জেএসএস এর প্রকাশিত অর্ধ-বাৎসরিক প্রতিবেদন পুরোটাই মিথ্যা ও অপপ্রচার।

0

সোমবার ১ জুলাই জেএসএস সন্তু গ্রুপের তথ্য ও প্রচার বিভাগ স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রামের মানবাধিকার পরিস্থিতির উপর অর্ধ-বাৎসরিক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। ২০২৪- জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত এই ৬ মাসের প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।
প্রতিবেদন রিপোর্টে ১০৭টি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় ৫,৪৪৮ জন ভিক্টিম, এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে নিরাপত্তা বাহিনী ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীসহ বাঙ্গালীদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো অভিযোগসহ ভূমি বেদখল, পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে অসহযোগীতা ও পার্বত্য নাজুক পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে!

জেএসএস সন্তুর মনগড়া, গল্পকাহিনী নির্ভর প্রতিবেদন খন্ড খন্ড ব্যাখা করার পূর্বে জেএসএসের পটভূমি জানা প্রয়োজন। তার আগে বলে রাখি- জেএসএস ৬ মাস ধরে মিথ্যাকে সত্য হিসেবে রুপান্তরিত করার চেষ্টা করেছে। যদিও ৬ মাস ধরে তৈরি করা বিশদ এই লেখা প্রতিবেদন সল্প সময়ে জবাব দেওয়া বড় চ্যালেজিং হতে পারে অনেকের কাছে৷ কিন্তু মিথ্যা যে, সবসময় সত্যের কাছে দুর্বল এই কথাটি আমাদের মনে রাখতে হবে। শাক দিয়ে মাছ ঢাকা যায়না।
১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা (এম.এন লারমা)-এর নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সংহতি সমিতি (জেএসএস) গঠন হয়! ১৯৮৩ সালে এম.এন লারমার ছোটভাই সন্তু জেএসএসের সভাপতি হিসেবে দ্বায়িত্ব গ্রহণ করেন।
১৯৯৭ সনের ২-রা ডিসেম্বর সরকার ও জেএসএস সন্তু মধ্যকার পার্বত্য চট্টগ্রাম নামক একটি চুক্তি সম্পাদিত হয়। এই চুক্তির মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে দীর্ঘদিনের সন্ত্রাসবাদ, রক্তারক্তি সংঘাত, হানাহানি, অরাজকতা ও অচল অবস্থা, এবং অবৈধ অস্ত্র পরিহার করে শান্তির পথে হাঁটার কথা উল্লেখযোগ্য ছিলো।

কিন্তু অতি দুঃখজনক বিষয় হলো- জেএসএস পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির উক্ত শর্ত গুলো লঙ্ঘনসহ মৌলিক শর্ত লঙ্ঘন করে পূর্বেকার ন্যায় অবৈধ অস্ত্র নিয়ে চাঁদাবাজি, অপহরণ, খুন-গুম ও মানুষ হত্যাসহ যৌন হয়রানি, সহিংসতা, ধর্ষণের মত ঘৃণ্য কাজে সরাসরি জড়িত। এমনকী পর্দার আড়ালে জেএসএসই মানবাধিকার লঙ্ঘনে সবচেয়ে বেশি জড়িত। পাহাড়ে জেএসএসের বিরুদ্ধে পাহাড় সমান অভিযোগ— নারী ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, ভূমি বেদখল, চাঁদাবাজি, গুম ও অস্ত্রের ভীতি দেখানো নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা।  সরকারি সুযোগ-সুবিধা হাতিয়ে নেওয়াসহ অন্যান্য ক্ষুদ্র- নৃগোষ্ঠী গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের অধিকার ছিনিয়ে নিয়ে জুম্ম জাতীয়তাবাদ চাপিয়ে দেওয়াও তাদের কাজ।

সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে জেএসএসের প্রকাশিত প্রতিবেদনটি নজরে আসে। প্রতিবেদনে ছোট-বড় ৩৭টি প্যারা রয়েছে। এসব প্যারায় সরকার, নিরাপত্তা বাহিনী, পুলিশ, নির্বাহী প্রশাসন ও বাঙ্গালীদের বিরুদ্ধে মনগড়া, গল্পকাহিনী নির্ভর সমালোচনা ছাড়া জেএসএস স্বজাতির উদ্দেশ্যে ভালো কোন বার্তা দিতে পেরেছে বলে আমার কোনভাবেই মনে হয়নি। মনে হয়েছে জেএসএস নিজেদের অপকর্ম ঢাকতে হাজারো মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছে। একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে তথাকথিত মানবাধিকার লঙ্ঘন বিষয়ক প্রতিবেদনটি পড়তে শুরু করলাম। কয়েকটি প্যারা পড়ার পড়ে বুঝতে আর বাকি রইলো না যে, এটি একটি পুরোটাই মিথ্যা ও অপপ্রচার। মূলত বিভ্রান্তি ছড়িয়ে সরকার, নিরাপত্তা বাহিনী ও বাঙ্গালীদের প্রশ্নবিদ্ধ করার প্রয়াস এটি। জেএসএসের এই তথ্য সন্ত্রাস নির্ভর কারসাজির ইতিহাস অনেক পুরোনো। পার্বত্য চুক্তির পূর্বেও জেএসএস পাহাড়ে নারকীয় হত্যাকাণ্ড পরিচালনা করে তার দায়ভার রাষ্ট্র, নিরাপত্তা বাহিনী ও বাঙ্গালী উপর তথ্য সন্ত্রাসের মাধ্যমে চাপিয়ে দিতেন। চুক্তির এত বছর পরেও সে মিথ্যা ও অপপ্রচার নির্ভর কর্মকাণ্ড থেকে বের হতে পারেনি জেএসএস।

জেএসএস কয়েকবছর ধরে জুম্মবার্তা, পাহাড় বুলেটিন নামে ত্রিমাসিক পত্র-পত্রিকা, হিল ভয়েস পোর্টাল ও অসংখ্য নামে-বেনামে সোশ্যাল মিডিয়া একাউন্ট ব্যবহার করে রাষ্ট্র, নিরাপত্তা বাহিনী ও বাঙ্গালীকে বিতর্কিত করতে তৎপরতা চালিয়ে আসছে। তাদের এই অর্ধ-বাৎসরিক প্রতিবেদনও তারই ধারাবাহিকতার বহিঃপ্রকাশ। সাধারণ জনগণ কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা সেটা জানার সময় নাই। সামনে যেটা পায় সেটাকে সত্য হিসেবে মেনে নেয়। তাই জেএসএসের ৩৭ প্যারার প্রতিবেদনটির উদ্ধৃতির কিছু অংশ সংক্ষিপ্তভাবে ব্যাখা করে প্রকৃতসত্য উদ্ভাবন করা প্রয়োজন। একজন দেশপ্রেমিক সচেতন নাগরিক হিসেবে জেএসএসের মুখোশ জাতি তথা জনগণের কাছে প্রকাশ করা কর্তব্য। 

চুক্তি বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে সরকারের অসহযোগীতার বিষয়ে জেএসএসের অভিযোগ কতটুকু সত্য?

পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে সরকারের ভূমিকা:  এ অঞ্চলের জাতিসত্তাগুলোর অধিকার, ১৯৯৭ সনের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির মাধ্যমে সরকার বাস্তবায়ন করেছে। চুক্তির  ৯৯টি ধারা-উপধারার মাধ্যমে এ অঞ্চলের ১৩টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জাতিসত্তার অধিকার নিশ্চিত করেছে। কিন্তু ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র ১৩টি জাতিসত্তার এই অধিকার নিশ্চিতে জেএসএস কতটুকু সচ্ছলতা দেখিয়েছে তা নিয়ে অবশ্যই যথেষ্ট সন্দেহ আছে। একটি অভিযোগ সবসময় থাকে, জেএসএস নাকী এককভাবে সকল সুযোগ-সুবিধা গিলে খাচ্ছে। কথাটি অপ্রিয় হলেও সত্য।
চুক্তির অংশ হিসেবে এ অঞ্চলে সরকার ব্যাপকভাবে উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছে। চুক্তির সুফল ইতোমধ্যে পাহাড়ি জাতিসত্তা ভোগ করতে শুরু করেছে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে উন্নয়ন ও আধুনিতার ছোঁয়া লাগতে শুরু করেছে। চুক্তির ৭২টি মূল ধারার মধ্যে সরকার ৬৫টি ধারা বাস্তবায়ন করেছে। অবশিষ্ট ধারাগুলো বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াধীন। এই অবশিষ্ট ধারাগুলো বাস্তবায়নে জেএসএস সরকারকে অসহযোগীতা করছে। পরিতাপের বিষয় জেএসএস এই অসহযোগীতা নামক শব্দটি বরাবরই সরকারকে দোষারোপ করতে ব্যবহার করে আসছে। জেএসএস এখনো অবৈধ অস্ত্র ছাড়েনি। পাহাড়ে শান্তি ফিরে আসবে কীভাবে? আপাতত দৃষ্টিতে চুক্তি বাস্তবায়ন প্রসঙ্গ বিষয়ে সরকারের অসহযোগীতা করার অভিযোগটি সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট বলে প্রতিয়মান হয়। কারণ অভিযোগটি জেএসএসের রাজনৈতিক কৌশল হতে পারে।

জেএসএসের পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘন বিষয়ক প্রতিবেদনের অন্তরালে কী আছে?

পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্ব অংশে অবস্থিত— নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি এবং পর্যটন শিল্প বিকাশের অপার সম্ভাবনাময় ও প্রাকৃতিক সম্পদের ভরপুর এক অর্থনৈতিক সম্মৃদ্ধ অঞ্চল। এ অঞ্চলের অধিক এলাকা অতি দুর্গম। যেখানে খুব সহজেই যাতায়াত করা কষ্টসাধ্য। মানুষ জীবনের তাগিদের অনেক সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সরকার এই দুর্গম অঞ্চলের ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়কে গ্রাস করা সন্ত্রাসাবাদ থেকে মুক্তি দিতে বিভিন্ন সময় বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করে আসছে। তারই আলোকে পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষদের জীবনমান পরিবর্তনে জনহিতকর কার্যে অনেক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। এখানকার মানুষের প্রধান সমস্যা হলো- অবৈধ অস্ত্রের কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ।সন্ত্রাসবাদ, চাঁদাবাজি, অপহরণ ও খুন-গুম তাদেরকে একেবারেই গ্রাস করে আছে। সরকার এখানকার জনগোষ্ঠী গুলোর জানমাল হেফাজতের তাগিদে নিরাপত্তা বাহিনীর মাধ্যমে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করে আসছে; এছাড়াও চুক্তি বাস্তবায়নে সন্ত্রাসীদের নিরস্ত্রকরণে এই পদক্ষেপ। এবং বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনার কাজ চলমান রেখেছে। এর ফলে অস্ত্রধারী জেএসএস সন্ত্রাসীদের দীর্ঘদিনের অস্ত্রবাজি, চাঁদাবাজি ও রাজত্ব কায়েম অবসানের দিকে যাচ্ছে। তাই তারা নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযান এবং সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে প্রশাসন, নিরাপত্তা বাহিনী ও বাঙ্গালীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা, বানোয়াট ও অপপ্রচার করে আসছে। এই অপপ্রচারের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিজেদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি করতে তৎপরতা চালাবে একই সাথে রাষ্ট্র বিরোধী কর্মকাণ্ড দামাচাপা দেওয়ার মাধ্যমে নীল নকশা বাস্তবায়নে এগিয়ে যাওয়ার পথ তৈরি করতে চেষ্টা করবে।

নিরাপত্তা বাহিনী ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গ্রেফতারকৃতরা নিরীহ মানুষ নাকী অপরাধী?

পার্বত্য চট্টগ্রামে নিরাপত্তা বাহিনী বা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কোন পাহাড়ীকে গ্রেফতার করলে তাকে নিরীহ বলে প্রচার করা আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। অবৈধ অস্ত্রধারী, চাঁদা আদায়কারী বা বৈরী আচরণকারী কাউকে আটক করলে তাকে নিরীহ পাহাড়ী হিসেবে প্রচার করে অভিযান বন্ধসহ সেনাবাহিনীকে বিতর্কিত করা সন্ত্রাসী দলগুলোর সাংগঠনিক রক্ষাসহ নিজেদের অপকর্ম লুকানোর চেষ্টারই অংশ।

বাঙ্গালী কর্তৃক পাহাড়ি ভূমি দখল কতটুকু সত্য?

পার্বত্য চট্টগ্রামে এখনো ভূমি জরিপ আরম্ভ হয়নি। এখানকার বেশিভাগ ভূমি খাস। খাস ভূমি আমরা জানি দেশের প্রচলিত ভূমি আইন অনুযায়ী সরকারের। সরকার যদি তার নাগরিককে খাস ভূমি বন্দোবস্ত দেয় সেটি সম্পূর্ণ সরকারের এখতিয়ার। ১৯৭৯ সনে পাহাড়ে আগমন করা বাঙ্গালীদের সরকার খাস ভূমিগুলো বন্দোবস্ত প্রদান করেন। এসব ভূমি পাহাড়ি ও আঞ্চলিক দলগুলো প্রথাগত অধিকার ক্ষমতায় তাদের বলে দাবি করেন। এ দাবির পক্ষে পাহাড়ীদের প্রথাগত অধিকার ছাড়া আইনী কোনপ্রকার ভিত্তি বা বৈধ কাগজপত্র ও খাজনার দাখিল নেই। বন্দোবস্ত ভূমিতে বাঙ্গালীরা বসতিস্থাপন ও চাষাবাদ করতে গেলে পাহাড়ি এবং আঞ্চলিক দলগুলো বাধা প্রদান করে থাকে। এবং মিথ্যা তথ্য প্রচার করে বলে থাকেন, বাঙ্গালী ও নিরাপত্তা বাহিনী তাদের ভূমি বেদখলকারী!

পার্বত্য চট্টগ্রাম নাজুক পরিস্থিতির পেছনে দায়ী কী শুধুমাত্র সরকার নাকী জেএসএসসহ অন্যান্য উপজাতি সংগঠনগুলো?

পার্বত্য চট্টগ্রাম নাজুক পরিস্থিতি সর্ব প্রথম তৈরি করেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সংহতি সমিতি (জেএসএস) নামক সংগঠনটি আত্মপ্রকাশ করেই। খিরাম বন বিভাগ ও সাঙ্গুনদীতে সেনাবাহিনীর উপর হামলার মধ্য দিয়ে হিংস্রতা ও শক্তিসামর্থ্য জানান দেয় জেএসএস। ১৯৭৯/৮১/৮২/৮৪/৮৬/৯২/৯৬ সালে পাহাড়ে বাঙ্গালীদের নির্বিচারে হত্যার মাধ্যমে জেএসএস নিজেদের রাষ্ট্র ও বাঙ্গালী বিরোধী হিসেবে প্রকাশ করে। পাহাড়ে চাঁদাবাজি ও আধিপত্য লড়াইয়ে আঞ্চলিক দলগুলোর মধ্যে বিভক্তি এ অঞ্চলের পরিস্থিতি নাজুক করেছে৷ এই দায়ভার সরকারের নয় বরঞ্চ এই দায়ভার সম্পূর্ণ জেএসএসসহ অন্যান্য উপজাতি সংগঠনগুলোর। এর সাথেই চুক্তি বাস্তবায়নের সঙ্গে কোনপ্রকার সম্পৃক্ততা নেই। শুধুমাত্র নিজেদের স্বার্থে পার্বত্য চট্টগ্রামকে অশান্ত ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করে থাকে জেএসএসসহ অন্যান্য আঞ্চলিক দলগুলো।

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ কমিটির গৃহীত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন না করার অভিযোগ প্রসঙ্গ-

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ কমিটি এই পর্যন্ত ৯টি বৈঠক করেছে। এসব বৈঠকে নেওয়া সিদ্ধান্ত গুলো সরকার বরাবরই বাস্তবায়নে যথেষ্ট আন্তরিক। পরিবীক্ষণ কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ গঠন হয়েছে, তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর প্রথাগত সামাজিক বিষয়গুলো স্থান পেয়েছে, ৩৪টি দপ্তর জেলা পরিষদে হস্তান্তর করা হয়েছে, পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয় সৃষ্টি হয়েছে, অভ্যন্তরীণ শরণার্থী পূর্ণবাসন ট্রাস্ট গঠন হয়েছে, কোটা প্রথা যুক্ত হয়েছে, পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন দপ্তর ও প্রতিষ্ঠানে উপজাতীয়দের একক আধিপত্য বিস্তার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, শিক্ষা ক্ষেত্রে উপজাতিরা সমতলের ন্যায় এগিয়ে গেছে। এসব কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ কমিটির সিদ্ধান্তই সরকার বাস্তবায়নের সুফল। জেএসএসের এই অভিযোগ যে মিথ্যা তা প্রমাণ করতে আর বেশি তথ্যের প্রয়োজন আছে বলে মনে করিনা।

অমুসলিম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিণত করার ষড়যন্ত্র ধামাচাপা দেওয়ার এমন অভিযোগটি উগ্রতার বহিঃপ্রকাশ ও হীন উদ্দেশ্যেই প্রচারণা। এবং প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক খ্রিস্টান রাষ্ট্র গঠন করার অভিযোগ শতভাগ সত্য বলে মনে হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যাপকহারে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করার পাশাপাশি, গির্জা স্থাপন ও এনজিও কর্মকাণ্ড থেকে প্রতিয়মান হয় যে, প্রধানমন্ত্রী শেখহাসিনা কর্তৃক সাম্প্রতিক সময়ে উক্ত বিষয়ের উপর দেওয়া বক্তব্য শতভাগ সত্য। বক্তব্যটি মিথ্যা প্রমাণ করতে জেএসএস নানা গল্প কাহিনী নির্ভর কিচ্ছা প্রকাশ করেছে। প্রকৃত সত্য জানার মাধ্যমে জনমনে নেতিবাচক প্রভাব দূর করতে নিম্নোক্ত তথ্য যথাযথ বলে মনে করি-

পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ গবেষক ছিদ্দিক শাহিনের মতে প্রায়শও পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক দলগুলো ও তাদের পোষ্য বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠন এবং তথাকথিত বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠীরা সরকার কর্তৃক পার্বত্য চট্টগ্রামকে ইসলামীকরণের অভিযোগ করে থাকে।‌ বিষয়টি নিয়ে তারা বিভিন্ন সময় পত্রপত্রিকায় এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনার ঝড় তুলে, যদিও এ বিষয়ে তারা বরাবরই কোন তথ্য  উপাত্ত দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে এই অভিযোগগুলো মূলত দাতা রাষ্ট্র এবং বিদেশী প্রভুদের মনোযোগ আকর্ষণের অস্ত্র এবং বাংলাদেশ সরকারকে বিতর্কিত করার ষড়যন্ত্র হিসেবে প্রতীয়মান হয়, যদিও বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। গত ৩০ বছরে অর্থাৎ ১৯৯১ সাল হতে ২০১১ সাল পর্যন্ত সরকারি আদমশুমারি অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামে খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারীদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১৩৪.৪৭%। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী ১৯৯১ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের মোট জনসংখ্যা ৯৭৪৪৪৫ জনের  মধ্যে ৪২৯৯৫৪ জন ছিল মুসলমান, যা শতাংশ হিসাব মোট জনসংখ্যার ৪৪.১২% । অপরদিকে ২০১১ সালের মোট জনসংখ্যা ১৫৯৮২৩১ জনের বিপরীতে মুসলিম জনসংখ্যার পরিমাণ ছিল ৬৮০৮১০ জন, যা শতাংশের হিসেবে ৪২.৬০%। সে হিসেবে গত ৩০ বছরে পার্বত্য চট্টগ্রামে মুসলিম জনসংখ্যা কমেছে প্রায় ২%। এর বিপরীতে ১৯৯১ সালে খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারীদের জনসংখ্যা যেখানে ছিল ২২২০৬ জন ( মোট জনসংখ্যার ২.২৮%), যা ২০১১ সালে বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৫২০৬৬ জনে। শতাংশের  বিচারে যা বর্তমানে মোট জনসংখ্যার ৩.২৬%। উপরের তথ্য উপাত্ত হতে সহজে অনুমেয় যে, গত ৩০ বছরে পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যাপক হারে খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরের ঘটনা ঘটেছে, যা বর্তমানেও চলমান রয়েছে। অনুসন্ধানে দেখা যায় যে,  আর্থ সামাজিক উন্নয়নের অন্তরালে দেশি এবং বিদেশি কিছু স্বার্থন্বেষী মহলের উদ্যোগে পরিচালিত কপিতয় এনজিও  দারিদ্র উপজাতি জনগণকে খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরের হীন চক্রান্তে নিয়োজিত রয়েছে। এক্ষেত্রে, কারিতাস, ওয়ার্ল্ড ভিশন, সনে ইন্টারন্যাশনাল, কমিউনিটি এডভান্সমেন্ট ফোরাম, ব্যাপ্টিস্ট চার্চ ওফ বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য। এ সকল এনজিও পার্বত্য চট্টগ্রামের নিম্নবিত্ত পরিবারের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে আর্থিক প্রলোভন দেখিয়ে তাদের সংস্কৃতি, কৃষ্টি এবং স্বকীয়তা বিসর্জনের মাধ্যমে এই ধর্মান্তকরণের কার্যক্রম পরিচালিত করছে। ফলশ্রুতিতে, বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে খ্রিস্ট ধর্মের সংখ্যা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। অনুসন্ধানে দেখা যায় যে, গত পহেলা জানুয়ারি ২০১৮ হতে এ পর্যন্ত প্রায় ৮৫৩ জন উপজাতীয় ব্যক্তিবর্গ এসকল এনজিওদের প্রলোভনের ফাঁদে পা দিয়ে নিজস্ব ধর্ম-সংস্কৃতি বিসর্জন দিয়ে  খ্রিষ্ট ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছে। এক্ষেত্রে এসকল এনজিওদের অন্যতম লক্ষবস্তু হল ক্ষয়িষ্ণু কিছু ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠী যথা বোম, চাক, লুসাই ও পাংখা নৃ গোষ্ঠী, যাদের মোটামুটি সকলেই খৃষ্টধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছে। এর বাইরে সম্প্রতি সময়ে তারা ত্রিপুরা, তনচংগা, মারমা ও চাকমা জনগোষ্ঠীকে  টার্গেট করে তাদের কার্যক্রম পরিচালিত করছে। ধর্মান্তরের পাশাপাশি পার্বত্য চট্টগ্রামে গির্জার সংখ্যা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। গত আগস্ট ২০১৭ এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী  পার্বত্য চট্টগ্রামে যেখানে গির্জার  সংখ্যা ছিল ৩৬৫ টি, তা ২০২০ সালের আগস্টের মধ্যে বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৭১৪টিতে। এই পরিসংখ্যান থেকে প্রতীয়মান হয় যে পার্বত্য চট্টগ্রামে খ্রিষ্টধর্মের প্রভাব কিভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। আর এভাবে চলতে থাকলে হয়তো আগামী ২০ বছরে পার্বত্য চট্টগ্রামের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৫০ ভাগ মানুষ খ্রিস্ট ধর্মের অনুসারী হবে। আজকের আমার এই লেখার উদ্দেশ্য খ্রিস্ট ধর্মের বিরুদ্ধে নয় এ ধর্মের অনুসারীদের বিরুদ্ধে নয় বরং পাবর্ত্য চট্টগ্রামের ধর্মান্তরের সঠিক চিত্র জনগণের সামনে তুলে ধরার মাধ্যমে সুবিধাবাদী চিহ্নিত কিছু গোষ্ঠী ও ব্যক্তিবর্গের  মুখোশ খুলে দেওয়া। এসকল তথ্য উপাত্ত হতে সহজে অনুমেয় যে পার্বত্য চট্টগ্রামে তথাকথিত ইসলামীকরণের এই অভিযোগটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন এবং দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র ও নীলনকশার একটি অংশমাত্র। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে পাবর্ত্য চট্টগ্রামের তথাকথিত বুদ্ধিজীবী এবং তাদের দোসররা বিভিন্ন সময় সরকার এবং নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে সাধারণ উপজাতি জনগোষ্ঠীকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করার অপচেষ্টা চালানোর অভিযোগ করে আসলেও এ সকল এনজিও কর্তৃক সাধারণ দারিদ্র উপজাতী জনগোষ্ঠীকে প্রলোভনের ফাঁদে ফেলে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করার বিরুদ্ধে কোন কথা বলতে দেখা যায় না। মূলত ব্যক্তিস্বার্থ এবং অর্থের লোভে এই ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে তারা নিশ্চুপ বলে সহজে প্রতীয়মান হয়। আপাতদৃষ্টিতে পার্বত্য চট্টগ্রামে এই ধর্মান্তর আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে দেখা যেতে পারে। বিশেষ করে  ভৌগোলিক ও কৌশলগত অবস্থানের কারণে বিদেশি শক্তিগুলোর কাছে এই অঞ্চলটির গুরুত্ব অপরিসীম। ভবিষ্যতে এখানে একটি  খ্রিস্টান রাষ্ট্র সৃষ্টি করতে পারলে একাধারে ভারত, চীন এবং মায়ানমার উপর কঠোর নজরদারি ও চাপ সৃষ্টি করা যাবে। সেইসাথে বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিকভাবে আরও দুর্বল করে কবিতার মাধ্যমে নিজ স্বার্থে ইচ্ছামত নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। এক্ষেত্রে এই ষড়যন্ত্রকে অনেকেই পূর্ব তিমুরের সাথে তুলনা করে থাকে। তাই ভবিষ্যতে এই অঞ্চলটির ভাগ্য যেন পূর্ব তিমুরের মতো না হয় সে বিষয়ে সরকার এবং দেশের জনগণকে সচেতন হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করি। একটি স্বাধীন সার্বভৌম এবং ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে যে কোন ব্যক্তি যে কোন ধর্ম গ্রহণ এবং পালনের অধিকার রয়েছে, তবে তবে এই ধর্মান্তরকরণ যদি সেটা শঠতা বা প্রতারণার মাধ্যমে হয় তখনই তা প্রশ্নবিদ্ধ হয়  যা পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে ঘটেছে। আমি আশা করব বাংলাদেশ সরকার এ বিষয়টি দিকে দৃষ্টিপাত করবেন এবং চট্টগ্রাম ভূখণ্ডকে বাংলাদেশ হতে বিচ্ছিন্ন করে একটি খ্রিস্টীয় জুমল্যান্ড রাষ্ট্রে পরিণত করার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে।

কথিত “আদিবাসী” জুম্ম জনগণের ঐতিহাসিক, ঐতিহ্যগত, প্রথাগত ও বিশেষ অধিকারের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধিকে মৃত আইন ঘোষণা করা কিংবা বাতিল বা অকার্যকর আইনে পরিণত করার জোর ষড়যন্ত্র চলছে। শাসনবিধির ক্ষতিকর প্রভাব কতটুকু? জেএসএসের এই নিয়ে অভিযোগই বা কেন, আসল রহস্য কী?

ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসকরা পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি ১৯০০ জারি করেছিলেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে বিশেষ মর্যাদা দিয়ে ১৯০০ সালের ১ মে থেকে এই শাসনবিধি কার্যকর হয়। যার পরিপ্রেক্ষিতে পার্বত্যাঞ্চলে রাষ্ট্রীয় প্রচলিত আইন অকার্যকর। দেশের সাংবিধানিক বিধিবিধান তোয়াক্কা না করে চলছে এই তথাকথিত শাসনবিধি বা মৃত আইন। এই কারণেই একই দেশে দুইটি আইন বিদ্যমান।

ব্রিটিশ কর্তৃক প্রণীত পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি বা পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন (চিটাগং হিল ট্র্যাক্ট ম্যানুয়েল ১৯০০) কে আইন হিসেবে ২০১৪ ও ২০১৬ সালে পৃথক দুই মামলার রায় দেয় সুপ্রীম কোর্টের পুর্ণ বেঞ্চ। hbf এর তথ্য অনুযায়ী, ২০০৩ সালে রাঙামাটি ফুডস প্রোডাক্ট লি. এক মামলায় হাইকোর্ট বেঞ্চ পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি কে ডেট ল বা অকার্যকর আইন বলে রায় দেয়। এ রায়ের ফলে ১৯৯৭ সালের ২-রা ডিসেম্বরের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির অংশ পার্বত্য জেলা পরিষদ, আঞ্চলিক পরিষদসহ এবং শাসনবিধির সৃষ্ট প্রথাগত প্রতিষ্ঠানসমূহ সংকটের মুখে পড়েছিল।
এ রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করা হলে সুপ্রীমকোর্ট ২০১৬ সালে ২২ নভেম্বর শাসনবিধিকে একটি কার্যকর ও বৈধ আইন বলে রায় দেয়।
অন্যদিকে সুপ্রীম কোর্ট বিচারধীন ওয়াগ্গা ছড়া টি স্টেট অপর এক মামলার ২০১৪ সালে ২ ডিসেম্বর রায় দেয়।
দুটি রায়ই শাসনবিধিকে কার্যকর বলে রায় দেয়।

উপরোক্ত এ রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৮ সালে সুপ্রীম কোর্টে রিভিউ করেছেন বাঙ্গালীদের পক্ষে খাগড়াছড়ি জেলার বাসিন্দা আব্দুল আজিজ আখন্দ ও আব্দুল মালেক। একাধিক আপিল শুনানির পর পরবর্তীতে রায়টি উচ্চ আদালত বাতিল করে মৃত আইন হিসেবে রায় দেয়। এই শাসনবিধি মৃত আইন হিসেবে রায়টি পার্বত্য চট্টগ্রামে রাষ্ট্রীয় শক্তিকে মজবুত করে। শাসনবিধি কে আইন হিসেবে বলবৎ করার জন্য আঞ্চলিক দলগুলো সম্প্রতি বিশেষ তৎপর হয়ে উঠেছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে স্থানীয় উপজাতি হেডম্যান-কার্বারী দিয়ে জনসমাগম করার মাধ্যমে রায়টি বলবৎ রাখার প্রচেষ্ঠা করছে। বর্তমানে আদাতলে শাসনবিধির আংশিক বাতিল করার উপর শুনানি চলছে।

এদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি চীপ সার্কেল এই নিয়ে তৎপরতা চালাচ্ছে। তাদের নেতৃত্ব রয়েছে চাকমা চীপ সার্কেল ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়।

পার্বত্য বাঙ্গালীরা নেতৃত্বহীন হওয়ার কারণে শাসনবিধির লাভ ক্ষতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয়। আদালত রায়টি যদি বলবৎ করে এর মারাত্মক প্রভাব পড়বে। এক বাঙ্গালী আরেক বাঙ্গালীর বিরুদ্ধে লেগে থাকে এসব নিয়ে বাঙ্গালীদের মধ্যে দিনদিন হানাহানি, অনৈক্য ও ভেদাভেদ বৃদ্ধি পাচ্ছে। যার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা দিনদিন বাড়ছে সেসাথে বাঙ্গালীর শক্তি হ্রাস পাচ্ছে।

উল্লেখ যে, পার্বত্য শাসনবিধি (১৯০০) এমন একটি মৃত আইন যেটি এ অঞ্চলের সরকার ও বাঙ্গালীদের ভূমি অধিকার খর্ব করে এবং এ অঞ্চলের সেনাবাহিনীর কার্যক্রমের উপর প্রভাব ফেলে। তথাকথিত শাসনবিধির মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের সবধরনের ভূমির মালিক উপজাতিরা। এই মৃত আইনের ক্ষমতাবলে হেডম্যান-কার্বারী ও সার্কেল চীপ সৃষ্টি। প্রথাগত ভূমি অধিকার উপজাতীয়দের এ অঞ্চলের সব ভূমির উপর অধিকার প্রতিষ্ঠা করবে। এই শাসনবিধিকে আইন হিসেবে রায় বলবৎ করলে অচিরেই পার্বত্য চট্টগ্রামের সবধরনের ভূমির নিয়ন্ত্রণ হারাবে রাষ্ট্র।

বিশেষ নোট: পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধির ক্ষতিকর প্রভাব রয়েছে এমন ২৭টি শব্দ বাতিল করার জন্য অ্যাটর্নি জেনারেল আদালতে প্রস্তাব দিয়েছে। অথাৎ সম্পূর্ণ শাসনবিধি বাতিলের পক্ষে নয় রাষ্ট্র। শুধুমাত্র ২৭টি শব্দ বাতিলের উপর শুনানি চলমান।

“গত ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ম্যাজিস্ট্রেট ফাতেমা বেগম মুক্তার নেতৃত্বে রাঙ্গামাটির সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত অপহৃত কল্পনার হদিস, অপরাধীদের গ্রেপ্তার ও শাস্তি এবং ভুক্তভোগী পরিবারের ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত না করেই কল্পনা চাকমা অপহরণ মামলাটি খারিজের আদেশ দিয়েছেন।” এমন আলোচিত মামলায় কেন খারিজ আদেশ দিয়েছিলেন? কে ছিলেন অপহৃত কল্পনা?

পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ কল্পনা চাকমা অপহরণ নাটক!

প্রতিবছর কল্পনা চাকমা ইস্যুতে বারবার একটি মিথ্যে সংবাদ চাউর করে প্রচার করার ব্যাপারটি অত্যান্ত দুঃখজনক। তাই সত্যিটা তুলে ধরার নিমিত্তে কল্পনা চাকমার কথিত অপহরণ ইস্যুর প্রকৃত সত্য উদঘাটনের প্রয়োজনীতা অনুভব করায় পাঠকদের জ্ঞাতার্থে বিশদভাবে পুনরায় তুলে ধরলাম-

পার্বত্য চট্টগ্রামে পান থেকে চুন খসলেই সেনাবাহিনীকে দোষারোপ করা আঞ্চলিক সন্ত্রাসীগোষ্ঠীর নিত্য নৈমিত্তিক রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটা নতুন কিছু নয়। জাতির অধিকারের দোহাই দিয়ে প্রতিনিয়ত পাহাড়ে অস্ত্রবাজি, চাঁদাবাজি, ধর্ষণ ও খুন-গুমসহ রাষ্ট্র ভাগ করার গভীর ষড়যন্ত্র মেতে আছে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীসমূহ। এ নিয়ে সচেতন মহল বরাবরই রহস্যজনকভাবে নিশ্চুপ! অথচ ১৯৯৬ সালে নিখোঁজ হওয়া কল্পনা চাকমা নামে জনৈক উপজাতি নারীকে নিয়ে সেনাবাহিনীকে মিথ্যে জড়িয়ে তাদের অপপ্রচারের কমতি নেই আজও। এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার আগে জানা দরকার, কে এই কল্পনা চাকমা?

কল্পনা চাকমা, পিতা: গুণরঞ্জন চাকমা, মাতা: বাঁধুনি চাকমা। গুণরঞ্জনের ৫ (পাঁচ) সন্তানের মধ্যে কল্পনা চাকমা সবার ছোট। রাঙামাটি জেলার সর্ববৃহৎ বাঘাইছড়ি উপজেলার লাল্যাঘোনা এলাকায় তার জন্ম৷ সে ছিল ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি তথা পিসিজেএসএস (তৎকালীন শান্তিবাহিনী) -এর সহযোগী অঙ্গ সংগঠন হিল উইমেন্স ফেডারেশন (এইচডব্লিউএফ) বাঘাইছড়ি শাখা কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদিকা’।

দীর্ঘদিন ধরে সন্ত্রাসীদের সহযোগী সংগঠনে কাজ করার সুবাদে তার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে ভারতের অরুণাচল প্রদেশে বসবাসরত অরুণ বিকাশ চাকমার। অরুণ বিকাশ চাকমা পিসিজেএসএস-এর ছাত্র সংগঠন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি) সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলো বলেও একাধিক সূত্রের তথ্যেই নিশ্চিত হওয়া যায়। অরুনের সাথে প্রেমের বিষয়টি কল্পনা চাকমার পরিবার যেমন মানতে পারেননি ঠিক তেমনি দলীয় অন্তর্কোন্দলে জড়িয়ে পড়া পিসিজেএসএস-এর একটি অংশও সেটা মানতে পারেনি।

পিসিজেএসএস প্রতিষ্ঠার পর থেকেই মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ও তার ছোটভাই সন্তু লারমা পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে সূদুরপ্রসারী নানা ধরণের ষড়যন্ত্রের ছক কষে আসছিল। কল্পনা চাকমা অপহরণের কাল্পনিক অভিযোগও তাদের সাজানো নাটকের একটি গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ হতে পারে। বিশেষজ্ঞদের দাবি, “অদূর ভবিষ্যতেও যেনো, কল্পনা চাকমা অপহরণ ইস্যুকে পুঁজি করে পার্বত্য চট্টগ্রামে সন্ত্রাসবাদ কায়েম ও নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করে রাষ্ট্র- প্রশাসনকে বিপাকে ফেলা ছিল তাদের মূল লক্ষ্য।”

