পার্বত্য চট্টগ্রামে আঞ্চলিক দলগুলো গঠন এবং তাদের কার্যক্রম।

0

হান্নান সরকার 

পার্বত্য চট্টগ্রাম, বাংলাদেশের একটি নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য কিন্তু জটিল ভূ-রাজনৈতিক অঞ্চল, যেখানে পাহাড়, জঙ্গল, আর বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীর মাঝে ইতিহাস, সংস্কৃতি, এবং রাজনীতির এক অনন্য মিশ্রণ রয়েছে। এই অঞ্চলের আঞ্চলিক দলগুলো, যারা বিভিন্ন সময়ে গঠিত হয়েছে, তাদের কার্যক্রম এবং উদ্দেশ্য পার্বত্য চট্টগ্রামের সামাজিক ও রাজনৈতিক গতিশীলতার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই দলগুলো স্বায়ত্তশাসন, জাতিগত স্বীকৃতি, এবং নিজস্ব সংস্কৃতি ও অধিকার রক্ষার দাবিতে গঠিত হলেও, তাদের কার্যক্রম প্রায়ই বিতর্কিত এবং রাষ্ট্রবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। নিম্নে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রধান আঞ্চলিক দলগুলোর গঠন, উদ্দেশ্য, কার্যক্রম, এবং বিতর্কিত দিকগুলো বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হলো।

১. পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) এবং শান্তিবাহিনী:

গঠন ও ইতিহাস: পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) ১৯৭২ সালের ৭ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠিত হয়। এর প্রতিষ্ঠাতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ও বীরেন্দ্র কিশোর রোয়াজা। লারমার যিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের নানিয়ারচরের বাসিন্দা ছিলেন। জেএসএস-এর সশস্ত্র শাখা শান্তিবাহিনী ১৯৭৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি গঠিত হয়।

উদ্দেশ্য: জেএসএস-এর প্রধান লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের সংবিধানে বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রাধান্য অপসারণ এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী জনগোষ্ঠীকে ‘উপজাতি’ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের মাধ্যমে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা। তারা পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, এবং রাজনৈতিক অধিকার রক্ষার জন্য সংগ্রামের ডাক দেয়।

কার্যক্রম ও বিতর্ক: জেএসএস এবং শান্তিবাহিনী শুরুতে আঞ্চলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য গঠিত হলেও, তাদের কার্যক্রম দ্রুত রাষ্ট্রবিরোধী এবং সশস্ত্র সংগ্রামের দিকে মোড় নেয়। কিছু উল্লেখযোগ্য বিতর্কিত ঘটনার মধ্যে রয়েছে:

১৯৭৫ সালে খিরাম বন বিভাগে হামলা: এই হামলায় শান্তিবাহিনী ৫ জন বনকর্মীকে হত্যা করে।
১৯৭৭ সালে সাঙ্গু নদীতে সেনা টহলের উপর হামলা: এতে কাদেরসহ ৫ জন নিহত হয়।
১৯৭৯ সালে পুনর্বাসিত বাঙালি ও নিরাপত্তা বাহিনীর উপর হামলা: এই সময়ে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হয়, যা বাঙালি ও আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে উত্তেজনা বাড়ায়।

১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর জেএসএস সরকারের সঙ্গে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করে, যা পার্বত্য চট্টগ্রামের দীর্ঘদিনের সংঘাতের অবসান ঘটায়। তবে, এই চুক্তি সবাইকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। জেএসএস-এর একটি অংশ চুক্তির বিরোধিতা করে বিদ্রোহ করে এবং নতুন সংগঠন গঠন করে।

(ক) পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি) ১৯৮৯ সালের ২০ মে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) সহযোগী ছাত্র সংগঠন হিসেবে কাজ করে। পিসিপি প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর শিক্ষা, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করা। সংগঠনটি বিশেষ করে পাহাড়ি ছাত্র-যুবকদের সংগঠিত করে তাদের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে সোচ্চার ভূমিকা পালন করে।

