ইউপিডিএফ-এর উত্থান ও রাষ্ট্রীয় নিষ্ক্রিয়তার পরিণাম।

0

হান্নান সরকার

স্বাধীনতা-উত্তর রাষ্ট্রকাঠামোর সীমাবদ্ধতা, প্রশাসনিক উদাসীনতা, এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে অবহেলিত বাঙালি জনগোষ্ঠীর নেতৃত্বশূন্যতা—এই ত্রিশূলের আঘাতে আজ ইউপিডিএফ এক ভয়ঙ্কর পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। ১৯৯৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর স্বায়ত্তশাসনের অন্তরালে গঠিত এই সংগঠন পার্বত্য চুক্তি বিরোধিতা করে একটি বৃহত্তর ষড়যন্ত্রে প্রবৃত্ত হয়—যার উদ্দেশ্য রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতায় চিড় ধরানো।

বাংলাদেশের সংবিধান যেখানে এককেন্দ্রিক ও অভিন্ন রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছে, সেখানে ইউপিডিএফ কর্তৃক তথাকথিত স্বায়ত্তশাসনের দাবি একপ্রকার পরোক্ষ বিচ্ছিন্নতাবাদ (Sparatism) রূপে আত্মপ্রকাশ করেছে। পার্বত্য চুক্তি উপজাতীয় জনগণের অধিকার ও মর্যাদা সুনিশ্চিত করলেও, ইউপিডিএফের বিরোধিতা এবং অস্ত্রের মাধ্যমে চাঁদাবাজি, অপহরণ, খুন, গুম ও সেনা প্রত্যাহারের দাবি নিঃসন্দেহে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের প্রতিপক্ষে দাঁড়িয়েছে।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গত ১০ মে ২০২৫ ইউপিডিএফ-এর সঙ্গে বৈঠক করেছে। অথচ এই সংগঠন কোনো নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল নয়, বরং একটি সংঘবদ্ধ সশস্ত্র গোষ্ঠী। তথাপি তাদের ‘সংগঠনিক বলিষ্ঠতা’ এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের অপদহ্নব মানসিকতার ফলে তারা আজ প্রশাসনিক স্বীকৃতির দিকে হাঁটছে। আগামী ১৫ মে আবারও কমিশনের সঙ্গে তাদের বৈঠকের সময়সূচি নির্ধারিত হয়েছে—এটি একটি নৈরাজ্যিক দৃষ্টান্ত। একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের সঙ্গে রাস্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের বৈঠককে স্থানীয় বাঙালি জনগোষ্ঠী দুঃখজনক হিসেবে অভিহিত করেছে।

তবে প্রশ্ন উঠে, পার্বত্য চুক্তিতে উপেক্ষিত ৯ লক্ষাধিক পার্বত্য বাঙালির প্রত্যাশা, অভিযোগ ও প্রাসঙ্গিক অভাব-অভিযোগ শোনার জন্য কমিশন কোনো উদ্যোগ নেয়নি কেন? এর পেছনে রয়েছে, প্রশাসনের অভ্যন্তরে এনজিওপুষ্ট কিছু পক্ষ যাহারা ইউপিডিএফ-এর মতো রাষ্ট্রবিরোধী শক্তিকে উৎসাহিত করছে। পাশাপাশি, বাঙালি নেতৃত্বের অযোগ্যতা কমিশনের কর্ণকুহরে তাদের বক্তব্য প্রবেশ করাতে ব্যর্থ হয়েছে।

যেখানে পার্বত্য বাঙালির বৃহত্তর অংশ জাতীয় রাজনৈতিক স্রোতের অন্তর্ভুক্ত, রাস্ট্রের স্বপক্ষের শক্তি বাঙালিরা অধিকার থেকে বঞ্চিত, এমন প্রেক্ষাপটে পাহাড়ে রাস্ট্রীয় শক্তি নড়বড়ে সেখানে ইউপিডিএফ-এর সঙ্গে কমিশনের ঘনিষ্ঠতা রাষ্ট্রের প্রতি একপ্রকার অভ্যন্তরীণ বিশ্বাসঘাতকতা। ইউপিডিএফ-এর উত্থান রাষ্ট্রযন্ত্রের জন্য ছিলো একটি বহ্নিশিখা, অথচ রাষ্ট্র সেই অগ্নিদ শক্তিকে নির্মূল না করে নিষ্ক্রিয় থেকেছে।

