতদেহ নিকটবর্তী জঙ্গলে, মুখমণ্ডলে ও মস্তকে আঘাতের চিহ্নযুক্ত অবস্থায় আবিষ্কৃত হয়। পুলিশ প্রশাসন, জেলা প্রশাসন এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধি সকলে সমন্বিতভাবে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে, মৃতদেহের সুরতহাল সম্পন্ন করে এবং ময়নাতদন্তের জন্য প্রেরণ করে।

উপজাতি সংগঠনের প্রাথমিক বিবৃতি: অগ্রপন্থী ও প্ররোচনামূলক?

সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জেএসএস-এর সহযোগী সংগঠন পিসিপি ও এইচডব্লিউএফ ৫ মে রাতেই এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে অভিযোগ করেন যে, তিন বাঙালি সড়ক শ্রমিক কর্তৃক ভিকটিমকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা ঘটেছে। তাদের দাবির ভিত্তি হলো, ভিকটিম পূর্বদিন উক্ত শ্রমিকদের দেখে আতঙ্কিত হয়ে বাড়িতে ফিরে আসেন, এবং মৃত্যুর দিনেও তারা ‘ঔৎপেতে’ ছিলেন। এটি একটি নির্মম অপদহ্নব (যাহা আছে তাহা নাই বলিয়া গোপন বা অস্বীকার) প্রক্রিয়ার সূচনাবিন্দু—যেখানে প্রমাণপূর্বক দায় নির্ধারণের পূর্বে জাতিগোষ্ঠী নির্ভর দায় চাপানো হয়। একই অভিযোগ করেন, ইউপিডিএফ সহযোগী সংগঠন পিসিপি ও এইচডব্লিউএফ। কেএনএফ ও মগ পার্টিসহ উপজাতি সব সংগঠন সম্প্রদায়গত প্ররোচনা রূপে প্রতিভাত হয়েছে। সম্মিলিতভাবে পাহাড় থেকে সমতল পর্যন্ত এই নিয়ে চলছে বাঙালি বিরোধী প্রতিবাদ সমাবেশ।

জানা গেছে, ইতোমধ্যেই প্রাথমিক অনুসন্ধান ও পুলিশি সুরতহাল প্রতিবেদন অনুযায়ী ধর্ষণের কোনো প্রত্যক্ষ আলামত উদ্ঘাটিত হয়নি। তথাপি, কতিপয় পাহাড়ি সংগঠন একতরফা প্রচারণার মাধ্যমে ধর্ষণপূর্বক হত্যার বাঙালিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করিলেও সচেতন মহলের অভিমত, উক্ত দাবির অন্তরালে বিশেষ রাজনৈতিক অভিসন্ধি নিহিত রয়েছে।

একতরফা অভিযুক্তকরণ, যা বিচারহীনতার এক ধরণের অজ্ঞাতবিনাশী প্রবণতা, সেখানে জাতিগত বৈরিতা ছড়ানো এবং সহাবস্থান বিনাশের রূঢ় কৌশল হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। পার্বত্যে বহু ঘটনার পর্যালোচনায় দেখা যায়, কোনো অপরাধ সংঘটনের পূর্বে কিংবা ঘটনার প্রকৃত তথ্য উদ্ঘাটনের পূর্বেই “বাঙালি দায়ী” — এই ধ্বনি যেন একটি রাজনৈতিক অভিসন্ধিমূলক প্রতিধ্বনি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

থানচির যে প্রান্তিক অঞ্চলটিতে এ নৃশংস হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে, সেটি অতিকঠিন ভূপ্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতায় ঘেরা এবং সেখানে পাহাড়িদের আবাস থাকলেও বাঙালি বসতির অস্তিত্ব নেই। এই পরিপ্রেক্ষিতে সড়ক নির্মাণকাজে নিয়োজিত বাঙালি শ্রমিকদের উপর দায় চাপিয়ে পরিকল্পিতভাবে উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে বিঘ্নিত করার অপপ্রয়াস চলছে কি না, তা গভীর অনুসন্ধানের দাবি রাখে।

এই বিষয়ে প্রশাসন কী বলছেন?