প্রতিষ্ঠার পটভূমি ও প্রেক্ষাপট:
১৯৮০-এর দশকে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর অধিকার নিয়ে উত্তেজনা ও সংঘাত চলছিল। জেএসএস এই অঞ্চলের জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য রাজনৈতিক ও সশস্ত্র আন্দোলন পরিচালনা করছিল। এই প্রেক্ষাপটে ছাত্র ও যুব সমাজকে সংগঠিত করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। পিসিপি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ছাত্রদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি, শিক্ষার সুযোগ বাড়ানো এবং পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্য নেওয়া হয়।

প্রতিষ্ঠার বিষয়ে বিস্তারিত তারিখ ও স্থান: পিসিপি আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৮৯ সালের ২০ মে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয়। ঢাকা বেছে নেওয়ার কারণ ছিল এটি দেশের রাজধানী এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু, যা সংগঠনের কার্যক্রমকে জাতীয় পর্যায়ে তুলে ধরতে সহায়ক ছিল।
প্রতিষ্ঠাতা ও নেতৃত্ব: পিসিপি প্রতিষ্ঠার পেছনে জেএসএস-এর নেতৃত্ব এবং তাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছাত্রনেতারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তবে নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠাতাদের নাম সাধারণত প্রকাশ্যে কম উল্লেখ করা হয়, কারণ সংগঠনটি জেএসএস-এর ছাত্র শাখা হিসেবে কাজ করে।
লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য:
পার্বত্য চট্টগ্রামের ছাত্রদের শিক্ষাগত ও সামাজিক অধিকার নিশ্চিত করা।
পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর স্বায়ত্তশাসনের দাবি ও সাংস্কৃতিক পরিচয় রক্ষার জন্য আন্দোলন গড়ে তোলা।
সরকারি নীতি ও কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও সচেতনতা সৃষ্টি।

(খ) হিল উইমেন্স ফেডারেশনের গঠন ও কার্যক্রম:
হিল উইমেন্স ফেডারেশন (Hill Women’s Federation – HWF) পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি নারীদের অধিকার রক্ষা এবং তাদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে গঠিত একটি সংগঠন। এটি পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) একটি সহযোগী সংগঠন হিসেবে কাজ করে। নিম্নে হিল উইমেন্স ফেডারেশনের গঠন, উদ্দেশ্য, কার্যক্রম এবং গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলি বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হলো।গঠনের ইতিহাসহিল উইমেন্স ফেডারেশন ১৯৮৮ সালের ৮ মার্চ, আন্তর্জাতিক নারী দিবসে, পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি সম্প্রদায়ের তরুণীদের নিয়ে গঠিত হয়। এই সংগঠনটি পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মা জনগোষ্ঠীর নারীদের প্রতিনিধিত্ব করে, যারা চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, ম্রো, বম, খিয়াংসহ বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সদস্য। HWF-এর গঠনের পেছনে মূল উদ্দেশ্য ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের নারীদের মধ্যে ঐক্য গড়ে তোলা এবং তাদের অধিকার ও স্বায়ত্তশাসনের জন্য জেএসএস-এর নেতৃত্বে চলমান সংগ্রামে সক্রিয় ভূমিকা পালন করা।

হিল উইমেন্স ফেডারেশনের প্রধান উদ্দেশ্য গুলো নিম্নরূপ: নারীদের মধ্যে ঐক্য ও উৎসাহ সৃষ্টি: উপজাতি সম্প্রদায়ের নারীদের মধ্যে ঐক্য ও সংহতি গড়ে তোলা এবং তাদের মধ্যে স্বায়ত্তশাসন ও অধিকারের জন্য সংগ্রামের চেতনা জাগ্রত করা। সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রক্ষা: পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, আচার-অনুষ্ঠান এবং জীবনধারা সংরক্ষণ করা। বৈষম্য ও শোষণমুক্ত সমাজ গঠন: নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্য, শোষণ এবং পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব থেকে মুক্ত একটি সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করা। নারীদের ক্ষমতায়ন: শিক্ষা, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা এবং রাজনৈতিক অংশগ্রহণের মাধ্যমে নারীদের ক্ষমতায়ন করা। ফেডারেশনের সর্বোচ্চ সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী সংস্থা হলো কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি সম্মেলন, যা প্রতি তিন বছর পর পর অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলন একটি কেন্দ্রীয় কমিটি নির্বাচন করে, যা সংগঠনের নীতি-নির্ধারণ এবং কার্যক্রম পরিচালনার জন্য দায়িত্বশীল। সংগঠনটির সদর দপ্তর রাঙামাটির কল্যাণপুরে অবস্থিত। কার্যক্রম হিল উইমেন্স ফেডারেশন পার্বত্য চট্টগ্রামের নারীদের অধিকার রক্ষা এবং তাদের প্রতি সহিংসতা রোধে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কার্যক্রমগুলো হলো:

