নির্বাচনপূর্ব কিছু ঘটনা ও ভাবনা
বাংলাদেশে যদি নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন হয়, তা হলে দুই মাসও আর বাকি নেই। কিন্তু এ সম্পর্কে অনিশ্চয়তা এখনও দূর হয়নি। নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্পর্কিত প্রক্রিয়া সম্পর্কে বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে সরকারি দলের একটা সমঝোতা হবে কিনা; বৃহৎ বিরোধী গোষ্ঠী বিএনপি বর্তমানের অবস্থান ত্যাগ করে নির্বাচনে আসবে কিনা, নির্বাচনের আগে বিরোধী দলগুলো তাদের দাবি আদায়ের জন্য কোনো সফল আন্দোলন চালাতে পারবে কিনা, নাকি সরকারের অটল মনোভাবের সামনে সবাই শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে এসে যথাসময়ে তা অনুষ্ঠান সম্ভব করবে, সহজ করবে- এই আলোচনা দেশ-বিদেশে চলছে।
আমাদের বৃহৎ এবং নিকট প্রতিবেশী ভারতেও এই জল্পনা-কল্পনা চলছে। বর্তমান জটিল বিশ্ব পরিস্থিতিতে ভারত তার নিকট প্রতিবেশী দেশে স্থিতিশীল ও বন্ধুপ্রতিম সরকার চায়। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকুক- এটা আগের কংগ্রেস সরকার যেমন চেয়েছে এবং বর্তমান বিজেপি সরকারও চায় বলে অনুমিত হয়।
সম্প্রতি দিল্লির একটি ইংরেজি দৈনিকে বলা হয়েছে, বর্তমান ক্ষমতাসীন বিজেপি দলে দুটি অংশ। একটি হার্ডলাইনের, অন্যটি সফটলাইনের। সরকার, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সফটলাইন অনুসরণ করতে চান। তার বাধা হার্ডলাইনের উগ্র অংশ। এই অংশ থেকে মাঝেমধ্যে বাংলাদেশকেও হুমকি দেওয়া হয়। সম্প্রতি বিজেপির এক কট্টরপন্থি নেতা হুমকি দিয়েছেন, বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের ওপর অত্যাচার চলতে থাকলে দেশটির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে হাসিনা সরকার জানে, এটা বিজেপি সরকারের হুমকি নয়। তার উগ্র অংশের প্রলাপোক্তি।
দিল্লির এই পত্রিকাটির ধারণা, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাচন জয় এবং ক্ষমতায় টিকে থাকার ওপর শুধু দেশটির গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ নয়, সারা উপমহাদেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নির্ভর করছে। যদি বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত ও ভারতবিরোধী অন্যান্য ধর্মান্ধ দল ক্ষমতায় আসে এবং ভারতের প্রতি সামান্য বিরূপতাও দেখায়, পাকিস্তানের দিকে অধিক ঢলে পড়ে, তাহলে তার প্রতিক্রিয়ায় ভারতে বিজেপির কট্টর অংশ শক্তিশালী হবে। তারা বাংলাদেশ ও পাকিস্তানকে এক কাতারের শত্রু বলে চিহ্নিত করবে এবং সেই শত্রু দলে চীনকেও যুক্ত করে রণহুঙ্কার দ্বারা এশিয়ার বর্তমান রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নষ্ট করে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করে তুলতে পারে। এই উত্তপ্ত পরিস্থিতির সুযোগ নেবে ট্রাম্পের আমেরিকা।
পত্রিকাটি হাসিনা সরকারের নানা ত্রুটি-বিচ্যুতির (বিশেষ করে সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার মতো দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের এক বিচারপতির স্পর্শকাতর ইস্যুটি হ্যান্ডেল করা) কথা উল্লেখ করে লিখেছেন, এতদসত্ত্বেও এ সরকারই এখন সারা দক্ষিণ এশিয়ার জন্য স্ট্যাবিলাইজার- শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষার একমাত্র সরকার। হাসিনা সরকার ভারত ও চীনের সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য রক্ষা করে চলেছে। রোহিঙ্গা সমস্যা, যা নিয়ে আগুন জ্বলে উঠতে পারত, তাতে ধৈর্য ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচয় দিচ্ছে। বাংলাদেশের কাছ থেকে উৎসাহ ও সহযোগিতা পেলে পাকিস্তানের জঙ্গিদের ভারতবিরোধী তৎপরতা আরও বাড়ত। বিজেপির কট্টরপন্থিরা তার সুযোগ নিয়ে উপমহাদেশে অশান্তির আগুন জ্বালাতে পারত। হাসিনা সরকার এই পরিস্থিতিও সামাল দিয়েছে।
