হান্নান সরকার, হিল নিউজ বিডি: খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবান তথা পার্বত্য চট্টগ্রাম। বাংলাদেশের আয়তনের এক-দশমাংশ। নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি ভূস্বর্গ পর্যটন শিল্পের অপার সম্ভাবনাময় এবং এ অঞ্চলে প্রাকৃতিক বনজ সম্পদের ভরপুর। যা দেশের অর্থনীতিতে বিরাট ভূমিকা রাখে। এছাড়াও এ অঞ্চলে আছে বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠী। যারা চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, পাংখো, ম্রো, চাক, লুসাই, মুরুং, খিয়াং ও বম এবং পার্বত্য বাঙালি জনগোষ্ঠী৷ সবাই মিলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীর পাহাড়।
এই সম্প্রীতির সেতুবন্ধনে ফাটল ধরাতে ৫ দশক পাহাড়ে সাম্প্রদায়িক বিজ বপন করছে পাহাড়ি সংগঠনগুলো। পাহাড়ে অশান্তির মূল কারণ পাহাড়ী সংগঠনগুলো৷ এখানে জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও জাতপাত ভাগ করে সংগঠনগুলো। সাধারণ বাঙালি ও পাহাড়ীরা শান্তিপ্রিয়। তারা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে অটুট৷ কিন্তু তাদের মধ্যে বিভিন্নভাবে বিভাজন সৃষ্টি করে জাতিগত সংঘাতের রূপ দিতে কাজ করছে পাহাড়ী সংগঠনগুলো৷ এসব সংগঠনগুলোর পৃষ্ঠপোষক, এনজিও, মিশনারী ও আন্তর্জাতি ষড়যন্ত্রকারী গোষ্ঠী। যদিও তাদের অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি চাঁদাবাজি থেকে। বর্ণিত গোষ্ঠী সবসময়ই পাহাড়ে একটা ঘোলাটে পরিস্থিতি তৈরি করতে মুখিয়ে থাকে। তাদের কারণে পাহাড়ে সন্ত্রাসবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি হয়েছে।
আমরা যদি পার্বত্য চট্টগ্রামের কয়েক দশকের ইতিহাস বিশ্লেষণ করি, দেখতে পাবো পার্বত্য চট্টগ্রামের সন্ত্রাসবাদ ও অশান্ত পরিবেশ সৃষ্টির মূলে রয়েছে উগ্র জাতীয়তাবাদ, বাঙালি বিদ্বেষী ও পাহাড়ী নেতাদের বাংলাদেশ বিরোধী মনোভাব। এই মানসেই পাহাড়ী সংগঠনগুলো মূলত সৃষ্টি হয় এবং জাতির অধিকারের দোহাই দিয়ে পাহাড়ীদের সরলতার সুযোগে দেশ বিরোধী অপতৎপরতা পরিচালনা করে। পাহাড়ী সংগঠনগুলো অধিকার বিষয়কে প্রমোট করলেও তার অন্তরালে দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র। যদিও তা এদেশের জনগণের দৃষ্টিশক্তির আড়ালে। পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রথম সংগঠন জেএসএস আলাদা রাস্ট্র গঠনের সশস্ত্র সংগ্রাম করে ব্যর্থ হয়। সর্বশেষ রাজনৈতিক সুবিধা পর্যন্ত থামতে হয় ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির মাধ্যমে। বলাবাহুল্য যে, এই চুক্তিতে পাহাড়ীদের কথাগুলো প্রতিফলিত হলেও পার্বত্য বাঙালিরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পার্বত্য সংঘাত বন্ধ হয়নি। অন্যদিকে ইউপিডিএফ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য অর্জনের নামে কল্পিত (আলাদা জুম্মল্যাণ্ড) গঠনের জন্য একের পর এক বিশৃঙ্খলা তৈরি করে পাহাড়কে একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত পরিস্থিতির সম্মুখীন করেছে। বলতে পারি ইউপিডিএফ পাহাড়ে এক ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসের খেলায় মেতে উঠেছে। ইউপিডিএফ নিজেদের পাহাড়ের পরাশক্তি সংগঠন হিসেবে এবং এ অঞ্চলের সকল জনগোষ্ঠীর অভিভাবক হিসেবে ঢাকঢোল বাজাচ্ছেন বাস্তবিক অর্থেই ইউপিডিএফ জনগণের কাছে একটি ভাঁওতাবাজ সংগঠন হিসেবে পরিচয় লাভ করেছে। তাদের কর্মকাণ্ড গনবিরোধী। যার ফলে পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর কাছে বর্তমান সংগঠন গুলো একটি মূর্তিমান আতঙ্কের নাম। জেএসএস, ইউপিডিএফ ও কেএনএফ বা অন্যান্য প্রতিটি সংগঠন বাঙালি ও সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে গড়ে উঠেছে। তারা কখনো পাহাড়ে সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজে বের করনি বরং পাহাড়কে বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য অপতৎপরতা চালাচ্ছে।
খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবান আজ যেন সন্ত্রাসদের অভয়ারণ্য। আপনি একজন ব্যবসায়ী হিসেবে পাহাড়ে স্বাধীনভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারবেন না। এমনকি একজন নিরীহ মানুষ হিসেবেও আপনি চাঁদার আওতায়ভূক্ত। এখানে চাঁদা ছাড়া কিছু হয়না। এই চাঁদার জন্য সন্ত্রাসীরা পাহাড়ের আনাচে-কানাচে চাঁদাবাজির নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে। এখানে স্বাধীনভাবে চলাফেরার অধিকার নেই। পাহাড়ে রয়েছে অস্ত্রধারী অনেক সংগঠন। সংগঠন গুলো অবৈধ অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে চাঁদা উত্তোলন করেন। পাহাড়ি জনগণকে দীর্ঘ সময় ধরে শাসন-শোষণ করে আসছে।
পাহাড়ের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্যে অবৈধ অস্ত্র বহন করে৷ এসব অস্ত্রগুলো অত্যাধুনিক। যা যুক্তরাস্ট, চিন, রাশিয়া, ভারত ও মায়ানমারের তৈরি। পাহাড়ে কী পরিমাণ অস্ত্র আছে তার সঠিক পরিসংখ্যান জানা না গেলেও ধারণা করা হয়, পার্বত্য চট্টগ্রামে ৬টি আঞ্চলিক সংগঠনের কাছে অন্তত দশ হাজার অস্ত্র রয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন সরঞ্জামাদি রয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অস্ত্রের ছবি ও ভিডিও সয়লাব। এসব কিছু কিন্তু বাংলাদেশ বিরোধী মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ। যা দেশদ্রোহীতার সামিল।
নিরাপত্তা সূত্রগুলো বলছে, পার্বত্য চট্টগ্রামের গহীন অরণ্যে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর ঘাঁটি রয়েছে৷ ধারণা করা হয় এসব ঘাঁটিগুলো অস্থায়ী। অভিযান শুরু করলে সন্ত্রাসীরা ঘাঁটি ছেড়ে সীমান্তবর্তী অংশে চলে যায় বা প্রতিবেশী দেশগুলোর আশ্রয় শিবিরে চলে যায়৷ পরবর্তীতে ফিরে আসে।
রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান তিনটি জেলার সঙ্গে রয়েছে ত্রিদেশীয় সীমান্ত। এই সীমান্তে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা জোরদার না থাকায় অবাধে যাতায়াত রয়েছে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের। তারা এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাতায়াত করে। বিশাল সীমান্ত এলাকা অরক্ষিত৷ প্রশ্ন দেখা দিতে পারে সীমান্তরক্ষীরা কী করছে? দুর্গম পাহাড়, অরণ্য হওয়ার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের যাতায়াত ব্যবস্থা অত্যন্ত নাজুক। তাই সীমান্তে চোরাচালান, অবৈধ অস্ত্র পারাপার ঠেকানো যাচ্ছে না।