তৎকালীন প্রকাশিত পত্রপত্রিকার প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়, ১৯৯৬ সালের ১১ জুন, গভীর রাতে অতি সঙ্গোপনে জেএসএসের একাংশ ও পিসিপি’র কতিপয় সন্ত্রাসীরা রাঙামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলার নিউ লাল্যাঘোনা এলাকা থেকে কল্পনা চাকমাকে অপহরণ করে স্বজাতির প্রেমিক অরুণ বিকাশ চাকমার কাছে ভারতের অরুণাচলে পাঠিয়ে দেয়।
এখানে বড় একটি কারণ, তৎকালীন শান্তিবাহিনী ১৯৯৬-এর সংসদ নির্বাচনে রাঙ্গামাটি জেলায় নিজস্ব প্রার্থী হিসেবে তাদের সহযোগী অঙ্গ সংগঠন পাহাড়ী গণপরিষদের কেন্দ্রীয় প্রেসিডিয়াম সদস্য বিজয় কেতন চাকমা-কে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করায়। তার পক্ষে প্রচারণা চালানোর জন্য পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ (পিসিপি), পাহাড়ী গণপরিষদ (পিজিপি) ও হিল উইমেন্স ফেডারেশন (এইচডব্লিউএফ)-কে নির্দেশনা প্রদান করেন।
কিন্তু কল্পনা চাকমা এইচডব্লিউএফ-এর নেত্রী হয়েও আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পক্ষে প্রচার-প্রচারণার কাজ চালাচ্ছিলেন। এতে করে শান্তিবাহিনীর সমর্থক পিসিপি, পিজিপি ও এইচডব্লিউএফ নির্বাচনে তাদের প্রার্থীর জয়লাভে শঙ্কিত হয়ে তাদের পথের কাঁটা কল্পনা চাকমা-কে সরিয়ে ফেলার জন্য এই অপহরণ করে বলে প্রাথমিকভাবে প্রতিয়মান হয়।

উপজাতি সন্ত্রাসীরা দাবি করে থাকে লেফটেন্যান্ট ফেরদৌস অপহরণের সঙ্গে জড়িত, এবং অপহরণের সময় শসস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা মুহুর্মুহু গুলি চালিয়ে এলাকাবাসীকে ভীতসন্ত্রস্ত করে!
কিন্তু কালিন্দী চাকমা এই ঘটনায় যে, মামলা করে তাতে সেনাবাহিনী এবং গোলাগুলির কথা একবারও উল্লেখ করেনি। উল্লেখ করেছে অপরিচিত কিছু সন্দেহভাজন লোকের কথা।

লেফটেন্যান্ট ফেরদৌস ঘটনার দিন সকালে নির্বাচন উপলক্ষে দায়িত্ব পালনের জন্য উগলছড়ি ক্যাম্পে আসেন, যা ছিল কল্পনা চাকমার বাড়ির নিকটবর্তী।
উগলছড়ি ক্যাম্পে তখন একজন মেজর, একজন ক্যাপ্টেন, দুজন লেফটেনেন্টসহ প্রায় ৯০ জন সৈনিক উপস্থিত ছিল।
সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা এবং নির্বাচন পরিচালনার কাজে নিয়োজিত কর্মকর্তারা সকলে ঐদিন উগলছড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে রাত যাপন করে।

এখন প্রশ্ন হলো সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা যদি মুহুর্মুহু গুলি চালিয়ে থাকে তাহলে এতশত মানুষের মধ্যে কেউ শুনলো না কেন??
সেনাবাহিনীর গুলিতে একজনও আহত কিংবা নিহত হলোনা কেন??
সেনাবাহিনী যদি সত্যিই অপহরণে জড়িত থাকতো কেনইবা মামলায় সেনাবাহিনীকে জড়ানো হলোনা???

প্রকৃত সত্য হলো-
অফিসার লে. ফেরদৌস বেশ কিছু সফল অপারেশন পরিচালনার মাধ্যমে শান্তিবাহিনীর বিদ্যমান দু’টি গ্রুপ এবং পিসিপি’র মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিলেন। তিনি ছিলেন উগলছড়ি ক্যাম্পের ক্যাম্প কমান্ডার। নির্বাচনের উদ্দেশ্যে তার ঐ ক্যাম্পে আগমন। খুব তাড়াতাড়ি তার এই সফলতা শান্তিবাহিনী এবং পিসিপির অস্ত্রবাজি, চাঁদাবাজি ও সাংগঠনিক তৎপরতার লাগাম টেনে ধরেন। বেশ করে সংসদ নির্বাচনে ভোট কারচুপি রোধ করার মত একটা পরিবেশ তৈরি হয়, এবং নির্বাচনে তারা তাদের পরাজয় নিশ্চিত জেনেই সংগঠনের সাংগঠনিক ভেঙে যাওয়ারও আশঙ্কা করেছিল। সে থেকে মূলত সেনা লে. ফেরদৌসের বিরুদ্ধে অপহরণের কাল্পনিক গল্পকাহিনী রচিত করে। সন্ত্রাসীরা এটা কাজে লাগায় তাদের পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে। যেটা তাদের মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ও সন্তু লারমা শিখিয়ে গেছে।


মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ও সন্তু লারমার সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্রের অংশ নিজেদের উদ্দেশ্য হাসিল করতে তাদের অনুসারী সন্ত্রাসীরা কল্পনা চাকমা অপহরণের দায়ভার সেনাবাহিনীর উপর চাপিয়ে দেয়। সেই থেকে উপজাতি সন্ত্রাসীরা কল্পনা চাকমা ইস্যুকে কাজে লাগিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে আসছে।

কথিত কল্পনা চাকমা অপহরণ নিয়ে তার আপন বড়ভাই কালিন্দী চাকমা মামলা দায়ের করেন। মামলাটি আদালত গত ২৩ এপ্রিল শেষ করেন, একইসাথে আসামীদের অব্যাহতি দেয়। এরপরও প্রতিবছর কল্পনা চাকমার কথিত অপহরণ দিবসটি আসলে সন্ত্রাসীদের সোচ্চার হতে দেখা যায়। রাজনৈতিক হীন উদ্দেশ্যে মিথ্যাচার করে রাষ্ট্র, প্রশাসন আর সেনাবাহিনীকে বেকায়দা ফেলতে তৎপর সন্ত্রাসীদের একটি মিথ্যে সাজানো অপহরণ নাটক আর কতকাল এভাবেই চলতে থাকবে?

‘অপারেশন উত্তরণ’-এর বদৌলতে সেনাবাহিনী ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক জুম্মদের উপর রাত-বিরাতে সামরিক অভিযান পরিচালনা করার বিষয়ে জেএসএস যে মানবাধিকার লঙ্ঘনের উপর যে, অভিযোগটি করেছে, তা সম্পূর্ণ মিথ্যাচার, অবান্তর এবং হীন উদ্দেশ্য অর্জনের লক্ষ্যে এমন প্রচারণা বলে সর্বমহল মনে করেন।

এমন অভিযোগটি করার পেছনে অন্যতম কারণ, জেএসএসের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছেই সেনাবাহিনী। জেএসএস ৫২ বছর ধরে পাহাড়ীদের শাসন-শোষণ করে আসছে৷ পাহাড়ীরা এই শাসন-শোষণ থেকে মুক্তি পেতে চায়। তারা নিরাপত্তা ও জানমাল হেফাজতে সেনাবাহিনীর সহযোগিতা চেয়ে সেনা ক্যাম্প বৃদ্ধিসহ অবৈধ অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অভিযান করার দাবি জানিয়ে আসছে। পাহাড়ে জেএসএস অস্ত্রবাজি, চাঁদাবাজি, খুন-খারাবি করে এ অঞ্চলকে নরকে পরিণত করছে। সেনাবাহিনী যখন অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজদের আটক করে তখন তাদেরকে নিরীহ বলে জেএসএস সন্তু কর্তৃক প্রচার করা হয়। জেএসএসের সন্ত্রাসী তৎপরতা চালাতে সমস্যায় পড়তে হয় সেনাবাহিনীর কারণে। তাই পাহাড়ে সেনাবাহিনীর উপস্থিতি বন্ধ করতে জেএসএস সবসময় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে কথিত মানবাধিকার লঙ্ঘন অভিযোগ সংবলিত অর্ধ-বাৎসরিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে থাকে। 

পাহাড়ে সেনাবাহিনীর প্রয়োজনীয়তা কতটুকু?

