মোঃ সোহেল রিগ্যান, লেখক ও গবেষক পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক।
পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঙ্গালীরা যেন নিজ দেশে পরবাসী। সরকার ১৯৭৯/৮০/৮১ সালে রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে বাঙ্গালীদের পার্বত্য চট্টগ্রাম পূর্ণবাসন করার জন্য নানান সুযোগ-সুবিধার কথা বলেই কিন্তু পাহাড়ে নিয়ে আসে। প্রায় ৩০ হাজার বাঙ্গালী পরিবার পাহাড়ে আসার পর তথাকথিত শান্তিবাহিনী ও ম্যালেরিয়া এবং নানান প্রতিকূল পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। এমন পরিস্থিতি পাহাড়ে বাঙ্গালী টিকে থাকা ছিল যথা সাধ্য কষ্ট। ম্যালেরিয়া প্রকোপ আর শান্তিবাহিনীর হত্যাকাণ্ড, তান্ডবলীলা ও নৃশংসতা ছিল মারাত্মক ভয়াবহ৷ তৎকালীন সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙ্গালীদের যেসব সুযোগ-সুবিধার কথা বলে নিয়ে এসেছে বাস্তবিক তার রেশমাত্র ছিল। সুযোগ সুবিধা তো দূরের কথা তৎসময় রাষ্ট্র বাঙ্গালীদের নিরাপত্তা দিতেও হিমশিম খায়। রাষ্ট্রের এ অসহায়ত্ব পার্বত্য বাঙ্গালীরা পাহাড়ে অভিভাবকহীন হয়ে পড়ে। এই বাঙ্গালীদেরকে বলা হয় সেটেলার! নিজ দেশে তারা সেটেলার! এভাবে ৭/৮ বছর কেটে গেলে ১৯৮৮ সালে এরশাদ সরকার পার্বত্য বাঙ্গালীদের সদর মুখী করে। তাদের উপর একের পর এক হামলার পর তাদের জন্যে আলাদা করে তৈরি করা হয়েছে গুচ্ছগ্রাম। পরে গুচ্ছগ্রামেও হামলা হয়েছে। গুচ্ছগ্রাম মূলত বন্দিশালা। ম্যালেরিয়া, তীব্র হামলা ও পরিবেশগত কারণে বাঙ্গালীদের মধ্যে অবিশ্বাসও প্রকট। পাহাড়ের মানুষের প্রধানত জীবিকা নির্বাহ কৃষি আবাদ, গাছ-বাঁশ ও আদা-হলুদ ও পাহাড়ি ফলমূলের উপর। এসব করতে অবশ্যই ভূমির প্রয়োজন। কিন্তু পার্বত্য বাঙ্গালীদের ভূমি নেই৷ বাঙ্গালীদের সরকার ১৯৭৯/৮০/৮১ সালে যে ৩-৫ একর ভূমি দিয়েছে তা শান্তিবাহিনীর হামলার ভয়ে দখলে যেতে পারেনা। সরকার বাঙ্গালীদের গুচ্ছগ্রাম গুলোর একদম সীমিত জায়গা বন্দি করেছে৷ এই সীমিত জায়গাতে হাজার হাজার বাঙ্গালী বসবাসের উপযুক্ত নয়। এখানে জীবনমান উন্নয়ন বা বিকাশ এর মত পরিবেশ নেই। একপ্রকার বলা যায় এখানে বাঙ্গালীরা শরণার্থী শিবিরের মত বন্দি। শিক্ষা-দীক্ষা, চাকরি-বাকরি কিংবা কর্মসংস্থান বাঙ্গালীদের জন্য কোন ব্যবস্থা নেই। এনজিও, দাতা সংস্থার কোটি কোটি টাকা অনুদান কিন্তু এই বাঙ্গালীদের ভাগ্যে জোটে না। বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে ১৬ লক্ষ মানুষ আছে উপজাতি-বাঙ্গালী মিলে। রাষ্ট্র এই ১৬ লক্ষ মানুষের মধ্যে শুধুমাত্র উপজাতি ক্ষুদ্র জাতিসত্বার জীবনমান উন্নয়নে কর্মসংস্থান, শিক্ষা-চাকরি, কোটা ও সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিকভাবে অগ্রসর হওয়ার যুগোপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। উপজাতি ক্ষুদ জাতিস্বত্বার জন্য সরকার ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চুক্তি সম্পাদিত করে। এই চুক্তি পার্বত্য বাঙ্গালীদের মৌলিক অধিকার হরণ করেছে এবং পার্বত্য বাঙ্গালীদের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করেছে। চুক্তির বেশিরভাগেরই ধারা উপজাতিদের প্রাধান্যের আবির্ভাব ঘটিয়েছে। যার ফলে পার্বত্য বাঙ্গালীরা নিজ দেশে আজ পরবাসী।
