ঢাকায় মানসিক চাপ আর কত বাড়বে?

0

 

মো. তাজুল ইসলাম

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা জিপজেটের তালিকা অনুযায়ী ঢাকা বিশ্বের সবচেয়ে মানসিক চাপের শহর। এতে খুব বেশি অবাক হওয়ার কিছু নেই। কেননা, মানসিক চাপ সৃষ্টির অসংখ্য উপাদান ঢাকা শহরে বিদ্যমান।

ঢাকা শহর একটি মেগা সিটি। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী এর জনসংখ্যা ১ কোটি ৮০ লাখ, যা ২০৩৫ সালে দ্বিগুণ হয়ে সাড়ে তিন কোটিতে দাঁড়াবে। এত ঘনবসতি পূর্ণ শহরে নাগরিকের জরুরি প্রয়োজন মেটানো চারটিখানি কথা নয়।

দিনে দিনে নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য বাড়ছে। গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির যেমন অভাব রয়েছে, তেমনি এসবের দামও দিন দিন বাড়ছে। এ কারণে সাধারণ মানুষের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠছে।

বাংলাদেশ বিশ্বে দ্রুত ধনী হওয়া ব্যক্তিদের তালিকায় এক নম্বরে স্থান করে নিয়েছে। তার মানে প্রবৃদ্ধির সিংহভাগ চলে যাচ্ছে গুটিকয়েক ধনী ব্যক্তির হাতে, গরিব আরও গরিব হচ্ছে।

এই আর্থিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বৈষম্য ঢাকা শহরে নগ্ন রূপে আবির্ভূত হয়েছে, যা মানসিক চাপের অন্যতম কারণ।

এ ছাড়া ঢাকার শব্দদূষণ, বায়ুদূষণ, ট্রাফিক জ্যাম, জলাবদ্ধতা, মশা ও মশাবাহিত রোগ, গণপরিবহনের অপ্রতুলতা, ধোঁয়া, ধুলো, ডাস্টবিনের উপচে পড়া ময়লা, ভেজাল খাবার, হাঁটা–বিনোদনের জায়গার অভাব ইত্যাদি আর্থসামাজিক ও অবকাঠামোগত সমস্যা দিন দিন বাড়ছে।

এসবের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মানসিক চাপের পরিমাণ অপরিমেয়।

ঢাকা বর্তমানে আক্ষরিক অর্থেই একটি ‘অচল’ শহরে রূপান্তরিত হয়েছে। ১০ বছর আগে ও ঢাকায় যানবাহনের গতি ছিল ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার, যা বর্তমানে প্রায় ৫ কিলোমিটারে নেমে এসেছে। ২০২৫ সালে এ গতি ঘণ্টায় ৪ কিলোমিটারে নেমে আসবে।

তার মানে যানবাহনের চেয়ে হেঁটে গন্তব্য স্থানে আগে পৌঁছানো যাবে। যানজটের কারণে বছরে ক্ষতি হচ্ছে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা (বিশ্বব্যাংক)।

এর সঙ্গে আমাদের মন-মেজাজ হয়ে পড়ছে খিটখিটে, অস্থির ও অধৈর্য প্রকৃতির। ফলে পরিবার ও সমাজে উত্তেজনা, উগ্রতা ও আবেগতাড়িত আচরণের হার বেড়ে যাচ্ছে।

এ ছাড়া খুন, ধর্ষণ, অপহরণ ও মাদকাসক্তি ক্রমে বেড়েই চলছে। থমসন রয়টার্স ফাউন্ডেশনের সমীক্ষা অনুযায়ী যৌন সহিংসতার দিক থেকে ঢাকার অবস্থান চতুর্থ স্থানে।

অন্যদিকে এসব অনাচার, অবিচার, অপরাধের কোনো সুরাহা নাগরিকেরা পাচ্ছে না। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, প্রশাসন, বিচারালয় কোথাও তেমন প্রতিকার পাবে, তেমন বিশ্বাস নাগরিকদের মধ্যে নেই। তাই ডিপ্রেশন, অবসাদ, হতাশা বাড়ছে।

আমাদের ব্রেইনে রয়েছে একটি ‘স্বয়ংক্রিয় নার্ভাস সিস্টেম’ (অটোনমিক নার্ভাস সিস্টেম)। এটি আবার দুভাগে বিভক্ত। একটি হচ্ছে ‘প্যারাসিমপ্যাথেটিক, যা আমাদের শরীর-মনকে শান্ত, স্থির রাখতে সাহায্য করে। অন্যটি হচ্ছে ‘সিমপ্যাথেটিক’ বিভাগ, যা আমাদের উত্তেজিত করে, জরুরি পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত করে। এর জন্য প্রচুর শক্তি-সামর্থ্য একত্রে জড়ো করতে হয়। মানসিক চাপ আমাদের সিমপ্যাথেটিক সিস্টেমকে সব সময় সক্রিয়, সজাগ ও উত্তেজিত করে রাখে।

এর ফলে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, বিরক্তি, রাগ, ক্রোধ, আগ্রাসী আচরণ যেমন দেখা দিতে পারে, তেমনি পরবর্তী সময়ে ডিপ্রেশন বা অবসাদ, হতাশা, হাল ছেড়ে দেওয়া, অকেজো মানুষ হয়ে দাঁড়াতে পারে।.

সর্বোপরি চাপ যখন দীর্ঘস্থায়ী হয়, তখন শরীর অনবরত শক্তি জড়ো করতে থাকে এবং সে শক্তি অহেতুক ক্ষয় হতে থাকে। এভাবে ক্রমাগত শক্তি ক্ষয়ের ফলে শরীরের বিভিন্ন তন্ত্রের গঠনকাঠামোতেও পরিবর্তন সাধিত হয়। মানসিক চাপ-পীড়ন এভাবে বিভিন্ন শারীরিক রোগও তৈরি করে থাকে, যাকে আমরা ‘সাইকো-সোমাটিক ডিসঅর্ডার’ বলি।

আমাদেরও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি বাসযোগ্য, স্বস্তিযোগ্য, নিরাপদ ও নান্দনিক ঢাকা শহর গড়ে তোলার জন্য স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘস্থায়ী কর্মপরিকল্পনা এখনই হাতে নিতে হবে। সময় নষ্ট করার মতন সময় আমাদের নেই।

তা না হলে পরবর্তী প্রজন্ম আমাদের ক্ষমা করবে না।

সাম্প্রতিক কোটা সংস্কার আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন ছিল এই আর্থসামাজিক, প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক অব্যবস্থাপনা, বৈষম্য ও নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদ। যেকোনো চাপ, ক্ষোভ ক্রমাগত বাড়তে থাকলে একসময় এটি বিস্ফোরিত হয় নানা খাতের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। চাপের শহর ঢাকা বিস্ফোরিত হয়ে বিধ্বস্ত হওয়ার আগেই আমাদের কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।

অধ্যাপক ডা. মো. তাজুল ইসলাম: প্রফেসর অব সাইকিয়াট্রি, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, ঢাকা।

drtazul84@gmail.com

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More