জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে স্বায়ত্তশাসন দাবি: ইউপিডিএফের উচ্চাকাঙ্ক্ষা!

0

অনন্ত অসীম 

পার্বত্য চট্টগ্রামের সমকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আবারও উচ্চারিত হয়েছে ‘স্বায়ত্তশাসন’ শব্দটি। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে প্রসিত খীসা নেতৃত্বাধীন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) সংগঠক মাইকেল চাকমার এ দাবির পুনরুচ্চারণ নতুন নয়, তবে বর্তমান সময়ের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের নিরিখে এটি ভিন্ন তাৎপর্য বহন করে। মূলত, এ দাবি কতটুকু বাস্তবসম্মত কিংবা নৈতিক, এবং এর অন্তরালে রাজনৈতিক উচ্চাবিলাষ কতটুকু প্রকট—তা বিশ্লেষণ এখন সময়ের দাবি।

ইউপিডিএফ গঠিত হয় ১৯৯৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বিরোধিতা করে। এই দলটির জন্মলগ্ন থেকেই এর কণ্ঠস্বর ছিল বিভ্রান্তিকর ও দ্বিমুখী। প্রসিত বিকাশ খীসা, যিনি ছিলেন জেএসএস-এর ছাত্র সংগঠন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের (পিসিপি) সভাপতি, পরবর্তীতে চুক্তির বিরোধিতায় নেতৃত্ব দেন। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর জেএসএস ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে সম্পাদিত ঐতিহাসিক পার্বত্য চুক্তি সশস্ত্র সংগ্রামের অবসান ঘটিয়ে অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠার এক নবদিগন্ত উন্মোচন করে। উপজাতীয়দের চুক্তিতে একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় চুক্তির ধারা-উপধারা নিয়ে বাঙালি জনগোষ্ঠীর প্রবল আপত্তি আছে। অথচ, ইউপিডিএফ এ চুক্তিকে তথাকথিত স্বায়ত্তশাসনের অনুপস্থিতির অভিযোগ এনে অগ্রাহ্য করে।

চুক্তি অনুযায়ী, আঞ্চলিক পরিষদ, জেলা পরিষদ, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং শাসনবিধির মাধ্যমে স্থানীয় জনগণের রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা হয়েছে। একে পরোক্ষ স্বায়ত্তশাসন বলা চলে। তথাপি, ইউপিডিএফ-এর ‘প্রতিস্বায়ত্তশাসন’ দাবি মূলত একটি অজুহাত—যা তাদের বহুমুখী রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে আড়াল করে।

ইউপিডিএফ কেবল রাজনৈতিক আঞ্চলিক সংগঠন নয়; বরং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটি একটি সশস্ত্র গ্রুপে রূপান্তরিত হয়েছে। চাঁদাবাজি, অপহরণ, খুন-গুম এবং দমননীতির আশ্রয়ে পাহাড়ে একপ্রকার ‘ছায়া-রাষ্ট্র’ কায়েমের অপচেষ্টা করেছে তারা। খোদ সন্তু লারমা ২০১৩ বেসরকারি টেলিভিশন ইনডিপেনডেন্স সাংবাদিক শামীমা বিনতে-কে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ইউপিডিএফ-এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে জেএসএসের এখনো শতাধিক সশস্ত্র জনবল রয়েছে। এ বক্তব্যে পরিষ্কার হয়, চুক্তি পক্ষ ও চুক্তিরবিরোধী দু’দল সশস্ত্র সংঘর্ষের মাধ্যমে অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করতে চায়।

পার্বত্য চট্টগ্রামে বর্তমানে ৬টি আঞ্চলিক দল সক্রিয়। নতুন করে যদি প্রত্যেকের সঙ্গে সরকার চুক্তি করে, তবে অঞ্চলটিতে একাধিক সংবিধিবহির্ভূত শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা পাবে, যা হবে স্পষ্ট ‘অধিবিন্না রাজনীতি’। এই দল-উপদলগুলোর মধ্যে রয়েছে জেএসএস (সন্তু), জেএসএস (এমএন লারমা), ইউপিডিএফ (মূল), ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক), মগ পার্টি ও কেএনএফ ইত্যাদি। চাকমাদের মধ্যেই রয়েছে ৪টি সংগঠন। মারমা, কথিত কুকি, ত্রিপুরা, চাকমা—এই চার জনগোষ্ঠীর মধ্যকার জাতিগত বিরোধকেও ইউপিডিএফ নিজের স্বার্থে উসকে দেয়।

স্বায়ত্তশাসনের নাম করে রাষ্ট্রচ্যুতি?

