দেশে পার্বত্য জেলা পরিষদ তথা খাগড়াছড়ি/রাঙ্গামাটি/বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ নির্বাচন হচ্ছে না প্রায় ৩৫ বছর। জেলা পরিষদ আইনে পার্বত্য জেলার স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে বাংলাদেশের সংবিধান বিরোধী আলাদা ভোটার তালিকায় নির্বাচন করার বিধান থাকায় জেলা পরিষদে নির্বাচন করা যাচ্ছে না। এ অজুহাতে অন্তর্বর্তীকালীন পরিষদ ব্যবস্থা চালু রয়েছে। জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদটি উপজাতীয়দের জন্য সংরক্ষণ করা হয়েছে এবং সদস্যদের ক্ষেত্রে জনসংখ্যার অনুপাতে বাঙ্গালীদের সদস্য সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়নি।
তাই, পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদ সকল সম্প্রদায়ের জন্য উন্মুক্ত করে জেলার জনসংখ্যা অনুপাতে সদস্য সংখ্যা নির্ধারণের লক্ষ্যে আইন সংশোধন দরকার।
অথবা
প্রচলিত ভোটার তালিকায় নির্বাচনের ব্যবস্থা করা দরকার। এতে করে কেউ আর কথা বলার সুযোগ পাবে না। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে যে-কেউ অংশগ্রহণ করতে পারবে, জনগণের ভোটে যিনি বিজয়ী হবেন তিনিই দায়িত্ব গ্রহণ করবেন।
অন্যথা যে সরকার দেশ পরিচালনায় আসবে, তিনি তাঁর অনুসারিদের চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে পুরো জেলা নিয়ন্ত্রণ করবে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ,
পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড,
পার্বত্য জেলা পরিষদ,
পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনে,
শরণার্থী বিষয়ক টাস্কফোর্স চেয়ারম্যান, –
পদে আইনের আলোকে উপজাতীয়দের মধ্য হতে মনোনয়ন দেয়া হচ্ছে বছরের পর বছর ধরে। ঐ সকল প্রতিষ্ঠানে বাঙ্গালীসহ সংখ্যাগরিষ্ট উপজাতীয়দের মধ্য হতে মনোনয়ন দেয়া প্রয়োজন। তাই, পার্বত্য চট্টগ্রামে আঞ্চলিক পরিষদ, উন্নয়ন বোর্ড, জেলা পরিষদ, টাস্কফোর্স এর চেয়ারম্যান পদে বাঙ্গালীসহ সংখ্যাগরিষ্ট উপজাতীয়দের মধ্য হতে মনোনয়ন দেয়ার লক্ষ্যে আইন সংশোধন দরকার।
পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে উপজাতীয় প্রতিনিধিদের(১। আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান বা তাহাঁর প্রতিনিধি ২। সংশ্লিষ্ট পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ৩। সংশ্লিষ্ট সার্কেল চীফ) ও চট্টগ্রাম বিভাগের বিভাগীয় কমিশনার বা তাঁর মনোনীত একজন অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার নিয়ে গঠিত।
এখানে পার্বত্য অঞ্চলের বাঙ্গালীদের কোন প্রতিনিধি নেই। তাই, এ কমিশনে বাঙ্গালীদের ভূমির ন্যায় বিচার প্রাপ্তি নিশ্চিতের জন্য তিন পার্বত্য জেলা হতে অন্ততঃ তিনজন বাঙ্গালী সদস্য অন্তর্ভুক্ত করার বিধান প্রণয়ন প্রয়োজন।
পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙ্গালী ও উপজাতী জনসংখ্যার অনুপাত দেখা যাক। ২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী-
বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙ্গালীর অনুপাত ৫১% যেখানে খাগড়াছড়িতে ৫১.০৮%, রাংগামাটিতে ৪২.৪২% ও বান্দরবানে ৫৮.৮৫% এবং
অন্যদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতীদের অনুপাত ৪৯% যেখানে খাগড়াছড়িতে ৪৮.৯২%, রাংগামাটিতে ৫৭.৫৮% ও বান্দরবানে ৪১.১৫%
বাঙ্গালী ও উপজাতির জনসংখ্যার অনুপাত প্রায় সমান হলেও জেলা পরিষদের অধীনস্থ সকল বিভাগে ও অন্যান্য প্রায় সকল নিয়োগে বাঙ্গালীদের মাত্র ৩০% নিয়োগ করা হচ্ছে, বিপরীতে ৭০% নিয়োগ করা হচ্ছে উপজাতীদের মধ্য থেকে।
উপজাতি ৭০% এর বিভাজন কোন অনুপাতে হয় তা জানেন?