জেএসএস-এর সম্পর্ক:
ভারতের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক রয়েছে৷ প্রতিষ্ঠাকালীন ভারত অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথা কথিত আছে। তবে এখনো ভারতের মাটিতে জেএসএস এর ঘাঁটি ও আশ্রয় এবং প্রশিক্ষণ শিবির রয়েছে।

অস্ত্র সংগ্রহ:
ভারত সরকার এবং বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী ও মায়ানমারের বিভিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলো থেকে।

২. ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)

গঠন ও ইতিহাস: ইউপিডিএফ ১৯৯৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর প্রসীত বিকাশ খীসার নেতৃত্বে ঢাকায় একটি প্রেস কনফারেন্সের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করে। এর সভাপতি প্রসীত বিকাশ খীসা (খাগড়াছড়ি) এবং সাধারণ সম্পাদক রবি শংকর চাকমা (রাঙামাটি)। ইউপিডিএফ মূলত জেএসএস এবং পিসিপি থেকে বিদ্রোহ করে গঠিত হয়, যারা শান্তিচুক্তির বিরোধিতা করেছিল।

উদ্দেশ্য: ইউপিডিএফ পার্বত্য চট্টগ্রামে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার দাবি জানায়। তারা শান্তিচুক্তিকে অপ্রতুল মনে করে এবং পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর অধিকার ও স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামের ঘোষণা দেয়।

কার্যক্রম ও বিতর্ক:
২০০১ সালে তিন বিদেশী নাগরিকের অপহরণ: ইউপিডিএফ তিনজন বিদেশী নাগরিককে অপহরণ করে এবং মুক্তিপণ হিসেবে ৩ কোটি টাকা আদায় করে বলে অভিযোগ রয়েছে।
বাঙালি ও সেনাবাহিনী প্রত্যাহারের দাবি: তারা পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে বাঙালি জনগোষ্ঠী এবং সেনাবাহিনী প্রত্যাহারের দাবি জানায়, যা রাষ্ট্রবিরোধী হিসেবে বিবেচিত হয়।

ইউপিডিএফ-এর কার্যক্রম জেএসএস-এর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং আঞ্চলিক আধিপত্য বিস্তারের কারণে আরও জটিলতা সৃষ্টি করে।

সম্পর্ক: বাংলাদেশের বাম রাজনৈতিক দলসমূহ।

অস্ত্র গ্রহন: ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী ও কাচিন বিদ্রোহী থেকে।

৩. জেএসএস সংস্কার (এম.এন লারমা গ্রুপ)

গঠন ও ইতিহাস: জেএসএস-এর একটি অংশ ২০০৭ সালে বিদ্রোহ করে জেএসএস সংস্কার গ্রুপ গঠন করে, যা এম.এন লারমা গ্রুপ নামে পরিচিত। এই গ্রুপটি সুধাসিন্ধু খীসার নেতৃত্বে গঠিত হয়, তবে তাদের প্রকাশ্য কার্যক্রম ২০১০ সালের পর থেকে লক্ষ্য করা যায়।

উদ্দেশ্য: এই গ্রুপটি চুক্তির মূল আদর্শের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে এবং জেএসএস সন্তুর নেতৃত্ব ও ইউপিডিএফ নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করে। তারা পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগোষ্ঠীর জন্য স্বাধীনতা ও স্বায়ত্তশাসনের দাবি করে। কিন্তু তাদের কার্যক্রম মূলত জেএসএস ও ইউপিডিএফ কে ঘিরে। তাদের দলছুট নেতাকর্মী দিয়ে এটি গঠিত।