এ জন্যই ভারতের বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠ শান্তিকামী মানুষ কায়মনোবাক্যে আশা করে, বাংলাদেশে সবার অংশগ্রহণে শান্তিপূর্ণভাবে সাধারণ নির্বাচনটি হবে এবং আওয়ামী লীগ তাতে সরকার গঠনের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে। তবে দেশটিতে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখার স্বার্থে সংসদে যেন শক্তিশালী বিরোধী দলও থাকে। বাংলাদেশের একটি সুশীল সমাজের বর্তমান ভূমিকা সম্পর্কে পত্রিকাটি কটাক্ষ করে লিখেছে, এরা মরূদ্যানের গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে। দুর্গম মরুভূমিতে পথভ্রষ্ট পথিক কল্পনায় মরূদ্যান দেখে। সেদিকে ছুটকে গিয়ে মারা যায়। বাংলাদেশের সুশীল সমাজও গণতন্ত্রের এই মরীচিকার দিকে বিভ্রান্ত হয়ে ছুটছে।
পাকিস্তানেও বাংলাদেশ সম্পর্কে সাধারণ মানুষ ও বুদ্ধিজীবীদের একাংশের মধ্যে চিন্তা-চেতনার পরিবর্তন ঘটছে, শাসক সামরিক জান্তা এবং তাদের নিয়ন্ত্রণে চালিত তথাকথিত নির্বাচিত সরকারের বাংলাদেশবিদ্বেষী মনোভাব এখন দূর হয়নি। কিন্তু সচেতন সাধারণ মানুষ ও বুদ্ধিজীবীরা এখন বাংলাদেশের সঙ্গে মৈত্রী ও সহযোগিতা প্রতিষ্ঠায় উৎসুক। পাকিস্তানের একটি টেলিভিশনে টক শোতে বেশ কয়েকজন আলোচক দাবি করেছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক উন্নত করা হোক। টক শোতে এক আইনজীবী বলেছেন, ‘পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা এখন অনেক ভালো। নতুন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের উচিত শেখ হাসিনার নীতি অনুসরণ করা।’ টক শোর আরেক আলোচক তো স্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘পাকিস্তানের জন্য এখন একজন শেখ হাসিনা দরকার।’
বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার চাকরি ও দেশ ছাড়ার বিষয়টি বিজেপির কট্টরপন্থিরা হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছিল। এমন প্রচার চালানোর চেষ্টা হয়েছিল যে, বিচারপতি সিনহা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোক বলেই তাকে নানা অসত্য অভিযোগে পদ ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে। ভারতে এমন কথাও বলা হয়েছে, বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় কোনো উচ্চপদেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কেউ নেই। অথচ দেশটি নিজেকে সেক্যুলার বলে দাবি করে। দীর্ঘকাল পর একজন সংখ্যালঘু প্রধান বিচারপতি পদে বসানো হয়েছিল। তার আমলেই ‘৭১-এর যুদ্ধাপরাধী শীর্ষ নেতাদের বিচারে ফাঁসি দেওয়া সম্ভব হয়েছে। অথচ তাকে শেষ পর্যন্ত তাড়ানো হলো।
