-
ছবি: সংগৃহীত
দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বৈচিত্র্যময় কিছু মানুষ রয়েছে। বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তথ্য অনুযায়ী ৪৫ টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কিংবা উপজাতি রয়েছে এদেশে। বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রামে তাদের অবস্থান উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রয়েছে। যারা দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় দুই শতাংশ।
বৈচিত্র্যময় এ জনগোষ্ঠীর মানুষগুলো অনেক সময় পাহাড়ি, অনেক সময় জুম্ম এবং অনেক সময় নিজেদেরকে উপজাতি হিসাবে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেছে।
বৃটিশ শাসনামলে বৃটিশরা ইংরেজিতে তাদেরকে ট্রাইবাল সম্বোধন করে ডাকতো। সেই ট্রাইবাল শব্দটা ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে। যার বাংলা অর্থ উপজাতি। তখন থেকে বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীর লোকেরা নিজেদেরকে উপজাতি হিসেবে সর্বদা পরিচয় দিতো।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও আমরা দেখতে পাই উপজাতিরা নিজেদেরকে উপজাতি হিসেবেই পরিচয় দিতে গর্ববোধ করেছে।
যার প্রমাণ ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর কাছে চাকমাদের প্রদত্ত লিখিত স্মারকলিপিতে এবং ১৯৯৭ সালে আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে উপজাতিদের মুখপাত্র পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সাথে যে অসাংবিধানিক বিতর্কিত পার্বত্য চুক্তি হয়েছিল সেই চুক্তিতেও নিজেদেরকে উপজাতি হিসেবে স্বাক্ষর করেন।
এখন প্রশ্ন হল এতোদিন যারা নিজেদেরকে উপজাতি হিসেবে দাবী করতো তারা হঠাৎ নিজেদেরকে আদিবাসী দাবী করার অর্থ কি???
সেই প্রশ্নের উত্তরের আগে আদিবাসী কাকে বলে তা জানা জরুরি।
আদিবাসীর সংজ্ঞাঃ
১. সমাজতাত্ত্বিকভাবে আদিবাসী বলতে তাঁদেরকেই বুঝায় যারা প্রাগ ঐতিহাসিক কাল থেকে নির্দিষ্ট অঞ্চলের বাসিন্দ বা ভূমিজ সন্তান।অর্থাৎ যারা নির্দিষ্ট জনপদের সৃষ্টিলগ্ন থেকে সেই জনপদের বাসিন্দা। এবং যারা আদিম সাংস্কৃতির ধারক এবং বাহক। আদিম সাংস্কৃতির কোন কিছু তারা ত্যাগ করেনি। আদিবাসীদের কাছে সভ্যতার আলোকবর্তিকা পৌছায়নি এবং তারা অনগ্রসর এবং পশ্চাদ।
২.জাতিসংঘের আন্তজার্তিক শ্রম সংস্থা (আইএলওর) আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সম্মেলনে আদিবাসী চিহ্নিত করা হয়েছে এভাবে, আদিবাসী বা দেশজ মানবসমাজ, জনগোষ্ঠী অথবা জাতিসত্তার পরিচিতি পাবার অধিকারী তারাই, যাদের প্রাক-আগ্রাসন ও প্রাক-সাম্রাজ্যবাদী অধিকারের আগে থেকেই একটি ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা আছে, যা তারা নিজ বাসভূমিতে তৈরি করেছিলেন। যারা তাদের বাসভূমিতে অথবা কিয়দংশে পাশাপাশি বসবাসকারী অন্যান্য মানবকুল থেকে নিজের একটি বিশেষত্বময় পৃথক সত্তার অধিকারী মনে করেন। যারা আজ সমাজের প্রতিপত্তিশালী না হয়েও ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য তাদের নিজস্ব গোষ্ঠীসত্তা, সাংস্কৃতিক কাঠামো, সামাজিক প্রতিষ্ঠানসমূহ ও বিধিব্যবস্থা রেখে যেতে চান একটি বিশেষ মানবসমাজের ধারাবাহিকতা অক্ষুন্ন রাখার জন্য।
আদিবাসী সম্পর্কে গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা দুটি বিশ্লেষন করতে অনুধাবন করা যায়, বাংলাদেশের উপজাতিরা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী নাকি আদিবাসী।