কার্যক্রম: এই গ্রুপটির কার্যক্রম তুলনামূলকভাবে কম প্রকাশ্য, তবে তারা জেএসএস ও ইউপিডিএফ-এর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারে জড়িত।

সম্পর্ক: অপ্রকাশ্য (গোপন) সম্পর্ক।

অস্ত্র গ্রহণ:
ভারত ও মায়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠী থেকে।

৪. গণতান্ত্রিক ইউপিডিএফ

গঠন ও ইতিহাস: গণতান্ত্রিক ইউপিডিএফ, যা ইউপিডিএফ-গণতান্ত্রিক বা ইউপিডিএফ (বর্মা) নামে পরিচিত, ২০১৭ সালের ১৫ নভেম্বর গঠিত হয়। এটি প্রসীত বিকাশ খীসার নেতৃত্বাধীন মূল ইউপিডিএফ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গঠিত হয়। এই গ্রুপটির অন্যতম নেতা তপন জ্যোতি চাকমা, যিনি বর্মা নামে পরিচিত। তিনি ইউপিডিএফ এর হাতে ২০১৮ সালে নানিয়ারচর গুলিতে নিহত হন।

উদ্দেশ্য: গণতান্ত্রিক ইউপিডিএফ পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগোষ্ঠীর স্বার্থে একটি পৃথক রাজনৈতিক অবস্থান গ্রহণ করার কথা বলে। তারা স্বায়ত্তশাসন এবং পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর অধিকার রক্ষার দাবিও জানায়। যদিও এখন পর্যন্ত তাদের কার্যক্রম প্রতিপক্ষ ইউপিডিএফকে ঘিরে। এটির সদস্যরা ইউপিডিএফ থেকে দলছুট।

কার্যক্রম: এই গ্রুপটির কার্যক্রম মূলত ইউপিডিএফ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে এবং অন্যান্য দলের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যে সীমাবদ্ধ। তবে তাদের প্রভাব তুলনামূলকভাবে কম।

সম্পর্ক: অপ্রকাশ্য (গোপন সম্পর্ক)

অস্ত্র সংগ্রহ: ভারত ও মায়ানমারের বিদ্রোহ গ্রুপ থেকে।

৫. মগ লিবারেশন পার্টি (এমএলপি)

 

গঠন ও ইতিহাস: মগ লিবারেশন পার্টি (এমএলপি), যা স্থানীয়ভাবে মগ আর্মি নামে পরিচিত, পার্বত্য চট্টগ্রামের রাখাইন ও মারমা জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বকারী একটি সশস্ত্র সংগঠন। এটি ২০১৭ সালে গঠিত বলে ধারণা করা হয়, যদিও এর কার্যক্রম ২০২২ সালের মার্চে রাজস্থলী উপজেলার কেচিপাড়ায় জেএসএস-এর সঙ্গে সংঘর্ষের মাধ্যমে প্রকাশ্যে আসে। এমএলপি রাঙামাটি জেলার রাজস্থলী এবং বান্দরবান জেলার রাজবিলা ও লামা উপজেলায় সক্রিয়।

উদ্দেশ্য: এমএলপি মারমা ও রাখাইন জনগোষ্ঠীর অধিকার এবং স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে। তারা চাকমা নেতৃত্বাধীন জেএসএস-এর আধিপত্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে।

কার্যক্রম: এমএলপি-এর কার্যক্রম মূলত সশস্ত্র সংঘর্ষ এবং আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের মধ্যে সীমাবদ্ধ। তাদের মিয়ানমারের কাচিন রাজ্যের বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

সম্পর্ক: অপ্রকাশ্য (গোপন সম্পর্ক)

অস্ত্র সংগ্রহ:
মায়ানমারের কারেন বিদ্রোহী, আরাকান আর্মি থেকে অস্ত্র গ্রহণ।

৬. কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)