পার্বত্য চট্টগ্রামের খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটি এবং বান্দরবান এর গুচ্ছগ্রামগুলো সরেজমিনে প্রত্যক্ষ করে দেখা গেছে- বাঙ্গালীদের বেছে থাকার কঠিন জীবন সংগ্রাম। পার্বত্য চট্টগ্রাম পিছিয়েপড়া হতদরিদ্র ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠী হিসেবে উপজাতিদের চিহ্নিত করা হলেও মূলত গুচ্ছগ্রামের বন্দিশালায় থাকা পার্বত্য বাঙ্গালীরা অনগ্রসর। এখানে জীবনমান উন্নয়ন বা পরিবর্তন এবং বিকাশের বিন্দুমাত্র রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধার রেশ নেই। সরকারি ও এনজিও সংস্থাগুলোর চক্ষুদৃষ্টিতে পার্বত্য বাঙ্গালীরা মানুষ নয়। সরকারি ও এনজিও সংস্থাগুলোর সাহায্য-সহায়তা শুধুমাত্র নিদিষ্ট একটি সম্প্রদায়ের জন্য৷ গুচ্ছগ্রামগুলোতে ৩৪ বছর ধরে বসবাস করা কবির হোসেন জানান, ১৯৭৯ সালে সরকারি পত্রপত্রিকা ও রেডিও তে প্রচার-প্রচারণা করে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙ্গালীদের ৫একর জমি দেওয়া হবে ও হালচাল করার জন্য গরু দিবে এবং ঘর নির্মাণ করে দিবে মর্মে বাঙ্গালীদের নিয়ে আসে। সরকারের কথিত এই সুযোগের ঘোষণায় আমার দাদা-বাবাসহ আমরা সমতল ভূমি হতে পাহাড়ে আসি। পাহাড়ে এসে যা দেখেছি তা এখন বললে কেউ বিশ্বাস করবে না। বলবে গল্প বলছি! বর্তমান প্রজন্মের পক্ষে তৎকালীন পার্বত্য পরিস্থিতি অনুধাবন করা অসম্ভব। আমরা শান্তিবাহিনীর হিংসাত্মক ও ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ দেখেছি৷ শান্তিবাহিনীর তীব্র আক্রমনে আমরা তিন তিনবার স্থানান্তরিত হয়েছি৷ প্রতিবারই শান্তিবাহিনী আমাদের ঘর পুড়িয়ে দিয়েছে৷ তৃতীয়বার স্থানান্তরিত সময় আমরা এক জায়গায় থেকে অন্য জায়গাতে গিয়ে ঘর তৈরি করতে প্রায় ৫/৬ দিন সময় লেগেছে। এসময় আমরা পানি আর মিলিটারি ক্যাম্প থেকে দেওয়া সামান্য বিস্কুট ছাড়া আর তেমন কিছু খায়নি৷ এই দীর্ঘ সময় আমার দাদা, বাবা, ৩ চাচা, ৪ফুপু ও আমরা ২ ভাইবোন অনাহারে ছিলাম। ৬দিন পর ঘর নির্মাণ শেষে রাতে রান্নার পর আমরা যখন খেতে বসবো ঠিক তখন খবর আসলো শান্তিবাহিনী এসেছে৷ যে যেভাবে পারে তারাতাড়ি ঘর থেকে বের হয়ে মিলিটারি ক্যাম্পে চলে যাওয়ার নির্দেশ। এভাবে শান্তিবাহিনী আমাদের খাবার কেটে নিয়েছে। শান্তিবাহিনী নিকটে এসে যাওয়ার ভয়ে আমরা সেসময় ঘর থেকে বের হওয়ার চেষ্ঠা করেও বের হতে পারিনি। কারণ আমাদের ঘরের সামনের দিক দিয়ে খাল। এ খাল দিয়েই শান্তিবাহিনীরা বাঙ্গালী