প্রথম সংজ্ঞাতে আমরা দেখতে পাই আদিবাসী হতে হলে প্রাগ ঐতিহাসিক কাল থেকে অর্থাৎ যখন থেকে ইতিহাস লিপিবদ্ধ শুরু হয়নি তখন থেকে সে অঞ্চলের বাসিন্দা হতে হবে। আবার বলা হয়েছে জনপদের সৃষ্টিলগ্ন থেকে সেখানকার বাসিন্দা হতে হবে।
কিন্তু বাংলাদেশের উপজাতিদের বাংলাদেশে আগমনের ইতিহাস আমরা জানি। তারা মঙ্গোলিয়া, ভারতের মিজোরাম, অরুণাচল, ত্রিপুরা রাজ্য, মেঘালয় এবং বার্মার চম্পক নগর থেকে বিতাড়িত হয়ে বাংলাদেশে বসতি স্থাপন করেছিল ১৭০০ খ্রিস্টাব্দের পরে।
এবং ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত বৃহৎ পার্বত্য জেলার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীরা মঙ্গোলয়েড জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। ঐতিহাসিক দলিল-দস্তাবেজ, উপজাতীয় লেখকদের নিজস্ব গ্রন্থ পর্যালোচনায় প্রমাণিত যে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা সহ সব নৃ-গোষ্ঠী আরাকান, ত্রিপুরা, মিজোরাম ইত্যাদি অঞ্চল থেকে বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহে এ দেশে এসেছেন। চাকমারা বিজয়গিরি নামক একজন যুবরাজের নেতৃত্বে অভিযান চালিয়ে আরাকান ও চট্টগ্রামের একটি অংশ দখল করেন। এ দেশের চাকমারা মনে করেন, তারা বিজয়গিরির সেই আরাকান বিজয়ী সৈন্যদের বংশধর। ১৭১৫ সালে চাকমা রাজা জলিল খাঁন বা জালাল খাঁন (১৭১৫-১৭২৪) সর্বপ্রথম চট্টগ্রামে মোগল কর্তৃপক্ষের সাথে ১১ মণ কার্পাস তুলা উপহার দিয়ে যোগাযোগ স্থাপন করেন। ১৭৩৭ সালে সেরগুস্ত খাঁন (১৭৩৭-৫৮) আরাকানের পক্ষ ত্যাগ করে মোগলদের বশ্যতা স্বীকার করেন এবং দেওয়ান পদ লাভ করেন। মারমারা ১৭৫৬ সালে আরাকানে আশ্রয় লাভ করেন। ১৭৭৪ সালে রামু, ঈদগড়, মাতামুহুরী এবং সর্বপ্রথম ১৮০৪ সালে বান্দরবান শহরে বসতি স্থাপন করেন। ১৭৮৪ সালে বর্মী রাজা বোদপায়ার সেনাবাহিনী স্বাধীন আরাকান রাজ্য দখল করলে হাজার হাজার শরণার্থী কক্সবাজার, পার্বত্য চট্টগ্রাম, পটুয়াখালী পালিয়ে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস করা শুরু করেন। এ দেশে দ্বিতীয় বৃহৎ উপজাতি সাঁওতালসহ অন্যান্য গোষ্ঠী এ দেশে এসেছেন সাঁওতাল বিদ্রোহের পর। অনেকে এসেছেন ব্রিটিশ আমলে মৌসুমী শ্রমিক হিসেবে।
বর্তমানে উপজাতি সমাজে আদিম কোন রীতি নেই বললেই চলে। তারা মডার্ন জীবন যাপন করছে শিক্ষা দীক্ষায় অনেক এগিয়ে এবং সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে চাকরি করছে অর্থাৎ আদিম সমাজের কিছুই তাদের মধ্যে নেই।
তাহলে তারা কিভাবে আদিবাসী হয়!!!
(আইএলওর) সংজ্ঞার শর্তই হলো, যাদের প্রাক-আগ্রাসন ও প্রাক-সাম্রাজ্যবাদী অধিকারের আগে থেকেই একটি ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা আছে, যারা প্রতিপত্তিশালী ও শাসকগোষ্ঠীর সদস্য নয়। কিন্তু ইসলাম-খ্রিস্টান-বৌদ্ধ, হিন্দু ধর্ম বা ধর্মের মানুষ অবশ্যই প্রতিপ্রত্তিশালী বা শাসকগোষ্ঠী। সুতরাং কোনো প্রকৃতি-উপাসক ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষ যখনই ধর্মান্তরিত হয়ে খ্রিস্টান-হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম হবে তখন সে শাসকগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হবে এবং আদিবাসী সংজ্ঞার আওতায় পড়বে না।
উপরোক্ত আলোচনার মাধ্যমে আমরা পরিষ্কার ধারণা পেয়েছি বাংলাদেশে কোন আদিবাসী নেই।
এখন আগের প্রশ্নে আসি উপজাতিরা হঠাৎ করে কেন নিজেদেরকে আদিবাসী দাবি করছে?