ছবি: নাথান বম ও তার সশস্ত্র সদস্যরা

গঠন ও ইতিহাস: কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ), যা বম পার্টি নামে পরিচিত, ২০০৮ সালে নাথান বমের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয়। নাথান বম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের একজন স্নাতক, পূর্বে জেএসএস-এর ছাত্র সংগঠন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। প্রথমে কেএনএফ কুকি-চিন জাতীয় উন্নয়ন সংস্থা (কেএনডিও) নামে একটি অরাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে কাজ শুরু করে। ২০১৬ সালে এটি সশস্ত্র সংগঠনে রূপান্তরিত হয় এবং কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মি (কেএনএ) নামে এর সশস্ত্র শাখা গঠিত হয়।

উদ্দেশ্য: কেএনএফ-এর মূল লক্ষ্য রাঙামাটি ও বান্দরবানের নয়টি উপজেলায় বম, পাংখুয়া, লুসাই, খুমি, ম্রো, এবং খিয়াং জনগোষ্ঠীর জন্য একটি স্বাধীন বা স্বায়ত্তশাসিত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। তারা জেএসএস-এর বিরুদ্ধে বৈষম্যের অভিযোগ তুলে এবং নিজেদের ছয়টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর প্রতিনিধি হিসেবে দাবি করে।

কার্যক্রম ও বিতর্ক:
২০১৯ সাল থেকে সশস্ত্র কার্যক্রম: কেএনএফ চাঁদাবাজি, অপহরণ, হত্যা, এবং ব্যাংক ডাকাতির মতো অপরাধমূলক কার্যক্রমে জড়িত।
২০২২ সালে ফেসবুকের মাধ্যমে দাবি প্রকাশ: তারা একটি আলাদা রাজ্যের মানচিত্র প্রকাশ করে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের হস্তক্ষেপের আহ্বান জানায়।
বিদেশী সংযোগ: কেএনএফ মিয়ানমারের কাচিন ও কারেন বিদ্রোহী গোষ্ঠী এবং ভারতের মিজোরাম ও মণিপুরের সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক রাখে বলে অভিযোগ রয়েছে।

বর্তমান অবস্থা: ২০২২ সাল থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এবং র‌্যাব কেএনএফ-এর বিরুদ্ধে ব্যাপক অভিযান চালাচ্ছে। ২০২৪ সালে রুমা ও থানচিতে ব্যাংক ডাকাতি এবং অপহরণের ঘটনায় কেএনএফ আবারও আলোচনায় আসে।

সম্পর্ক: মিজোরাম জো জাতি এবং মায়ানমারের লাই জনগোষ্ঠী।

অস্ত্র গ্রহণ: মিজো বিদ্রোহী এবং মায়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠী এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের ইউপিডিএফ থেকে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক দলগুলোর গঠন এবং কার্যক্রম এই অঞ্চলের জটিল ভূ-রাজনৈতিক ও জাতিগত প্রেক্ষাপটের প্রতিফলন। জেএসএস, ইউপিডিএফ, এমএলপি, এবং কেএনএফ-এর মতো সংগঠনগুলো পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর অধিকার ও স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে গঠিত হলেও, তাদের সশস্ত্র কার্যক্রম, রাষ্ট্রবিরোধী অবস্থান, এবং অভ্যন্তরীণ বিভেদ এই অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতাকে চ্যালেঞ্জ করেছে। ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চুক্তি সংঘাত কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও, এই দলগুলোর অস্তিত্ব এবং তাদের দাবিগুলো পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক ও সামাজিক সমস্যার জটিলতাকে সামনে নিয়ে আসে। এই অঞ্চলে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সংলাপ, সমঝোতা, এবং সকল জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি।

আগের পোস্টগণমাধ্যম সংস্কার কমিশনে ‘আদিবাসী’ শব্দের ব্যবহারের প্রতিবাদ পিসিসিপি’র
পরের পোস্টষড়যন্ত্র বন্ধে রাঙামাটিতে পিসিসিপির লিফলেট বিতরণ

রিপ্লাই দিন

আপনার কমেন্ট লিখুন
আপনার নাম লিখুন