আঞ্চলিক দলগুলোর আদর্শগত পার্থক্য কী?

0

পাহাড়ে এই মুহূর্তে ছয়টি আঞ্চলিক দল রয়েছে। দলগুলোর গঠন উদ্দেশ্য ও কার্যপদ্ধতি আদর্শগত দিকদিয়ে একটি থেকে আরেকটির পার্থক্য লক্ষণীয়। আঞ্চলিক দলগুলোর আদর্শগত দিক হলো রাস্ট্রে বিরোধিতা করা, অধিকারের নামে স্বজাতি থেকে চাঁদাবাজি করা, খুন-খারাবি, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাহাঙ্গামা ও অস্ত্রবাজির মাধ্যমে সন্ত্রাসবাদ কায়েম করা এবং এ অঞ্চল থেকে বাঙ্গালীকে বিতাড়িত করা। এর বাহিরে তাদের ইতিবাচক আদর্শ নেই। নেতিবাচক আদর্শে ভরপুর আঞ্চলিক দলগুলোর কার্যক্রমে। নেতিবাচক আদর্শের বাহিরে বাটি চালান দিয়েও তাদের ইতিবাচক কিছু খুঁজে পাওয়া যাবে না।

ছয়টি আঞ্চলিক দলের মধ্যে পার্থক্যের কারণগুলো কী কী—
আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বিগত পাঁচ দশকের অধিক সময় ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সংহতি সমিতি বা জেএসএস গৌরবময় সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি জনগোষ্ঠীর প্রথম সংগঠন হিসেবে ৪ দফা দাবিতে ১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারী প্রতিষ্ঠা লাভ করে। জেএসএসের সশস্ত্র শাখা সাধারণত সরকারি বাহিনী ও বাঙ্গালী বসতি স্থাপনকারীদের সাথে লড়াই করে আসছে। দাবিদার পূরণের প্রেক্ষিতে শান্তি বাহিনীকে নিরস্ত্রীকরন ও জেএসএসকে রাজনীতির মূল ধারায় ফিরিয়ে আনার জন্য ১৯৯৭ সালে সরকারের সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু জেএসএস চুক্তির দু’টি মৌলিক শর্ত লঙ্ঘন করে সশস্ত্র অবস্থায় এখনো বিদ্যমান। জেএসএসের সঙ্গে যে বিরোধ তৈরি হয়েছে অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর তা হলো, পার্বত্য চট্টগ্রাম হচ্ছে ১৩টি ক্ষুদ্র জাতির আবাসভূমি। এখানে জুম্ম জাতি হচ্ছে চাকমা জাতীয়তাবাদ বা জাতি৷ জেএসএস চাকমা জাতীয়তাবাদ কীভাবে অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর উপর চাপিয়ে দেয়? প্রতিটি জাতির স্ব-স্ব পরিচয় আছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের ১৩ টি উপজাতি পরিচয়ে স্বীকৃত জাতি কেন জুম্মা জাতি হতে হবে? তা নিয়ে প্রশ্ন ও অধিকার সমবণ্টন বিষয়ে যথেষ্ঠ বৈষম্য ও অনিয়ম আছে। জেএসএস একটি পুরাতন আঞ্চলিক দল হিসেবে সন্ত্রাসী চাঁদাবাজি, খুন-গুম ও চাকমা প্রীতির কারণেই নিজেদের নামের সুবিচার করতে পারেনি। এছাড়াও ১৯৯৮ সালের ২-রা ডিসেম্বর চুক্তি প্রত্যাখ্যান করে স্বায়ত্তশাসন দাবিতে প্রতিষ্ঠিত প্রতিপক্ষ ইউপিডিএফ জেএসএসের জন্য গলার কাঁটা হিসেবে দাঁড়িয়েছে। তাদের এযাত নেতিবাচক আদর্শ কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যান্য আঞ্চলিক দলগুলো রপ্ত করেছে। যার প্রভাব ইতোমধ্যে পড়েছে। জেএসএস যে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছে এই চুক্তির তীব্র বিরোধী ইউপিডিএফ। জেএসএস কে পার্বত্য চট্টগ্রামের জাতিগোষ্ঠীর একক আঞ্চলিক দল বা অভিভাবক হিসেবে মানতে নারাজ এ অঞ্চলের জনগণ।
ইউপিডিএফ চুক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে জেএসএস ও সরকার মধ্যকার চুক্তি বানচাল করতে মরিয়া। ইউপিডিএফ সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দাবি করেন। এই দাবিতে তাদের সশস্ত্র ও রাজনৈতিক কার্যক্রম চলমান। এছাড়াও তারা জেএসএস অধিকৃত এলাকাগুলো দখলে নিতে তৎপরতা চালাচ্ছে। জেএসএসের সব অর্জন নস্যাৎ করে দিয়ে পাহাড়ে পরাশক্তি হিসেবে পাহাড়ি জাতিসত্তার অধিকার আদায়ে অন্যতম হিসেবে নিজেদের প্রমাণ করতে মরিয়া। কিন্তু তাদের নেতৃত্বের সিংহভাগই চাকমা জনগোষ্ঠী হতে। তাদের আন্দোলন একটি নিদিষ্ট সম্প্রদায়কে ঘিরে ও ইস্যু ভিত্তিক। বৈষম্যে সম্পৃক্ত ইউপিডিএফ কীভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা করবে এ প্রশ্ন সকল জাতিগোষ্ঠীর। এখানে জেএসএস ও ইউপিডিএফ ব্যক্তিগত স্বার্থে অভিন্ন কিন্তু দলগুলোর গঠন উদ্দেশ্য ও কার্যপদ্ধতি আদর্শগত পার্থক্য আছে। পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দাবি করে পাহাড়ীদের অধিকার সম্পর্কিত পার্বত্য চুক্তির বিরোধীতা কিন্তু ইউপিডিএফ ও জেএসএস মধ্যে পার্থ্যক তৈরি করেছে।