আজ যখন পাহাড় থেকে বাঙালি ও সেনাবাহিনী প্রত্যাহারের দাবি তোলে ইউপিডিএফ, তখন সহজেই অনুধাবনযোগ্য হয় তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য—স্বায়ত্তশাসনের নামে আত্মনিয়ন্ত্রণের ছলে রাষ্ট্রভাগের কূটকৌশল। কমিশনের কিছু সদস্য, যাহারা সুশীলতন্ত্রের আড়ালে উপজাতীয় পক্ষাবলম্বনে লিপ্ত, তারাই আজ ‘আদিবাসী’ শব্দ নিয়ে রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করে, অথচ বাঙালির জন্য ‘উপজাতি’ শব্দ উচ্চারণে তাদের আপত্তি।

এমনকি যারা “স্টুডেন্ট ফর সোভারেন্টি” নামক সংগঠনের পক্ষ থেকে আদিবাসী শব্দের প্রতিবাদ করেছিলো, তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রযন্ত্রের মূর্খ আক্রোশে মামলা দায়ের হয়েছে, এখনো চলমান। অথচ ইউপিডিএফ-এর কার্যক্রম—যার মধ্যে রয়েছে অহরহ রাষ্ট্রদ্রোহিতা, তা বন্ধ করতে প্রশাসনের দৃষ্টিকোণ আজও স্ফুট নয়।

অপ্রিয় হলেও সত্য—ইউপিডিএফ ১৯৯৮ সালেই স্বায়ত্তশাসনের দাবি তুলে যাত্রা শুরু করে, রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সুযোগে ১০ মে স্বায়ত্তশাসনের দাবি ও বিভিন্ন দাবি ইউপিডিএফ সংস্কার কমিশনে লিখিতভাবে জমা দিয়েছে। তাদের এই দাবি যে রাস্ট্রের জন্য ক্ষতির ছিল, তা আমরা হাতেগোনা কয়জন অনেক আগেই অনুধাবন করেছি কিন্তু বেশিভাগই ছিল উদাসীন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এতবছর সবাই কোথায় ছিল?

ইউপিডিএফ-কে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে সমালোচনা করলে তার সীমা নেই; তবে নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে বলা যায়—তারা আজ যে অবস্থানে পৌঁছেছে, তা সম্পূর্ণ তাদের ধারাবাহিক প্রচেষ্টা ও কৌশলগত সাফল্যের ফল। ইউপিডিএফ-এর অন্যতম সফলতা হলো—তারা তাদের সাংগঠনিক অবস্থান এমনভাবে সুদৃঢ় করতে পেরেছে, যার ফলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনকেও তাদের কথা শুনতে বাধ্য হতে হয়েছে। অপরদিকে, পার্বত্য বাঙালিদের নেতৃত্বে অনৈক্য, দলাদলি এবং জাতীয় রাজনৈতিক দলের সঙ্গে অতিরিক্ত সম্পৃক্ততার ফলে তারা নিজেদের ন্যায্য অধিকার থেকে ক্রমেই বিচ্যুত হয়েছে। এই সুযোগে রাষ্ট্র, প্রশাসন বরাবরই পার্বত্য বাঙালিদের প্রতি অসৌজন্যমূলক ও বিমাতৃসুলভ আচরণ করে এসেছে। যার প্রত্যক্ষ ফলস্বরূপ—পাহাড়ে বাঙালিদের রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তি আজ মেরুদণ্ডহীন হয়ে পড়েছে।

শেষকথা এই, রাষ্ট্র যদি অবিলম্বে ইউপিডিএফ-এর কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা না করে, এবং তাদের অঘোষিত যুদ্ধনীতি ও বাঙালি বিদ্বেষী প্ররোচনাকে রুদ্ধ না করে—তবে অনাগত সময় রাষ্ট্রকে পার্বত্য চট্টগ্রামে চরম সংকটাপন্ন পরিস্থিতির সম্মুখীন করবে। যাহারা ইউপিডিএফ-এর অস্ত্র, রণকৌশল এবং গত দুই দশকের কার্যক্রম প্রত্যক্ষ করেছেন, তারা নিশ্চয়ই উপলব্ধি করতে সক্ষম—এই সংগঠন পাহাড় থেকে বাঙালি ও সেনাবাহিনী প্রত্যাহার চায় শুধু একটি কারণেই—এটি একটি সুপরিকল্পিত রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র।

 

 

আগের পোস্টরাঙামাটিতে রাবি-প্রবি’র ভবন নির্মাণে পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের কোটি টাকা চাঁদা দাবি!
পরের পোস্টপাহাড়কে বিছিন্ন করার ষড়যন্ত্র করায় ইউপিডিএফকে নিষিদ্ধের দাবিতে পিসিসিপি’র বিক্ষোভ।

রিপ্লাই দিন

আপনার কমেন্ট লিখুন
আপনার নাম লিখুন