পার্বত্য চট্টগ্রামে চুক্তির পূূর্বেরকার মত গণহত্যা নাই ঠিক কিন্তু চাঁদাবাজি খুন-গুম, ধর্ষণ এবং পাহাড়ের আঁকে বাঁকে অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানি ও বারুদের গন্ধ এখনো অব্যাহত। পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি জেলার মোট আয়তন ১৩,২৯৫ বর্গ কিলোমিটার আর জনসংখ্যা- ১৮,৪২৮১৫ জন। এই পরিসংখ্যান পার্বত্য এলাকা হিসেবে যথার্থ। কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য এই জনপদের মানুষগুলো বরাবরই নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত। পার্বত্য চট্টগ্রামে অবৈধ অস্ত্রধারীদের দৌরাত্ম্য এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে সাধারণ মানুষের জানমাল ও নিরাপত্তা নিয়ে প্রতিটি মূহুর্তে ভাবতে হয়। চাঁদাবাজি, খুন-গুম ও অস্ত্রবাজি করতে যারাই ব্যর্থ হচ্ছে তারাই সেনাবাহিনীর বিরোধিতা করছে। এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে একটি কুচক্রি মহলও, এরা সেনাবাহিনীর কারণে নিজেদের অবৈধ ব্যবসা সম্প্রসারণ করতে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। তাই সেনাবাহিনীর প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা দিতে অপকৌশল চালাচ্ছে।

প্রেক্ষাপট বিবেচনায় পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়ন পরিস্থিতি যদি মূল্যায়ন করতে চান তাহলে অকপটে বলা যায়, বিগত কয়েকবছরে জীবনমানোন্নয়নে ব্যাপক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছে সরকার। এবং এখানকার পিছিয়ে পড়া উপজাতি জনগোষ্ঠী শিক্ষা-দীক্ষা, চাকরি-বাকরি ও কর্মসংস্থানে অনেক এগিয়ে গেছে। কিন্তু পক্ষান্তরে একটি অপ্রিয় সত্য স্বীকার করতে হবে, পার্বত্য বাঙ্গালী জনগোষ্ঠী ক্ষেত্রেই পিছিয়ে আছে। আর নিরাপত্তা পরিস্থিতি মূল্যায়নে বলতে গেলে হতাশা কণ্ঠে বলতে হয় নিরাপত্তার দিক দিয়ে পাহাড়ি বাঙ্গালী উভয়ই সম্প্রদায় নিরাপত্তাহীনতায় ভোগছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে সন্ধ্যা ৬টার পর অনেক এলাকায় গাড়ি চলাচল করেনা। এ অঞ্চলের বেশিরভাগই সড়কে রাত্রে গাড়ি চলাচল করেনা সন্ত্রাসীদের ভয়ে। নাগরিক ভোগান্তি কমাতে সরকার যাতায়াত ব্যবস্থা উন্নতকরণের নানা প্রকল্প হাতে নিয়েছে; সমতলের পাশাপাশি পাহাড়ে নতুন নতুন অনেক সড়ক নির্মাণ হয়েছে; এসব সড়কে রাতের চলাফেরা দূরে থাক, দিনে-দুপরে পর্যন্ত চলাচল সীমিত; সন্ত্রাসীদের এতটাই দৌরাত্ম্য যার প্রভাব জনজীবনে পড়েছে; এমন নাজুক পরিস্থিতিতে পাহাড়ে সেনাবাহিনী একমাত্র প্রধান ভরসা।

১৯৯৭ সনের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের আলোকে বা শর্ত অনুযায়ী ২৩৯ টি সেনা ক্যাম্প পাহাড় থেকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়ায় এলাকাগুলোতে সন্ত্রাসীদের দৌরাত্ম্য বৃদ্ধি পায়; সাধারণ মানুষের জানমাল ও নিরাপত্তা সংকট তৈরি হয়। নতুন করে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে যদি সেনাবাহিনী চলে যায় এখানকার মানুষের উপর স্টিমরোলার চালানো যেমন হবে তেমনি গণহত্যা সংগঠিত করার মাধ্যমে জাতিগত নিধন করা হবে। সেনাবাহিনী আছে বিধায়ী সন্ত্রাসীরা অপ্রকাশ্যে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালালেও সরাসরি মানুষের জানমাল ও নিরাপত্তায় ক্ষতিসাধন করার মতো দুঃসাহস প্রদর্শন করছে না। এটি সেনাবাহিনীর আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সাথে দ্বায়িত্ব পালন আর পাহাড়ি বাঙ্গালীর মধ্যে শান্তি-সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার সাফল্য বলা যায়।

পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে যে আশঙ্কা আমরা ব্যক্ত করি তা হলো- সেনাবাহিনীর অনুপস্থিতিতে গণহত্যায় বাঙ্গালী প্রধান টার্গেটের পরিণতি হলেও উপরন্তু উপজাতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলো গণহত্যার শিকার হতে পারে। এখানে চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা প্রভাবশালী হলেও বাকী ১০ টি জাতিগোষ্ঠী অনেক ক্ষুদ্র। যে পার্বত্য চট্টগ্রামে চাঁদাবাজি, আধিপত্য বিস্তার ও জাতিগত সমস্যাটা প্রকট তাই নিঃসন্দেহে বলা যায়, এখানকার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী নিধন হতে পারে। পার্বত্য চট্টগ্রামের মত বিচ্ছিন্নতাবাদ প্রবণ এলাকায় যেখানে সন্ধ্যা নামলে সড়কে গাড়ি আর মানুষ থাকে না সেখানে সেনাবাহিনী ছাড়া মানুষের নিরাপত্তা কতটা সংকট তৈরি হতে? পারে তা নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করার গুরু দায়িত্ব আপনাদের কাঁধে।

“গত ২ ও ৩ এপ্রিল কেএনএফ কর্তৃক রুমা ও থানচিতে ব্যাংক এবং রুমা থেকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ১৪টি আগ্নেয়াস্ত্র লুটের ঘটনার ফলে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে যৌথবাহিনী কেএনএফের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানের দোহাই দিয়ে নিরস্ত্র নিরীহ বম গ্রামবাসীদেরকে- নারী, শিশু, গর্ভবর্তী নারী নির্বিশেষে- ধর-পাকড়, শারিরীক নির্যাতন, গ্রেফতার ও জেলে প্রেরণ, কেএনএফ তকমা দিয়ে ঠান্ডা মাথায় গুলি করে হত্যা ইত্যাদি চালিয়ে যাচ্ছে।”
এটি জেএসএস প্রতিবেদনে মারাত্মক আকারে লিখলেও বাস্তবিক অর্থেই অভিযোগটি সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট এবং অপপ্রচার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে পার্বত্য চট্টগ্রামে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড কায়েম করতে নিরাপত্তা বাহিনীকে সরাতে নতুন ষড়যন্ত্র।

সেনাবাহিনীর নেতৃত্বধীন যৌথবাহিনীর হাতে আটককৃত ব্যক্তিরা কেউ নিরপরাধ নয়। তারা কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) এর সক্রিয় সশস্ত্র সদস্য এবং সহযোগী হিসেবে প্রমাণিত হওয়াই তাদের বিরুদ্ধে আইন- শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে৷ জেএসএস সন্তু সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানে আটক কেএনএফ সদস্যদের নিরীহ বা নিরপরাধ মানুষ বলে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করার ব্যর্থ চেষ্টা করছে। কেএনএফ তিনটি ব্যাংক ডাকাতি এবং পুলিশের ১৪ টি অস্ত্র লুটপাট করার পাশাপাশি নিরাপত্তা বাহিনীর বেশ কয়েকজন সদস্য হত্যাকরাসহ পর্যটক ও সাধারণ মানুষের ক্ষতিসাধন করে আসছে। যা ক্ষমার অযোগ্য৷ তাদের অপরাধের শাস্তি স্বরূপ চলমান অভিযান আরো কঠোর থেকে কঠোর করা উচিত। মানবাধিকার প্রশ্নে এখানে সেনাবাহিনী আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি সর্বদা শ্রদ্বাশীল। সবসময় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী মানবাধিকার প্রশ্নে কাজ করে। সুতরাং কেউ এখানে নির্যাতন বা বিনা অপরাধে গ্রেফতার কিংবা হয়রানির শিকার হচ্ছে না। জেএসএস কর্তৃক উত্থাপিত অভিযোগ যে ডাহামিথ্যে তা আবারো প্রমাণিত। যেসব বম মিজোরাম আশ্রয় নিয়েছে তাদেরকে রাজনৈতিক হীন উদ্দেশ্য অর্জনের লক্ষ্যে কেএনএফ বাস্তুচ্যুত করেছে। এই বিষয়ে অনেক বম শরণার্থী জানিয়েছেন। তার তথ্য প্রমাণও ইতোমধ্যে সামনে আসতে শুরু করেছে।

“বাঘাইছড়ি উপজেলায় সীমান্ত সড়ক ও সীমান্ত সংযোগ সড়ককে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও বিজিবি স্থানীয় আবাসভূমিতে স্থানীয় নামের বিপরীতে মুসলিম ব্যক্তির নামে নামকরণ করে সাইনবোর্ড টাঙ্গিয়ে দিয়েছে।”

উক্ত অভিযোগটি উদ্দেশ্যপ্রোণোদিত। কোন স্থান বা জায়গার নামকরণ হয় সে এলাকার গুণিজন ও বরণ্য বা বিশেষ ব্যক্তিদের খ্যাতির উপর নির্ভর করে। সেখানে পাহাড়ি ও বাঙ্গালী কিংবা ধর্ম-বর্ণ বিবেচ্য বিষয় নয়। এইধরনের প্রসঙ্গ নিয়ে অভিযোগ একটি সাম্প্রদায়িক মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ।