সন্তু লারমার জেএসএসের নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করে সুধাসিন্ধু খীসার নেতৃত্বধীন ২০১০ সালের ৪ এপ্রিল এমএন লারমার আদর্শের নামে নতুন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস সংস্কার) গঠিত হয়। ক্রমান্বয়ে এই তিন আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল আদর্শগত বিরোধে সংঘাতে নামে। জেএসএস সংস্কার দল জনবল, শক্তিগত দিক ও আধিপত্য প্রশ্নে জেএসএস ও ইউপিডিএফ মূল থেকে অনেক পিছিয়ে। তারা আপাতত দৃষ্টিতে পরাশক্তি জেএসএস ও ইউপিডিএফের উপর চোরাগোপ্তা হামলা করার মাধ্যমে এবং অপহরণ বাণিজ্যের মাধ্যমে টিকিয়ে আছে নিদিষ্ট কিছু এলাকায়৷ জাতিসত্তার অধিকার প্রশ্নে তাদের অর্জন জিরো। অধিকারের নামে প্রতিপক্ষ দমনে আগ্রাসী।

গত ২০১৭ সালের ১৫ ডিসেম্বর ইউপিডিএফ (প্রসিত) থেকে বহিষ্কৃত ও বেরিয়ে যাওয়া নেতাকর্মীদের একটি অংশ তপন জ্যোতি চাকমা ওরফে বর্মার নেতৃত্বে পৃথক ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক) নামে পৃথক আরেকটি দল গঠন করে।
ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক দলের প্রতিষ্ঠাতা বর্মা ইউপিডিএফ প্রসিতের গুলিতে নিহত হওয়ার পর দলটির দায়িত্ব নেন শ্যামল কান্তি চাকমা। গণতান্ত্রিক তারাও জেএসএস সংস্কারের পথের অনুসারী৷ জন্মলগ্ন থেকে গণতান্ত্রিক ও সংস্কার জোট বেঁধে জেএসএস ও ইউপিডিএফের উপর চোরাগোপ্তা হামলা করতে ব্যস্ত। প্রতিশোধের নেশা ছাড়া জাতির অধিকার আদায়ে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেই।

মারমা জনগোষ্ঠীর একটি অংশ চাকমা জনগোষ্ঠীর জেএসএসের বিরোধিতা করে গঠন করে মগ লিবারেশন পার্টি বা এমএলপি। মগ লিবারেশন পার্টি চাকমা নেতৃত্বের বিরোধিতা ছাড়া অর্জন নেই। একটি আলাদা মগ ‘স্টেট’ গঠন করার কাল্পনিক স্বপ্ন দেখিয়ে চাঁদাবাজি, খুন-গুম আর প্রতিপক্ষ দমনে ফাঁকাবুলি পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। তাদের সঙ্গে অন্যান্য দলগুলোর সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের তফাৎ লক্ষণীয়। তাদের প্রতিষ্ঠার সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে ২০১৮ সাল থেকে তাদের কার্যক্রম চোখে পড়ে।

২০১৭ সালে নাথান বম দ্বারা প্রতিষ্ঠিত কেএনএফ (২০২২ সাল থেকে প্রকাশ্যে আসে) রাঙামাটি ও বান্দরবান জেলার নয়টি উপজেলা নিয়ে বম, পাংখুয়া, লুসাই, খুমি, ম্রো ও খিয়াং জনগণের জন্য একটি পৃথক স্বাধীন বা স্বায়ত্তশাসিত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়। কিন্তু পাংখুয়া, লুসাই, খুমি, ম্রো ও খিয়াং নিজেদের সঙ্গে কেএনএফের সম্পৃক্ততা নেই বলে জানান। অধিকার বিষয়ে ষষ্ঠ তম আঞ্চলিক দলটির সঙ্গে জেএসএসের চরম বিরোধ রয়েছে। তারা পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিয়েছে। কেএনএফ মূলত বম পার্টি, অনগ্রসর জাতির তকমা মেখে কুকিভুক্ত জাতির পরিচয় বহন করে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড জাহির করাই প্রধান লক্ষ্য। জেএসএসের তীব্র বিরোধিতা এবং চুরি-ডাকাতি, হানাহানি ও পার্বত্য পরিস্থিতি অশান্ত করার মধ্য দিয়ে এক আতঙ্কিত দলে পরিণত হয়েছে। তাদের দাবিদাওয়া পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যান্য আঞ্চলিক দল এবং জাতিসত্তার অধিকার খর্ব করে।

আঞ্চলিক দলগুলোর আলাদা আলাদা দাবিদাওয়া, অনৈক্য, দলাদলি, হানাহানি ও সংঘর্ষ শুধুমাত্র চাঁদাবাজি ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয়েছে। তাদের নৈতিক অধঃপতন আদর্শিক বিচ্যুতির কারণে পার্থক্য তৈরি করেছে৷ এই পার্থক্য আজ তাদেরকে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ী-বাঙ্গালী মানুষদের থেকে দূরত্ব তৈরি করেছে।

আগের পোস্টশান্তি চুক্তির পরেও পাহাড়ে অশান্তির কারণ কী?
পরের পোস্টচলমান পরিস্থিতির আলোকে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিরপেক্ষ বলতে আমরা কাদের বুঝবো?

রিপ্লাই দিন

আপনার কমেন্ট লিখুন
আপনার নাম লিখুন