বান্দরবান জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন পৃথকভাবে যে প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে, তা নিঃসন্দেহে একটি স্বচ্ছতা প্রদর্শনের প্রয়াস। জেলা প্রশাসক শামীম আরা রিনি বিবৃতিতে কোনো গোষ্ঠীকে দায়ী না করে, এতে নারীটির মৃত্যুকে “অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা” হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে এবং এর প্রকৃত কারণ অনুসন্ধানে তদন্ত চলমান আছে বলে জানানো হয়েছে। প্রশাসন তদন্তের উপর জোর দিয়ে ঘটনার ‘হত্যা নাকি দুর্ঘটনা’ — তা এখনো নিশ্চিত নয় বলেই ইঙ্গিত দিয়েছে।

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবদুল করিমে বিবৃতিতে বলেছেন, ৫ মে ২০২৫ তারিখ সকাল ৭টা থেকে বিকেল ৩:৩০-এর মধ্যে থানচির ২ নম্বর তিন্দু ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের নেপিউ পাড়ার কাছে, থোয়াইউখই খিয়াং এর জুম চাষের সীমার কাছে পাথরের নালায় এক নারীর রক্তাক্ত মৃতদেহ পাওয়া যায়। মৃত নারীটির নাম চিংস্থা খিয়াং, স্বামী সুমন খিয়াং। তিনি সকাল ৭টার দিকে বাড়ি থেকে জুমে যান এবং দুপুরে না ফেরায় সন্ধান শুরু হয়। বিকেল ৩:৩০-এর দিকে তার মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়, মাথা ও মুখমণ্ডলে আঘাতের চিহ্ন ছিল। পুলিশ তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনাস্থলে পৌঁছে, ইউপি চেয়ারম্যানও উপস্থিত ছিলেন। পুলিশ মৃতদেহ থানচি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। পরবর্তীতে মৃতদেহ সদর হাসপাতালে ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হয়।

পুলিশ তদন্তে গুরুত্ব দিচ্ছে এবং আইনগত কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। সবাইকে তদন্তে সহযোগিতার আহ্বান জানানো হয়েছে। তবুও পাহাড়ি সংগঠনগুলোর প্রাথমিক উত্তেজনাপূর্ণ প্রতিক্রিয়া প্রশাসনের এ নিরপেক্ষতা নস্যাৎ করতে তৎপর বলে অনেকে মত দিয়েছেন।

মিডিয়া ও সোশ্যাল প্রচারণা: রাজনৈতিক মদতপুষ্ট অপপ্রচার?

ঘটনার তদন্ত চলমান থাকা সত্ত্বেও পাহাড়ি সংগঠন, ব্লগার ও একাংশ মিডিয়া যে পরিমাণে ঘটনাটিকে বাঙালি বিরোধী “সাংঘাতিক ধর্ষণ ও হত্যার” আখ্যা দিয়ে প্রচার করছে, তা এক প্রকার অভিরোষ বা অভিমানজনিত ক্রোধ থেকে উৎসারিত প্রতিশোধপরায়ণ মনোভাবকেই নির্দেশ করে। এই প্রকার অসমীক্ষ্যভাষী প্রচারণা, জাতিগোষ্ঠীগত সাম্য ও সম্প্রীতির ভিত্তিকে কেবলই ভঙ্গুর করে না; বরং পার্বত্যকে আরও দ্বন্দ্বপ্রবণ ও বিষাক্ত বিদ্বেষের ভুবনে রূপান্তরিত করে।

একটি নারী হত্যাকাণ্ড নিশ্চয়ই একটি শোকাবহ ও গর্হিত ঘটনা। তবে, অপরাধী কে, তা নির্ধারণ না করেই জাতিগোষ্ঠীভিত্তিক দোষারোপ করা একটি চরম অমর্ষণীয় কর্ম। এমনকি যদি ভবিষ্যতে তদন্তে সত্যিই অভিযুক্ত শ্রমিকদের সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হয়, তবুও প্রক্রিয়ার বাইরে গিয়ে উত্তেজনা সৃষ্টিমূলক একতরফা প্রচারণা কখনোই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

জাতিগত সম্প্রীতির সংকট: বিচার নয়, বিভাজনের আকাঙ্ক্ষা?