আদিবাসী দাবি বাস্তবায়ণ করতে পারলে জাতিসংঘের ঘোষণাপত্র অনুযায়ী উপজাতিরা নিম্নলিখিত সুবিধাগুলো পাবে।
১. আদিবাসীদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার এবং অভ্যন্তরীণ ও স্থানীয় বিষয়ে স্বায়ত্তশাসন।
২. ভূমি ও ঐ স্থানের উপর পূর্ণ অধিকার।
৩। নিজস্ব শিক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা ও তা নিয়ন্ত্রণের অধিকার।
৪. আদিবাসীদের অনুমতি ব্যতিরেকে বা যৌক্তিক না হলে ঐ অঞ্চলে সামরিক কার্যক্রম পরিহার।
৫. জাতিসংঘ বা আন্তঃরাষ্ট্রীয় সংস্থা কর্তৃক এই অধিকারসমূহ প্রতিষ্ঠার জন্য চাপ প্রয়োগের নিমিত্তে জনমত গঠন, নিজেদের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার হিসেবে স্বাধীন দেশ প্রতিষ্ঠা, অর্থনৈতিক সহযোগিতা বা কারিগরী সহায়তা প্রদান।
উল্লেখিত অনুচ্ছেদগুলো কেবল আদিবাসীদের জন্য প্রযোজ্য। আর এমন লোভনীয় অনুচ্ছেদগুলোর সুবিধা নিতেই ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীগুলো নিজেদের আদিবাসী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে উঠে পড়ে লেগেছে। এদেশীয় ষড়যন্ত্রকারী ও বৈদেশিক কিছু এনজিও এবং মিশনারীদের খপ্পরে পড়েই আদিবাসী স্বীকৃতি দাবি করে। চুক্তি করেছে উপজাতি হিসেবে। সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে উপজাতি কোটায়, দাবি করে নিজেদেরকে আদিবাসী! এমন দাবি হাস্যকর!
ব্রাজিলের আমাজনের আদিবাসী এবং অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীর মতো কি ‘জীবনধারা, ভাষা, সংস্কৃতি ঐতিহ্য’ আছে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত উপজাতি জনগোষ্ঠীর? যদি না থাকে তাহলে কিভাবে তারা নিজেদের আদিবাসী দাবি করে। বাংলাদেশের চেয়ে অধিক উপজাতি জনগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে ভারত, মায়ানমার ও চীনে। তারা কি উপজাতিদের আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে? নিঃসন্দেহে তারা উপজাতিদের গুলোকে আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি৷ সুতরাং বাংলাদেশে আদিবাসী স্বীকৃতি দেওয়ার প্রশ্নই আসেনা। জাতিসংঘ বাংলাদেশে আদিবাসী জনগোষ্ঠী আছে কিনা তা জানতে চেয়ে ২০০৭ সালে বাংলাদেশের কাছে চিঠি দেন। চিঠির জবাবে ২০০৭ সালে বাংলাদেশের তৎকালীন পররাস্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশে আদিবাসী নেই বলে ব্রিফিং করে জানান।
এখন উপজাতিরা যদি নিজেদেরকে উপজাতি হিসেবে কিংবা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী হিসেবে নিজেদের পরিচয় বহন করতে অনিচ্ছুক হয়, তাহলে সেক্ষেত্রেই উপজাতিদের সাথে আলোচনা করে সরকারের উচিত হবে উপজাতিদেরকে আলাদা আলাদা নামে স্বীকৃতি দেওয়া যেমন, চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তংচংগা, খিয়াং, লুসাই, বম, ম্রো ইত্যাদি নামে। নিজেস্ব জাতির নামে পরিচিয় লাভ যথার্থ।
লেখক: সাংবাদিক তাপস কুমার পাল, বিশিষ্ট লেখক এবং গবেষক।