এ ব্যাপারে ভারতের একটি দৈনিকে বিচারপতি এস কে সিনহার ঘটনাটিকে পাকিস্তান আমলের যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলের ঘটনার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। যোগেন মণ্ডল ছিলেন জিন্নাহর দেশভাগের নীতির সমর্থক তফসিলি সম্প্রদায়ের নেতা। পাকিস্তান হওয়ার পর জিন্নাহ যে একটি ধর্মীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেননি, এটা প্রমাণ করার জন্য যোগেন মণ্ডলকে তিনি প্রথম পাকিস্তান গণপরিষদের সভাপতি করেন। পরে লিয়াকত মন্ত্রিসভায় আইনমন্ত্রী করেন।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আড়াই বছরের মধ্যে পাকিস্তান সরকার পাকিস্তান থেকে সংখ্যালঘু বিতাড়নের প্রচ্ছন্ন নীতি গ্রহণ করে। ১৯৫০ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে প্রচণ্ড সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধানো হয়। সংখ্যালঘুদের রক্ষা করার জন্য পূর্ব পাকিস্তানে ভারতের সামরিক অভিযান চালানোর হুমকি দেওয়া হয়। নেহরু তাতে বাধা দেন এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খানের সঙ্গে শান্তি বৈঠকে বসেন। নেহরু-লিয়াকত শান্তিচুক্তি হয়। কিন্তু পাকিস্তানের সংখ্যালঘু আইনমন্ত্রী যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল প্রাণভয়ে পাকিস্তান থেকে ভারতে পালিয়ে যান এবং ভারতে আশ্রয় নিয়ে করাচিতে আইনমন্ত্রী পদে তার ইস্তফাদানের চিঠি পাঠিয়ে দেন।
সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশে বিচারপতি এস কে সিনহার চাকরিতে ইস্তফা ও দেশত্যাগের সঙ্গে পাকিস্তান আমলে যোগেন মণ্ডলের কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রীর পদ ছেড়ে দেশ থেকে পলায়নের ঘটনার তুলনা টেনে কোনো কোনো ভারতীয় পত্রিকায় হাসিনা সরকার সম্পর্কে কটাক্ষ করার চেষ্টা হয়েছে। এই চেষ্টাটা বাংলাদেশ থেকে বিচারপতির শুভানুধ্যায়ী বলে পরিচিত একশ্রেণির লোকও করেছেন। তাদের চেষ্টা সফল হয়নি। এটা ইনফরমেশন এইজ। তথ্যপ্রযুক্তির এই বিস্ময়কর উন্নতির যুগে গ্রামের এক নিরক্ষর চাষাও এখন দুনিয়ার অনেক খবর জানে।
ভারতের অধিকাংশ মানুষ, বিশেষ করে মিডিয়ার লোকজন জানেন, অনেক বাধা ও আপত্তির মুখে শেখ হাসিনাই বিচারপতি এস কে সিনহাকে প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগ দেন। নারীর ক্ষমতায়নের সঙ্গে এতদিনের অধিকারবঞ্চিত সংখ্যালঘুদের ক্ষমতায়নও তার সরকারের নীতি হিসেবে গ্রহণ করেন। বিচারপতি এস কে সিনহার বেলায় এই নীতি যে কিছুটা হোঁচট খেয়েছে, তার জন্য বিচারপতি নিজেও কিছু দায়ী।
‘৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সময়ই তিনি নিজেকে কিছুটা বিতর্কিত করে তোলেন এবং ব্যক্তিগতভাবে তার কাছে শ্রদ্ধেয় কিছু প্রবীণ আইনজীবী ও রাজনীতিক, যারা হাসিনাবিরোধী নানা চক্রান্তে যুক্ত, তাদের দ্বারা প্রভাবিত হন। তাছাড়া আমাদের বর্তমান আইনমন্ত্রীও বিচারপতির স্বাধীন চিত্ত মনোভাব সহ্য করতে পারেননি। এভাবে নানা ঘটনার মিশ্রণে বর্তমান পরিস্থিতির উদ্ভব। এর সঙ্গে সংখ্যালঘুদের প্রতি উপেক্ষার মনোভাবের কোনো সম্পর্ক নেই।
আমি আশাবাদী, কোটা পদ্ধতি বাতিল এবং নিরাপদ সড়কের দাবির আন্দোলনকে পথভ্রষ্ট করে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহারের জন্য হাসিনাবিরোধী নানামতের নানা মুনীদের জোট যেমন ব্যর্থ হয়েছে, তেমনি বিচারপতি সিনহাকে নিয়ে তাদের নতুন জোট পাকানোও ব্যর্থ হবে। ঘোষিত নির্বাচন হবে এবং গণতান্ত্রিক বাংলাদেশই গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের দিকে সারা উপমহাদেশকে পথ দেখাবে বলে আমার বিশ্বাস।