পাহাড়ে ঘটিত প্রতিটি ঘটনার প্রেক্ষাপটে যে প্রবণতা ক্রমাগত প্রকট হচ্ছে, তা হলো—অধিবেত্তা গোষ্ঠী কর্তৃক অপরকে দোষী সাব্যস্ত করে রাজনৈতিক ফায়দা লোটা। পার্বত্য চট্টগ্রামে যেখানে একপাক্ষিক সত্য চাপিয়ে দেওয়া হয়, সেখানে প্রকৃত অপরাধীকে চিহ্নিত করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায় এবং বিচারের ধারাটি হয়ে পড়ে অনিশ্চিত।

এমন প্রেক্ষাপটে স্থানীয় বাঙালি, উপজাতি ও সাধারণ সচেতন নাগরিকেরা মনে করছেন, তদন্ত ও বিচারের পূর্বে এ ধরনের জাতিগত বিভাজনমূলক প্রচারণা বন্ধ করতে হবে। অপরাধী যে-ই হোক, তার বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি এক সর্বজনীন ন্যায্যতা। কিন্তু সেটি সত্যানুসন্ধান ও প্রমাণনির্ভর বিচারপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে হতে হবে, অনভিপ্রেত হিংসাশ্রয়ী দাবিতে নয়।

সম্প্রীতির সংকট ও প্রত্যাবর্তনের আহ্বান:

চিংমা খিয়াং হত্যাকাণ্ড নিঃসন্দেহে একটি দুঃসহ মানবিক বিপর্যয়। কিন্তু সেই ঘটনায় অপরাধী কে, তা এখনো অনুসন্ধানাধীন রহস্য। এই মুহূর্তে প্রয়োজন বিচারপন্থা অনুসারী ধৈর্য, সহনশীলতা ও সুবিবেচনা। প্রত্যেক নাগরিকের উচিত হবে তদন্তের অগ্রগতি পর্যন্ত অপেক্ষা করা এবং কোনো সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আগাম বিষোদ্গার না করা। বাঙালি শ্রমিক হোক কিংবা স্বগোত্রীয় কেউ—অপরাধী যেই হোক, তাকে বিচারের আওতায় আনতে হবে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম যদি সত্যিকার অর্থে অসিচ্যুৎ সম্প্রীতির ভাণ্ডার হয়ে উঠতে চায়, তবে একে রাজনৈতিক, জাতিগত ও সামাজিক হীন উদ্দেশ্য থেকে মুক্ত করতে হবে। অপরাধীকে মানুষ হিসেবে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিষ্ঠা করতে হবে, জাতিসত্তা নয়। তাহলেই এই অঞ্চল হয়ে উঠবে সত্যিকারের অঙ্গসৌষ্ঠবমণ্ডিত শান্তি, সম্প্রীতি ও সহাবস্থানের প্রাঙ্গণ।

 

আগের পোস্টপিসিসিপি’র উদ্যােগে আব্দুর রশিদ সরকারের ৩৬ তম মৃত্যু বার্ষিকী পালন।
পরের পোস্টপাহাড় নিয়ে ষড়যন্ত্র প্রতিরোধে সচেতনতামূলক লিফলেট বিতরণ পিসিসিপি’র

রিপ্লাই দিন

আপনার কমেন্ট লিখুন
আপনার নাম লিখুন