গ্রামগুলোতে প্রবেশ করে নাকি সবসময় আক্রমণ করে। ঘোর অন্ধকারে কিছু দেখা না গেলেও শান্তিবাহিনী যে চাকমা ভাষা কথা বলে খাল দিয়ে ঘরের দিকে অগ্রসর হচ্ছে সে শব্দ কানে আসছে৷ আমাদের এই মূহুর্তে নিরাপদে সরে যাওয়ার জন্য সামনের রাস্তার পথ ছাড়া বিকল্প কোন পথ নেই। কিন্তু সামনের পথেই শান্তিবাহিনী। তাই সবাই চুপচাপ থাকলাম। এদিকে দাদা কিন্তু বৃদ্ধ মানুষ। বয়স প্রায় ৯০ চুঁইচুঁই। তাকে নিয়ে এই অন্ধকার যাব কোথায়? তাছাড়া সেই হাঁটাচলা করতে পারেনা। তাকে ফেলে যাওয়ারও সুযোগ নেই। কিন্তু জীবন হারানোর শঙ্কা আর আতঙ্কের মধ্যে কী আর দাদার জন্য এতগুলো মানুষ প্রাণ দিতে হবে? এরমধ্যেই শান্তিবাহিনী আমাদের ঘর লক্ষ্য করে ৫/৬ রাউন্ড গুলি ছুঁড়ে। ঘর পাহাড়ের উঁচু স্থানে তাই এতদূর খালের নিচ থেকে আমাদের ভেদ করা সম্ভব হয়না। কিন্তু তারা তো একটু পরে আমাদের ঘরে পৌছাবে তখন কী হবে? এভেবে কোন উপায়ান্তর না পেয়ে ঘরের পেছনের অংশের বেড়া কেটে দাদাকে ঘরে রেখেই উঁচু নিচু পাহাড় বেয়ে জঙ্গলে দিকে ছুটে চলি। শান্তিবাহিনীর ভয়ে সারারাত জঙ্গলে কাটিয়েছি৷ এদিকে সারারাত জঙ্গলের মশার কামড়ও খেয়েছি। ভোর হতে ঘরে এসে দেখি রক্তমাখা দাদার নিথর দেহ আর ঘরের জিনিসপত্র সব এলোমেলো। রান্না করা ভাত তরকারির সব ফেলে দিয়েছে। শান্তিবাহিনীর এমন নৃশংস হত্যাকাণ্ড আর অসহ্য যন্ত্রণা আমরা সহ্য করেছি।
বর্তমান প্রজন্ম জানে না পাহাড়ের বাঙ্গালীর টিকে থাকার ইতিহাস ও আত্মত্যাগ। এখানে বাঙ্গালীদের প্রতিটি মূহুর্ত কেটেছে আতঙ্কে। আজ গুচ্ছগ্রাম গুলোর যে অবস্থা তা সরেজমিনে প্রত্যক্ষ না করলে এর চরম বাস্তবতা অনুয়েম করা কঠিন হবে।
এভাবে কথাগুলো বলছিলেন গুচ্ছগ্রামের বন্দিশালায় বসবাস করা বাঙ্গালী কবির হোসেন।
বাঙ্গালীদের জীবনযাপন দেখতে গিয়েছিলাম বান্দরবান জেলার দুর্গম উপজেলার গুচ্ছগ্রাম গুলোতে। সরেজমিনে দেখেছি গুচ্ছগ্রামগুলোর বাঙ্গালীদের ঘরগুলো সীমিত জায়গার মধ্যে। ছোট্ট ঘরে ৪/৫ জন্য সদস্য নিয়ে খুবি কষ্টের মধ্যে থাকতে হয়। এর মধ্যে নেই স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগার। ময়লা অপসারণের নেই পর্যাপ্ত ব্যবস্থা। এবং নেই পানির ব্যবস্থা। গুচ্ছগ্রামের বাঙ্গালী পরিবারের ছেলেসন্তানগুলো পুষ্টিহীনতায় ভুগছে৷ তারা যে পরিবেশে বড় হচ্ছে তা শরণার্থী শিবিরের মত। এমন পরিস্থিতিতে মানবেতর জীবনযাপন করছে গুচ্ছগ্রামের বন্দিশালার বাঙ্গালীরা। একই অবস্থা রাঙ্গামাটির দুর্গম উপজেলার গুচ্ছগ্রামগুলোতে। অন্যান্য এলাকার মত এখানকার বাঙ্গালীদের সরকার দেওয়া ভূমি বাঙ্গালীরা দীর্ঘ বছরেও দখলে যেতে পারেনি উপজাতি সন্ত্রাসীদের হামলার ভয়ে। বাঙ্গালীদের জায়গা দখল নিশ্চিত করতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা নেই বললেই চলে৷ সব যেন ঝিমিয়ে গেছে৷ এখানে বাঙ্গালী মানে অবহেলার নাম। এখানে বাঙ্গালী মানে সেটেলার!