এই মন্তব্যের বাস্তবিক উদাহরণ হলো-
বিজিবি ও বিএসএফ প্রধানের ৫১ তম বৈঠকে বাংলাদেশের বিজিবি প্রধান ভারতের কাছে অভিযোগ করে বলেন, ভারতের মাটিতে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা আশ্রয়-প্রশ্রয় পেয়ে থাকেন। তা যেন ভারত দেখে এমনটা দাবি ছিল বিজিবি প্রধানের। ভারত তা খতিয়ে দেখবে বলে জানান। এই থেকে স্পষ্ট যে সীমান্ত অনিরাপদ। যেখানে প্রতিনিয়ত সন্ত্রাসীদের যাতায়াত হয়।
পাহাড় নিয়ে সোচ্চার এমন ব্যক্তিরা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি অধ্যুষিত এলাকায় ভারী অস্ত্রধারী প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ায়৷ রাস্ট্রীয় বাহিনীর মত তাদের অবকাঠামো না থাকলেও অস্ত্র, পোষাক ও সামরিক সরঞ্জামাদি অবিকল। উপরে বলেছি, এই সন্ত্রাসীরা সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সৃষ্ট হলেও বর্তমানে আলাদা রাস্ট্র গঠনে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। পাহাড়কে অরক্ষিত করতে সেনা ও বাঙালি প্রত্যাহারের দাবিতে তারা প্রকাশ্যেই সোচ্চার। সাম্প্রতিক সময়ে পাহাড়ীরা উস্কানিমূলক যেসব স্লোগান প্রসব করেছে তা কিন্তু বাঙালি, সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে। এসব কিছু থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় তারা তীব্র সাম্প্রদায়িক এবং বাংলাদেশ ও বাঙালি বিরোধী।
পাহাড়ের নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো বলছে,
আজকে পাহাড় সন্ত্রাসের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। আপনি একজন বাঙালি হিসেবে একটি পাহাড়ি এলাকায় প্রবেশ করতে পারবেন না। আপনাকে জায়গা জায়গায় প্রতিবান্ধকতার মুখামুখি হতে হবে। এখানে পাহাড়ি সংগঠনের কথার বাহিরে কিছু হয়না। তাদের কথার অবাধ্য হলে খুন-গুম ও মোটা অংকের জরিমানার শিকার হতে হয়। পাহাড়ে চলে অঘোষিত সন্ত্রাসী শাসন।
সমতল থেকে পাহাড় ভ্রমণে গিয়েছে বা গবেষণার কাজে গিয়েছে এমন কয়েকজন অভিজ্ঞতা শেয়ার করে বলেন, পাহাড় এখন বাংলাদেশের অংশ কাগজে কলমে সীমাবদ্ধ। পার্বত্য চট্টগ্রামে কয়েকটি বড় ধরনের সন্ত্রাসী হামলা, হত্যাকাণ্ড, প্রকাশ্য চাঁদাবাজি, রাস্ট্রীয় ব্যাংক ডাকাতি ও অস্ত্র লুটপাটের ঘটনা কিন্তু অনেক প্রশ্ন জন্ম দেয়। পাহাড়ের নিয়ন্ত্রণ বাংলাদেশ সরকারের কতটুকু আছে তা বিগত কয়েক বছরের ঘটনা থেকে স্পষ্ট।
আজকে পাহাড়ে যে সন্ত্রাস তৈরি হয়েছে৷ তাকে কোনভাবেই হালকাভাবে নেওয়ার সুযোগ নেই৷ এরা কোন সাধারণ চোর, ডাকাত বা সন্ত্রাসীরা নয়। এরা কিন্তু বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী। উগ্র জাতীয়তাবাদ চেতনায় বাংলাদেশকে ভাগ করার চক্রান্ত করছে। এটা ধারাবাহিক চলতে থাকলে অচিরেই পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হবে। তাই সময় থাকতে বিচ্ছিন্নতাদের স্বমূলে উৎপাটন জরুরী।