বাংলাদেশে কেবল পার্বত্য চট্টগ্রামেই রয়েছে আঞ্চলিক শাসনব্যবস্থা। এখানে রয়েছে পৃথক মন্ত্রণালয়, আঞ্চলিক পরিষদ ও জেলা পরিষদ, প্রথাগত শাসন ব্যবস্থা, কোটাভিত্তিক চাকরি ও শিক্ষাব্যবস্থা। দেশের অন্য কোনো অঞ্চলে এমন বিশিষ্টায়ন নেই। এককেন্দ্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় এইরূপ ব্যতিক্রমী শাসনব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও ইউপিডিএফ যখন আবারও স্বায়ত্তশাসনের দাবি তোলে, তখন তা গণতান্ত্রিক প্রয়োজন নয়, বরং ‘অভিরোষ’জাতীয় এক রাজনৈতিক বিদ্রোহ।

বর্তমানে ইউপিডিএফ নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধনের চেষ্টা করছে। যদিও রাজনৈতিক দল হিসেবে তাদের সংগঠন নিবন্ধন পাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় শর্তাদি পূরণে তারা অক্ষম। তথাপি, তারা সংস্কার কমিশনের বৈঠকে অংশ নিয়ে স্বায়ত্তশাসনের সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবি তোলে। আজ ১০ মে জাতীয় সংসদের এলডি হলে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ, মনির হায়দার, সফর রাজ হোসেন, বদিউল আলম মজুমদার, মোহাম্মদ আইয়ুব মিয়া প্রমুখ। অন্যদিকে, ইউপিডিএফ প্রতিনিধি দলে ছিলেন মাইকেল চাকমা, অমল ত্রিপুরা, জিকো ত্রিপুরা ও সুনয়ন চাকমা। স্বায়ত্তশাসন দাবি ও বিভিন্ন বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ইউপিডিএফ সংগঠক মাইকেল চাকমা বলেন এই নিয়ে আগামী ১৫ মে আরো কথা হবে।

সচেতন মহল বলছেন, ইউপিডিএফ কোনো রাজনৈতিক নিবন্ধিত দল নয় জাতীয় ঐক্য মত কমিশন ইউপিডিএফ এর মত বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর সঙ্গে বৈঠক কেন করলেন তা আমাদের বোধগম্য নয়।

অর্থবিত্তের বিভ্রান্তি ও ইউপিডিএফের আসল চেহারা:

২৭ বছরের কর্মকাণ্ডে ইউপিডিএফ পার্বত্য জনগণের কোন উপকারে এসেছে—তা প্রশ্নসাপেক্ষ। বরং তাদের কার্যক্রমে পাহাড়ে বেড়েছে আতঙ্ক, ‘অসেচনক’ বা চোখ ফিরিয়ে নেওয়া যায় না এমন অস্ত্রের ঝনঝনানি, এবং নাগরিক জীবনের নিশ্চয়তায় ভয়ানক ঘাটতি। তথাকথিত অধিকারের নামে ইউপিডিএফ যেভাবে চাঁদাবাজি ও খুন-গুম চালিয়ে যাচ্ছে, তাতে স্পষ্ট যে তারা কোনো মানবিক সংগঠন নয়, বরং একটি দমননির্ভর ‘অগ্নিদ’ যে গৃহ দগ্ধ করতে আগুন দেয় গোষ্ঠী। অথচ এই গোষ্ঠীর শীর্ষ নেতারা পাহাড়ে নয়, ঢাকায় বা বিদেশে আত্মগোপনে বিলাসী জীবনযাপন করছে।

সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির মাধ্যমে উপজাতিদের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করেছে। উন্নত করেছে শিক্ষা, চিকিৎসা, যোগাযোগ, কর্মসংস্থান ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য। কিন্তু এ চুক্তির সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী ইউপিডিএফই তা অস্বীকার করে এবং এ নিয়ে উচ্চবাচ্য করে। এমন ‘অযোগাম্মন্যা’ নিজেকে অযোগ্য ভাবা মনোভাব রাষ্ট্র ও সমাজের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। চুক্তি কার্যকর করতে গেলে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে পাহাড়ে সক্রিয় সকল দলের সহযোগিতা প্রয়োজন, কিন্তু ইউপিডিএফ তা করতে চায় না।

ইউপিডিএফের স্বায়ত্তশাসন দাবি আজ কেবল একটি রাজনৈতিক ‘অমর্ষণ’ সহজে ক্রুদ্ধ হওয়া ও তা প্রকাশ করা প্রতিক্রিয়া মাত্র। এটি একধরনের ‘অপদহ্নব’ যাহা আছে তাহা নাই বলিয়া অস্বীকার কৌশল, যেখানে তারা নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে গিয়ে রাষ্ট্রকে দায়ী করে। পার্বত্য চুক্তির মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ সুগম হলেও ইউপিডিএফ তাতে বারবার অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সরকার ও দেশের সচেতন সমাজকে এখনই নিরপেক্ষতা বজায় রেখে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের প্রকৃত কল্যাণের স্বার্থে ইউপিডিএফ-এর বিভাজনমূলক রাজনীতি এবং সশস্ত্র কার্যকলাপের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ অবস্থান গ্রহণ করতে হবে। স্বায়ত্তশাসনের নামে রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা ও জনগণের নিরাপত্তার সঙ্গে আপস কখনোই কাম্য নয়। বরং এখন প্রয়োজন, আইনের শাসন, স্বচ্ছতা এবং পার্বত্য অঞ্চলের দীর্ঘমেয়াদি শান্তির জন্য সমন্বিত উদ্যোগ।

অনন্ত অসীম, পার্বত্য চট্টগ্রাম 

আগের পোস্টআসুন, শুভ বুদ্ধ পূর্ণিমা দিন থেকে পঞ্চ বাণিজ্য পরিহারের শপথ নিই।।
পরের পোস্টখাগড়াছড়িতে সেনা অভিযানে অস্ত্রসহ ইউপিডিএফ সন্ত্রাসী আটক।

রিপ্লাই দিন

আপনার কমেন্ট লিখুন
আপনার নাম লিখুন