প্রশাসন ও নিরাপত্তা বাহিনীর নিপীড়ন-নির্যাতন প্রসঙ্গে-

“২০২৪ সালের জানুয়ারি হতে জুন মাস পর্যন্ত সংঘটিত ১০৭টি ঘটনার মধ্যে নিরাপত্তা বাহিনী ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক ৭৩টি ঘটনা সংঘটিত হয়েছে এবং এতে কমপক্ষে ৫,০০০ বমসহ ৫,৩৯৪ জন, কমপক্ষে ১,০০০ বম পরিবারসহ ১,২৮৪ পরিবার ও ৪৭টি বম গ্রামসহ ৬৭টি গ্রামের লোক মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়েছে।” এটি একটি মিথ্যা প্রচারণার অংশ বিশেষ। সাংগঠনিকভাবে জেএসএস অনেকটাই কোনঠাসা। যার কারণে এই ধরনের তথ্যহীন, অবান্তর ও অস্তিত্বহীন প্রতিবেদন তৈরি করে সরকারের উপর চাপ বাড়াতে বিশেষ তৎপরতা চালাচ্ছে বলে প্রাথমিকভাবে প্রতিয়মান।

জেএসএসের মানবাধিকার লঙ্ঘন বিষয়ক অর্ধ-বাৎসরিক প্রতিবেদনমূলক অভিযোগটি সম্পূর্ণ রাজনৈতিক হীন উদ্দেশ্যে থেকেই করা হয়েছে বলে একচেটিয়া, একগুঁয়ে আচরণ ও দোষারোপ থেকে প্রতিয়মান হয়েছে৷ পার্বত্য চট্টগ্রামে কোনকালেই প্রশাসন ও নিরাপত্তা বাহিনী মানবাধিকার লঙ্ঘন করেনি। রাষ্ট্র উপজাতি জনগোষ্ঠীর অধিকার ও সাংস্কৃতিক ও ঐতিহ্য রক্ষায় সবসময় আন্তরিক ছিলো। উপজাতি বিচ্ছিন্নতাবাদ অস্ত্র শক্তির মাধ্যমে দমন না করে রাজনৈতিক উপায়ে সমাধানে সবসময় চেষ্টা করেছে। এই উদার নীতি রাষ্ট্র বরাবরই দেখিয়ে আসছে— যেটা আমরা দেখেছি ৯৭’ চুক্তির মাধ্যমে এবং কেএনএফের সঙ্গে শান্তি কমিটির কয়েক দফায় চলা বৈঠকের মাধ্যমেই।
বলাবাহুল্য যে, আঞ্চলিক দলগুলো চাঁদা আদায়ে ব্যর্থ হলে সাধারণ পাহাড়ীদের অপহরণ করে পশুর ন্যায় গুলি করে হত্যা করে৷ *আমরা ভুলে যাইনি রাঙামাটি জুরাছড়ি উপজেলার কিনা মোহন চাকমার কথা। যাকে জেএসএস গাছের সাথে পেরেক মেরে এবং গায়ের চামড়া তুলে হত্যা করেছিল! এই নিষ্ঠুরতম হত্যাকাণ্ডের জঘন্যতম ইতিহাস কিনা মোহন চাকমার পুত্র ভাইস-চেয়ারম্যান রূপ কুমার চাকমা রাঙামাটি জিমনেসিয়াম মাঠে এক মহা-সমাবেশে কান্না কন্ঠে হাজারো জনতার মাঝে বলেছিলো। আজকে মানবাধিকার পক্ষে কথা বলা আঞ্চলিক দল জেএসএস সন্তুর মুখে মানবাধিকার লঙ্ঘন বিষয়ক কথা ভুতের মুখে রাম রাম শোনার মত প্রবাদে পরিণত হয়েছে।*

পাহাড়ে অগণিত হত্যা, অপহরণ,  খুন-গুম, চাঁদাবাজি, নারী ধর্ষণ ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনা কিন্তু জেএসএস ও ইউপিডিএফসহ অন্যান্য আঞ্চলিক দলগুলো কর্তৃক সংগঠিত করা হয়। চাঁদাবাজি ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে রক্তারক্তি সংঘর্ষ সৃষ্টি হয়। এই সংঘর্ষে প্রাণ হারান নিরীহ মানুষ। যার বাস্তব প্রমাণ পার্বত্য চট্টগ্রামে কয়েক বছরের ঘটনাগুলোর দিকে তাকালে প্রমাণ পাওয়া যাবে। পত্র-পত্রিকাগুলোতে সামান্য হলেও কিছু ঘটনা উঠে আসে।

“৪ জানুয়ারি হতে ৭ জানুয়ারির পর্যন্ত রাঙ্গামাটি সদর উপজেলার বালুখালী ইউনিয়নে বাদলছড়ি জনকল্যাণ বৌদ্ধ বিহারের জায়গায় সুবলং সেনা ক্যাম্প থেকে ক্যাপ্টেন মো: শফিক ও জনৈক সুবেদারের নেতৃত্বে এক সেনা টহল দল কর্তৃক বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি অবমাননা ও পরিহানি করে থাকে। সেনা সদস্যরা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বিহারের জায়গাতেই সাউন্ড বক্স দিয়ে প্রতিদিন আজান দেয় এবং বিহারের আশেপাশে খোলা জায়গাতেই মলমূত্র ত্যাগ করে পরিবেশ দূষিত করে থাকে।”

এমন অভিযোগ খুব গুরুতর, কিন্তু কেন জানি অভিযোগটি নিয়ে মনে সন্দেহের অবকাশ তৈরি হয়। তাই অনুসন্ধানে নামি। অনুসন্ধান করে জানা যায়, বাদলছড়ি জনকল্যাণ বৌদ্ধ বিহারে জেএসএস সন্তুর সশস্ত্র গ্রুপের সদস্যসহ কয়েকজন চাঁদা কালেক্টর রাত্রে ঘুমান। এমনকী জেএসএসের যেসকল নেতাকর্মীর নামে থানায় পরোয়ানা রয়েছে, এমন নেতাকর্মীরা বিহারে ঘুমান এবং বিহারকে ব্যবহার করেন সংগঠনের কাজে৷ যার কারণে সেনাবাহিনী একটি দল একজন ক্যাপ্টেন ও জেসিও’র নেতৃত্বে সন্ত্রাসীদের ধরতে বিহার এলাকায় তৎপরতা বৃদ্ধি করতে গেলেই জেএসএস পক্ষ থেকে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি অবমাননা ও পরিহানি করে থাকে। এমন অভিযোগ করা হয়! যা জেএসএসের বিরুদ্ধে অভিযান ঠেকাতে এবং সেনাবাহিনীকে বিতর্কিত করতে করা হয়েছে বলে অনুসন্ধানে জানা যায়।

সীমান্ত সড়ক নিয়ে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অপপ্রচার প্রসঙ্গে-

আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী সীমান্ত সড়ক প্রতিটি দেশের নিরাপত্তা এবং সার্বভৌমত্বের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম দুর্গম পাহাড় ও প্রতিকূল পরিস্থিতি এটা কারো অজানা থাকার কথা নয়। যাতায়াত ব্যবস্থা নেই বললেই চলে; সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে তিন হাজার ফুট উপরে; দুর্গম পাহাড়, নেই কোনো পানি ও খাবারের ব্যবস্থা; নেই নেটওয়ার্ক সংযোগ নেই; বিচ্ছিন্ন ভাবে বসবাস করা পাহাড়ি জনগোষ্ঠী কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে উপজেলা বা জেলা সদরে নেওয়ার মত ব্যবস্থা নেই। এমন এক অঞ্চল খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি এবং বান্দরবান নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম। সবচেয়ে বিস্ময়কর বিষয়- ত্রিদেশীয় এলাকায় নেই সীমান্ত সড়ক এবং কাটা তারের বেড়া! যার কারণে সীমান্তে চোরাচালান এবং অবৈধ অস্ত্র আনা নেওয়াসহ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দৌরাত্ম বেড়ে গেছে। স্থানীয়রা বলছে- ত্রিদেশীয় সীমান্ত এলাকায় হওয়ার কারণে বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলো পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতিবেশী দেশগুলোর সংলগ্ন গহীন অরণ্যকে নিজেদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড এবং আশ্রয়স্থল হিসেবে বেছে নিয়েছে৷ সীমান্তে প্রায় ৭৪ কিলোমিটার এলাকায় ছিলো না কাটা তারের বেড়া; নেই সীমান্ত সড়ক। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে জেএসএস সন্তু, ইউপিডিএফ প্রসিত, জেএসএস সংস্কার, গণতান্ত্রিক ইউপিডিএফ, মগ পার্টি ও কেএনএফ’সহ বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে ভারী অস্ত্র সংগ্রহ, প্রশিক্ষণ গ্রহণ এবং দেশগুলোতে আশ্রয় শিবির ও ঘাঁটি করে বসেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে যখন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী অভিযানে নামে তখনি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলো প্রতিবেশী দেশের আশ্রয়স্থল ও ঘাঁটি গুলোতে পালিয়ে যায়।
এছাড়াও সীমান্তে চোরাচালান বন্ধে সীমান্ত সড়ক এবং কাটা তারের বেড়া প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী সব দেশে আছে সীমান্ত সড়ক। মূলত সীমান্তে নিরাপত্তা জোরদার এবং এখানকার জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রা ও যাতায়াত ব্যবস্থার মানোন্নয়নে সরকার এজন্যেই সীমান্ত সড়ক নির্মাণ প্রকল্প হাতে নেয়। প্রকল্পটি গুণগতমান নিশ্চিত ও যথাসময়ে সম্পন্ন করতে বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয়া হয় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে। সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কন্সট্রাকশন ব্রিগেডের ১৬, ২০ ও ২৬ ইঞ্জিনিয়ার কন্সট্রাকশন ব্যাটালিয়ন প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। কয়েকটি পর্যায়ে সম্পন্ন করা হবে এক হাজার ৩৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে সড়কটি। প্রথম পর্যায়ের ৩১৭ কিলোমিটার কাজ শেষ হতে আর কিছু সময় বাকি। ইতোমধ্যে দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে সড়কটি। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। সড়কটিকে ঘিরে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে পর্যাটন শিল্প বিকাশের। পর্যাটন শিল্প একটি অঞ্চলের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর ভাগ্যের চাকা পরিবর্তন করে দিতে পারে। দেশের একমাত্র সীমান্ত সড়ক নির্মিত হচ্ছে পাহাড়চূড়ায়। এটির মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিশ্বের কাছে নতুন করে পরিচয় পাবে। এ অঞ্চলের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন যেমন হবে তেমনি পর্যটন শিল্পের বিকাশের মাধ্যমে এখানকার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য বিশ্বের দরবারে উঠে আসবে, স্থানীয়দের কর্মসংস্থানও সৃষ্টি হবে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালিত হোক তা চায়না ইউপিডিএফ-জেএসএস’সহ আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো। কারণ এ অঞ্চলে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের অংশ হিসেবে রাস্তাঘাট, যাতায়াত ব্যবস্থা ও সরকারি অবকাঠামো তৈরি হলে সন্ত্রাসীদের চাঁদাবাজি, অপহরণ বাণিজ্য এবং আলাদা রাষ্ট্র গঠন করার পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে। মূলত তারই কারণে সন্ত্রাসীরা সরকারের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড এবং সেনাবাহিনী কর্তৃক নির্মিত সীমান্ত সড়কের বিরোধিতা করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেনাদের বিরুদ্ধে চরম মিথ্যা ও বানোয়াট অপপ্রচার ছড়িয়ে দিচ্ছে। পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে উচ্ছেদ করার যে অভিযোগ তুলছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট। আমরা সমতলেও দেখে থাকি সরকারি উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড সাধিত করতে গিয়ে কিছু বাড়ি ঘর বা স্থাপনা সরাতে হয় তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে সীমান্ত সড়কের মধ্যে অবস্থিত কিছু বাড়ি-ঘর। সীমান্ত সড়কের বেশিভাগ জায়গা সরকারের ১ নং খতিয়ানের জায়গা অথাৎ খাস ভূমি। পার্বত্য চট্টগ্রামের সীমান্ত এলাকা জুড়ে বিচ্ছিন্ন বসতি রয়েছে৷ এখানে হাজার হাজার বা শত শত পাহাড়ি উচ্ছেদ বা বাস্তুহারার সম্ভাবনা নেই৷ সড়ক নির্মাণস্থলে অবস্থিত কিছু ঘর-বাড়ি সরাতে হচ্ছে। তারজন্য সেনাবাহিনী পরিবারগুলোকে যথাসময় দিচ্ছে এবং বিকল্প জায়গাও দিচ্ছে। তাকে পুঁজি করে জেএসএসসহ আঞ্চলিক দলগুলো সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যেভাবে মিথ্যাচার রটাচ্ছে তা প্রত্যাশিত। সেনাবাহিনী কেবলমাত্র প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে৷ প্রকল্পটি সেনাবাহিনীর নিজেস্ব কোন প্রকল্প নয়। এটি মূলত সীমান্ত সড়ক এবং সরকারের উন্নয়নমূলক কিংবা সীমান্ত সড়ক প্রকল্প। তাই সীমান্ত সড়ক নিয়ে সেনাবাহিনীকে দোষারোপ করা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপপ্রচার করা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক বলে সচেতন মহল মনে করেন৷ প্রকল্পটি সম্পূর্ণ বাস্তবায়িত হলে সীমান্ত এলাকার নিরাপত্তা যেমন জোরদার হবে তেমনি এ অঞ্চলের সংঘাত, হানাহানি ও অস্ত্রবাজি কমে আসবে। তারই পাশাপাশি খাগড়াছড়ি রামগড় থেকে বান্দরবান বা কক্সবাজার পর্যন্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরি হবে।

“সেনা-মদদপুষ্ট সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর তৎপরতা”  অভিযোগ প্রসঙ্গে- 

পাহাড়ি সংগঠনগুলো চাঁদাবাজি ও আধিপত্য বিস্তারসহ নানা ইস্যুকে একে অপরপক্ষের বিরুদ্ধে সংঘাতে লিপ্ত৷ এই সংঘাত দিনদিন বাড়ছে। একপক্ষ অপরপক্ষকে ঘায়েল করতে সেনা-মদদপুষ্ট বা বিভিন্ন তকমা দিয়ে প্রতিহত করার চেষ্টাসহ জনমনে নেতিবাচক প্রভাব তৈরির চেষ্টা করে। তারই ধারাবাহিকতায় জেএসএস ও ইউপিডিএফ অন্যান্য সংগঠনগুলোকে সেনা-মদদপুষ্ট বলে উল্লেখ করে। বস্তুতঃ এই অভিযোগ একে অপরকে সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংগঠনিকভাবে ঘায়েল করতে ব্যবহার করে থাকে। এসব কথার কোন ভিত্তি কিংবা সত্যতার বিন্দুমাত্র রেশ নেই।

পাহাড়ে সাধারণ মানুষ অপহরণ ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনাগুলো কেন হয়?

মূলত আঞ্চলিক দলগুলো একপক্ষ অন্যপক্ষের তথ্য আদান-প্রদানের জন্য সাধারণ মানুষের পক্ষ থেকে সোর্স নিয়োগ করে। এই তথ্য ফাঁস হয়ে গেলে প্রতিপক্ষ দল সোর্সকে অপহরণ পূর্বক হত্যা করে। এবং একই সাথে পাহাড়ীরা আঞ্চলিক দলকে চাঁদা প্রদানে অস্বীকৃতি জানালে কিংবা তাদের কথার অবাধ্য হলে তাকে মোটা অংকে জরিমানাসহ হত্যা করে থাকে। সুন্দরী পাহাড়ী নারী সন্ত্রাসী সংগঠনের কারো কুদৃষ্টিতে পড়লে সে যদি অবাধ্য হয় তাকে হত্যা করে। এসব হত্যাকাণ্ডের জন্য সেনাবাহিনীকে তারা দায় করে চরম মিথ্যা ও অপপ্রচার করে স্বার্থ হাসিল করে সন্ত্রাসীরা।

“১৩ জানুয়ারি ২০২৪ জুরাছড়ি উপজেলা সদর এলাকায় স্থানীয় সেনাবাহিনীর মদদে একদল বহিরাগত মুসলিম সেটেলার বাঙালি কর্তৃক এক জুম্ম গ্রামবাসীর ভূমি বেদখলের চেষ্টা করা হয়। যক্ষাবাজার সেনা ক্যাম্পের ক্যাম্প কমান্ডার ক্যাপ্টেন মোশাররফ এর নেতৃত্বে যক্ষাবাজার সেনা ক্যাম্পের সেনা সদস্যরা ভূমি বেদখলে প্রতিবাদকারী নারী-পুরুষদের মধ্যে থেকে ৫ জন জুম্মকে ক্যাম্পে ধরে নিয়ে ব্যাপক মারধর করে।”

প্রকৃত ঘটনা হলো- বিলাইছড়ি উপজেলার কেংড়াছড়ি ইউনিয়নের রেইংখ্যং ৪নং ওয়ার্ডে বাঙ্গালী মনির হোসেনের রেকর্ডীয় প্রায় ২.০০ একর পরিমাণ ধান্য জমি আছে। মেম্বার জ্ঞান রঞ্জন তালুকদার বাঙ্গালীর রেকর্ডীয় জমি বেদখলের চেষ্টা করে। এসময় মনির হোসেনের নেতৃত্বে একদল বাঙ্গালীরা ধান রোপন করতে গেলে জেএসএসের নির্দেশে একদল উগ্র উপজাতি বাধা প্রদানসহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাহাঙ্গামা সৃষ্টির পায়তারা করে। পরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনী জেএসএস সমর্থিত ৫ জনকে ক্যাম্পে ডেকে নিয়ে বিরোধীপূন্য জমিতে উভয় পক্ষকে যেতে নিষেধ করেন। এই ঘটনাটিকে সাম্প্রদায়িক রং দিয়ে জেএসএস সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অপপ্রচারে লিপ্ত হয়।

আগের পোস্টপাহাড় ধ্বসে বান্দরবান-রুমা সড়কে যান চলাচল বন্ধ, সেনাবাহিনীর তৎপরতায় পুনরায় যান চলাচল স্বাভাবিক।
পরের পোস্টসেনাবাহিনীর বিরামহীন প্রচেষ্টায় সাজেকে যানচলাচল স্বাভাবিক, ফিরছেন আটকে থাকা পর্যটকরা।

রিপ্লাই দিন

আপনার কমেন্ট লিখুন
আপনার নাম লিখুন