খাগড়াছড়ি জেলার পানছড়িতে বাঙ্গালী গুচ্ছগ্রামে পঁচা (খাওয়ার অযোগ্য) চাউল বিতরণের অভিযোগ উঠেছে প্রজেক্ট চেয়ারম্যান জয়নাথ দেব’র বিরুদ্ধে। পানছড়ি বাজার গুচ্ছগ্রাম এলাকায় খাদ্য শস্য বিতরণে এ ঘটনা ঘটে।
পঁচা ও নিম্নমানের খাদ্য শস্য বিতরণের ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছে স্থানীয় গুচ্ছগ্রামবাসীরা। গত বছরের ১১-১২ অক্টোবর শুরু হয় অক্টোবর মাসের কার্ডধারীদের রেশনের চাউল ও গম বিতরণের কাজ। প্রতি কার্ডধারীকে ৩৫ কেজি চাউল ও ৪৯ কেজি গম দেওয়ার কথা জানান, প্রজেক্ট চেয়ারম্যান জয়নাথ দেব।
কার্ডধারীর অভিযোগ, ভাল চাউলের স্থলে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে অন্যত্র বিক্রয়ের জন্য পঁচা নিম্নমানের চাউল গম দেওয়া হয়েছে স্থানীয় কার্ডধারীদের। ২৮৮টি কার্ড নিয়ে গঠিত বাজার গুচ্ছগ্রামের কার্ডধারীদের চাউল না নিলে স্বল্প মুল্যে রেশনের প্রতি ডিও কার্ড বিক্রয়ের জন্য বাধ্য করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। একই অভিযোগ কাউখালীর মোহাম্মদ আলীর বিরুদ্ধে। তারা উপজেলা খাদ্য অফিসের সঙ্গে যোগসাজশে এসব করে থাকে। নির্ধারিত টাকায় চাউল-গম বিক্রয় না করলে সে পঁচা চাউলই নিতে যেতে বাধ্য করা হচ্ছে বলে অভিযোগ সূত্রে জানা যায়। বাঙ্গালীদের চাউল কম দেয়ার অভিযোগও রয়েছে। এখানে চলে বাঙ্গালীদের সঙ্গে অন্যায় ও অনিয়ম। সবকিছুই জেনেও প্রশাসন নির্বিকার। মোদ্দা কথা হলো- ভালো নেই গুচ্ছগ্রামে বন্দিশালার পার্বত্য বাঙ্গালীরা।
স্থানীয় বাঙ্গালী নেতারা চলে উপজাতি প্রভাবশালী নেতাদের নির্দেশে। তারা উপজাতিদের গোলামী ও চাটুকারের ভূমিকায় অবতীর্ণ। বাঙ্গালীদের পক্ষ হইতে কেউ মেম্বার কিংবা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হলে সেই তার অতীত ভুলে যায়। উপজাতিদের চাটুকারিতায় ব্যস্ত থাকে৷ অল্পদিনে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ! সচ্ছল বাঙ্গালীদের মধ্যে অধিকাংশই উপজাতি রাজনৈতিক নেতাদের তোষামোদ করে বাঙ্গালীর ক্ষতিসাধন করে আসছে। তাদের কারণে পার্বত্য বাঙ্গালীরা রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা হতে বঞ্চিত হচ্ছে। এখানকার অনেক বাঙ্গালী আজ নিজের অতীত ভুলে গেছে। তারা এখন উপজাতি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী এবং উপজাতি রাজনৈতিক নেতাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে ব্যবহৃত হয়ে বাঙ্গালীর অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন করছে। এভাবে চলতে থাকলে অচিরেই পার্বত্য গুচ্ছগ্রামের বাঙ্গালীরা কঠিন অস্তিত্ব সংকটে পড়বে।