চাকমা ৩০%, মারমা ২০%, ত্রিপুরা ২০%। এখানেও কি বৈষম্য নেই?
আপনি জেনে অবাক হবেন, বিএনপির সময়কাল থেকে শুরু করে অর্থাৎ ২০০২ থেকে শুরু করে ২০০৮ সাল পর্যন্ত নিয়োগ পক্রিয়ায় বাঙ্গালীদের ৪৮% এবং উপজাতিদের ৫২% অনুপাতে নিয়োগ দেওয়া হতো যেটা আওয়ামী সরকার এসে বন্ধ করে দেয়।
তাই, সকল প্রকার নিয়োগসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধায় জনসংখ্যা অনুপাতে প্রদানের সরকারি সিদ্ধান্ত দ্রুত প্রয়োজন।
আপনার মনে প্রশ্ন আসতে পারে, জেলায় নিয়োগ আর কয়টি হয়?
বা জেলা পরিষদের অধীনে কতগুলো ডিপার্টমেন্ট রয়েছে?
যেটা হয়তো জেলার অনেকেরই অজানা।
জেলা পরিষদের অধীনস্থ বিভাগগুলোর তালিকা –
১. স্বাস্থ্য বিভাগ
২. যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর
৩. প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগ
৪. কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর
৫. পর্যটন কর্পোরেশন
৬. মৎস্য অধিদপ্তর
৭. পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর
৮. সমাজ সেবা অধিদপ্তর
৯. প্রাণি সম্পদ অধিদপ্তর
১০. তুলা উন্নয়ন বোর্ড
১১. সমবায় অধিদপ্তর
১২. বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন
১৩. জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর
১৪. বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন
১৫. হর্টিকালচার বিভাগ
১৬. ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট, খাগড়াছড়ি
১৭. বাজারফান্ড প্রশাসন
১৮. শিল্পকলা একাডেমী
১৯. স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর
২০. সরকারী শিশু সদন
২১. জেলা ক্রীড়া অফিস
২২. মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর
২৩. রামগড় মৎস্য হ্যাচারী
২৪. জেলা গণগ্রন্থাগার
আপনি কি জানেন?
পার্বত্য চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী/ঠিকাদারদের মধ্যে উপজাতীয়দের কোন আয়কর দিতে হয়না।
এক্ষেত্রে একটি দারুণ বৈষম্য লক্ষণীয় যেখানে সরকার বড় অংকের রাজস্ব হারিয়ে ফেলছে। সুতরাং উপজাতীয়দের আয়করের আওতায় আনা দরকার অথবা পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল সম্প্রদায়ের জন্য একই সুবিধা প্রদানের বিষয়ে সরকারী সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। নয়তো বাঙ্গালী জাতি বরাবরের মতই পিছিয়ে পড়ছে, পাশাপাশি একটি বৈষম্যকে জিইয়ে রেখে এখানকার মানুষের মধ্যে একটি কঠিন সমস্যাকে সাদরে লালন-পালন করা হচ্ছে।
সহজ উদাহরণে বুঝিয়ে দিই-
যারা সুপার ট্যাক্স দেয়, তাঁদের থেকে ৭% পর্যন্ত আয়কর কেটে রাখা হয়। অর্থাৎ আপনি যদি ১ কোটি টাকার কাজ করেন তা থেকে ৭ লক্ষ টাকা পর্যন্ত সরকারকে দিয়ে দিতে হবে। যেটা আমার উপজাতি ভাইদের দিতে হয় না। এবং এই একমাত্র ট্যাক্স এর কারণে এখানকার বাঙ্গালীরা অনেকগুণ পিছিয়ে পড়ছে। এবং একটা দারুণ বৈষম্য এখানে পরিলক্ষিত।
আপনি জানেন কি?
পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার স্থায়ী বাসিন্দা ছাড়া এখানে অর্থাৎ ৩ পার্বত্য জেলায় অন্য জেলার কোন ব্যক্তি জায়গা-জমি ক্রয়-বিক্রয় করতে পারে না। যেখানে উপজাতিরা সমগ্র বাংলাদেশে জমি ক্রয় থেকে শুরু করে চাকরি-ব্যবসা করতে পারে। স্থায়ী বাসিন্দার সনদপত্র নিতে উপজাতীয় হেডম্যান, উপজাতীয় ইউপি/পৌর চেয়ারম্যান এবং উপজাতীয় সার্কেল চীফ(রাজা)গণ বাঙ্গালীদের সনদ না দিলে স্থায়ী বাসিন্দা হওয়া যায়না। এ বৈষম্য ঠেকাতে পার্বত্য চট্টগ্রামেও সমতলের ন্যায় এনআইডির মাধ্যমে জায়গা ক্রয়/বিক্রয় করার ব্যবস্থার সরকারি সিদ্ধান্ত প্রয়োজন।
জেলায় আগে চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম ছিলো এক উপজেলা থেকে অন্য উপজেলা যাওয়ার মাঝপথে। এখন সেসব ছাড়িয়ে বর্তমানে বাজারের অফিস, দোকানদার তথা ব্যবসায়ীরাও এ থেকে রেহায় পাচ্ছে না। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে সরকারের উচিৎ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর অপরিহার্যতা না বললেই নয়। এখানকার বিচ্ছিন্নবাদী অবৈধ সশস্ত্র সংগঠনের সংঘাত, অপহরণ, চাঁদাবাজী এসব বন্ধ করতে এবং উক্ত সংগঠনসমূহের সদস্যদের আলোর পথ দেখাতে সেনাবাহিনীর বিকল্প কিছু নেই। পার্বত্য চট্টগ্রামে আপামর জনসাধারণের মাথার উপরের ছায়া হিসেবে যুগ যুগ ধরে কাজ করে আসছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। আবহমানকাল থেকে আমাদের বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিদ্যমান। পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত বাঙ্গালী ও উপজাতি ভাইবোনদের সহাবস্থান ও ভাতৃত্বের বন্ধন অটুট রাখতে সর্বোপরি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য নজির স্থাপন করতে অসাম্প্রদায়িক মনোভাবসম্পন্ন হওয়া উচিৎ আমাদের সকলের।
ব্রিটিশ শাসকরা “ডিভাইড অ্যান্ড রুল” নীতির মাধ্যমে এ দেশে বৈষম্য তৈরি করে যেটা সম্মিলিতভাবে পরবর্তীতে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে রূপ নেয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে এসব বৈষম্য দূরীভূত হয়, এবং দেশে সৃষ্টি হয় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য নজির।
সম্প্রতি আমরা আমাদের খাগড়াছড়ি জেলার কমলছড়ি গ্রামের সন্তানকে দেশের অন্তর্বর্তী সরকারের একজন উপদেষ্টা হিসেবে পেলাম যেটা আমাদের জেলাবাসির জন্যে অনেক বড় প্রাপ্তি বলা চলে। বলছি দুটি দেশে রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করা জনাব সুপ্রদীপ চাকমা স্যারের কথা। স্যার দীর্ঘ সময় দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন শেষে অর্জিত জ্ঞান ও প্রজ্ঞা এবার আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত মানুষগুলোর প্রতি কাজে লাগানোর সুযোগ পেয়েছেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়নবোর্ডে দায়িত্ব পালনকালে অনেক বাধ্যবাধকতা থাকলেও এখন অতটা নেই, এখন অনেক কিছুই চাইলেই সম্ভব। তাই স্যারের প্রতি অনুরোধ থাকবে, উপর্যুক্ত বিষয়গুলোর প্রতি সদয় বিবেচনা করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।
পরিশেষে বলি, আমি কোনোভাবেই উপজাতী ভাই-বোনদের নিয়ে কিছু লিখছি না। আমার জীবদ্দশায় আমি অসংখ্য উপজাতি ভাই-বোনের ভালোবাসা পেয়েছি, আমার অসংখ্য উপজাতি ভালো বন্ধু রয়েছে, অসংখ্য সিনিয়র-জুনিয়র আছে যাদের সাথে আমার হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। শুধু তাই নয়, আমি আমার সামাজিক কার্যক্রমে অসংখ্য উপজাতি ভাইদের পাশে দাঁড়িয়েছি, নিজের রক্ত দিয়েছি, ব্যবস্থা করে দিয়েছি, বিভিন্নভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছি।
আমি শুধুমাত্র পার্বত্য চট্টগ্রামের বৈষম্য ও বাঙ্গালীদের অধিকার রক্ষার কথা লিখেছি। এ বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের কেউই খুব একটা লিখে না, অনেকে হয়তো জানেও না। বিষয়গুলো সবার জানা জরুরী, তাই ভাবলাম নিজের পরিধি থেকে যতটুকু পারা যায় জানানোর চেষ্টা করি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন পরবর্তী দেশের যত বৈষম্য তা যেন আরও বহু গুণে আলোকিত হয়ে সকলের সম্মুখে ধরা দিচ্ছে। তাই সকলের সাথে আমিও বলতে চাই, এ স্বাধীন বাংলায় বৈষম্যের ঠাই নাই। একইসাথে আরও বলি, এক দেশে দুই নীতি থাকতে পারে না।
আমরা পাহাড়বাসী সকলে সম্মিলিতভাবে এগিয়ে যেতে চাই। কাউকে পেছনে ফেলে রেখে কেউ এগিয়ে যাবে এ ধরণের বৈষম্য যেন পাহাড়ে না থাকে সে উদ্দেশ্যেই এ লিখা।
২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামে জনসংখ্যা সর্বমোট ১৮,৪২,৮১৫ জন।
এরমধ্যে বাঙ্গালী জনসংখ্যা ৯,২২,৫৯৮ জন যেখানে খাগড়াছড়িতে ৩,৬৪,৭৪১ জন, রাঙ্গামাটিতে ২,৭৪,৭২৩ জন, বান্দরবানে ২,৮৩,১৩৪ জন।
অন্যদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতির সংখ্যা ৯,২০,২১৭ জন যেখানে খাগড়াছড়িতে ৩,৪৯,৩৭৮ জন, রাঙ্গামাটিতে ৩,৭২,৮৬৪ জন, বান্দরবানে ১,৯৭,৯৭৫ জন।
এ লিখাটি ১৮,৪২,৮১৫ জনের মধ্যকার বৈষম্য দূরীকরণের লিখা। তাই এ বিষয়গুলো তথা নিজেদের অধিকারগুলো সবার জানা জরুরী। এতলক্ষ মানুষের নিকট পৌঁছাতে না পারলেও হাজার হাজার মানুষের নিকট পৌঁছানো সম্ভব।
(অসমাপ্ত)
লেখক: হাছানুল করিম
প্রাক্তন শিক্ষার্থী
রাঙামাটি বিজ্ঞান ও বিশ্ববিদ্যালয়