শিক্ষকতা কেবল চাকরি নয়

0

 

 

শোষণমুক্ত সমাজ তথা সোনার বাংলা নির্মাণের লক্ষ্যে বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিভিত্তিক যুগোপযোগী একটি কল্যাণমুখী শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের কার্যক্রম গ্রহণ করেন, যার সার্থক রূপায়ণ প্রখ্যাত ড. কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন অর্থাৎ শিক্ষা জাতীয়করণ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পরপরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ উদ্দেশ্যে শিক্ষার প্রাথমিক স্তর বা ভিত্তি হিসেবে ৩৭ হাজার প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এক লাখ ৬২ হাজার শিক্ষককে জাতীয়করণের ঘোষণা দেন, যা ছিল তৎকালীন পরিপ্রেক্ষিতে অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও দুঃসাহসিক। তিনি শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণের লক্ষ্যে বাজেটে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দের জন্য অর্থমন্ত্রীকে নির্দেশ দিলে অর্থমন্ত্রী যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্যোজাত বাংলাদেশের অর্থ সংকটের কথা জানালে বঙ্গবন্ধু সেদিন বলেছিলেন- ‘আমার সোনার বাংলা গড়তে হলে সোনার মানুষ চাই। শিক্ষকরা হলেন সোনার মানুষ তৈরির কারিগর। শিক্ষকদের পেটে ক্ষুধা রেখে সোনার মানুষ তৈরি করা সম্ভব নয়। যেখান থেকে পারো টাকার ব্যবস্থা করো- শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণ করতে হবে।’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শুধু প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণ করে স্বস্তিবোধ করেননি, শিক্ষার বৈষম্য দূরীকরণ এবং ক্রমান্বয়ে একটি সুষম স্তরে উন্নীত করার প্রত্যয়ে তিনি মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রেও কার্যক্রম গ্রহণ করেছিলেন। তিনি পর্যায়ক্রমে শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণের চিন্তা করেছিলেন।

 

উল্লেখ করা প্রয়োজন, বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা একসময় কোনো বেতনই পেতেন না। মূলত শিক্ষাদানকে ব্রত হিসেবে গ্রহণ করে শুধু দেশসেবার মানসিকতা নিয়েই তখন তারা শিক্ষকতায় আসতেন। ১৯২০ সালে গাইবান্ধায় শিক্ষকদের একটি সম্মেলনে তাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে অবিভক্ত বাংলার তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী বেসরকারি শিক্ষকদের জন্য মাসিক পঁাঁচ টাকা এবং কর্মচারীদের জন্য তিন টাকা বেতন চালুর ঘোষণা দেন। স্বাধীন বাংলাদেশে জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানই প্রথম বেসরকারি মাধ্যমিক ও স্কুল শিক্ষকদের মাসিক ৭৫ টাকা এবং কলেজ শিক্ষকদের মাসিক ১০০ টাকা বেতন-ভাতা চালু করেন।

 

বর্তমানে বাংলাদেশে সরকারি, বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় বাংলা, ইংরেজি ও আরবি মাধ্যমে প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, কারিগরি ও উচ্চশিক্ষা ইত্যাদি বিভিন্ন স্তরের শিক্ষার প্রচলন রয়েছে। এর মধ্যে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা অধিকাংশই সরকারি ব্যবস্থায় পরিচালিত হলেও একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষা বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা ও কিন্ডারগার্টেনের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। কিন্তু মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে প্রায় ৯৭ শতাংশ শিক্ষা এখনও বেসরকারি উদ্যোগে পরিচালিত হচ্ছে। যদিও অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান সরকারি এমপিওভুক্ত হওয়ায় এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের বৃহদাংশের বেতন ও নির্ধারিত ভাতা সরকার থেকে বহন করা হয়।

 

বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী (এপ্রিল-২০১৮) বাংলাদেশে বর্তমান প্রায় এক লাখ ৩৩ হাজার ৯০১টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী রয়েছে এক কোটি ৭২ লাখ ৫১ হাজার, শিক্ষক সংখ্যা ৬ লাখ ২৪ হাজার। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ১৯ হাজার ৮৪৮টি, শিক্ষার্থী এক কোটি দুই লাখ ৪০ হাজার, শিক্ষক দুই লাখ ৪৪ হাজার। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চার হাজার ৪১৯টি, শিক্ষার্থী ৩৮ লাখ ৭৩ হাজার এবং শিক্ষক সংখ্যা এক লাখ ২১ হাজার। আলিয়া মাদ্রাসা ৯ হাজার ৩০৩টি, শিক্ষার্থী ২৪ লাখ ৫৩ হাজার ৩০৫ জন, শিক্ষক এক লাখ ১৩ হাজার ৩৬৮ জন। কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (ভোকেশনাল, বিএম কলেজ, পলিটেকনিক) ৫ হাজার ৮৯৭টি, শিক্ষার্থী আট লাখ ৭৫ হাজার ২৭০ জন, শিক্ষক ৩২ হাজার ৩৭৯ জন। বিশ্ববিদ্যালয় (সরকারি, বেসরকারি) ১৩০টি, শিক্ষার্থী ৮ লাখ ২৪ হাজার ৭৬৯ জন, শিক্ষক ২৭ হাজার ৭৯৪ জন। এ ছাড়াও বেসরকারি পর্যায়ে পরিচালনাধীন কিন্ডারগার্ডেন রয়েছে প্রায় ৫০ হাজার, শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৫০ লাখ এবং শিক্ষক সংখ্যা প্রায় ৩৫ হাজার। ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রমের আওতায় ৭০ হাজার প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী রয়েছে প্রায় ২৫ লাখ এবং শিক্ষক সংখ্যা ৭০ হাজার। স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা রয়েছে প্রায় চার হাজার, শিক্ষার্থী প্রায় চার লাখ, শিক্ষক প্রায় ১৬ হাজার। বেসরকারি পর্যায়ে কওমি মাদ্রাসা রয়েছে প্রায় ১৪ হাজার, শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ১৪ লাখ এবং শিক্ষক রয়েছেন ৭৩ হাজার ৭৩১ জন। এ ছাড়াও বেসরকারি পর্যায়ে এনজিও পরিচালনাধীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কয়েক লাখ শিক্ষার্থী ও কয়েক হাজার শিক্ষক রয়েছেন।

 

সরকার শিক্ষার উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। শিক্ষানীতি প্রণয়ন, ২৬ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ, ২০ শতাংশ মহার্ঘ ভাতা প্রদান, জাতীয় বেতন স্কেলে বেসরকারি শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্তি, ডিজিটাল ক্লাসরুম, প্রায় ১৬ হাজার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সহকারী প্রধান শিক্ষকের আলাদা বেতন স্কেল প্রদান, বিনামূল্যে বই প্রদান, সাত হাজার বিদ্যালয়ে সহকারী লাইব্রেরিয়ান নিয়োগ, বেসরকারি শিক্ষকদের বাড়ি ভাড়া ১০০ থেকে এক হাজার টাকা বৃদ্ধি, মেডিকেল ভাতা ৩০০ থেকে ৫০০ টাকায় উন্নীত, ১৭ বছরেরর পুরনো পাঠ্যপুস্তক যুগোপযোগী, ৭৮ লাখ প্রাথমিক ও ৪০ লাখ মাধ্যমিক শিক্ষার্থীকে উপবৃত্তি প্রদান, উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির আওতাভুক্ত করা, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের কল্যাণ এবং অবসর ভাতার জন্য ১৬০৭ কোটি টাকা বিশেষ বরাদ্দ, শিক্ষাক্ষেত্রে আধুনিকায়ন এবং প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে ডিজিটাল ল্যাব, অবকাঠামো ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নয়ন ও সম্প্রতি আলিয়া মাদ্রাসার ভৌত অবকাঠামো নির্মাণের জন্য ছয় হাজার কোটি টাকা একনেকে অনুমোদন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সরকারের পক্ষ থেকে এসব উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা সত্ত্বেও এখনও শিক্ষাক্ষেত্রে অনেক সমস্যা বিরাজমান। এখনও বিভিন্ন স্তরের ৯৪৪৮টি নন-এমপিও প্রতিষ্ঠানে প্রায় লক্ষাধিক শিক্ষক মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এসব শিক্ষক যুগ যুগ বিনা বেতনে শিক্ষকতা করছেন। শিক্ষার অগ্রগতির ক্ষেত্রে এটা একটা বড় বাধা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কমিটি অযাচিত হস্তক্ষেপ শিক্ষার উন্নয়নে একটি ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, কমিটির অযাচিত হস্তক্ষেপে শিক্ষকদের চাকরি হারাতে হয়। এমতাবস্থায় শিক্ষকদের স্বাধীনভাবে কাজ করা সম্ভব হয় না।

 

মানসম্পন্ন শিক্ষার জন্য প্রয়োজন মানসম্মত শিক্ষক। মানসম্মত শিক্ষক পেতে হলে শিক্ষকদের আর্থিক সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি, চাকরির নিশ্চয়তা, অবকাঠামো উন্নয়ন, ব্যবস্থাপনা কমিটির অযাচিত হস্তক্ষেপ বন্ধ করা জরুরি। বর্তমানে বাংলাদেশ অর্থনীতিতে ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। সরকার অনেক বেসরকারি স্কুল-কলেজকে জাতীয়করণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। যেসব উপজেলায় সরকারি স্কুল ও কলেজ নেই, সেসব উপজেলায় একটি করে মাধ্যমিক স্কুল এবং একটি করে কলেজ জাতীয়করণ করা হয়েছে। ফলে সারাদেশে ৩৯২টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং ২৮২টি কলেজ জাতীয়করণ করা হয়েছে। একই সঙ্গে এবারই প্রথম দিনাজপুরে একটি আলিয়া মাদ্রাসা জাতীয়করণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এটা শুভ উদ্যোগ। শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণ এখন সময়ের দাবি। তবে সরকার শর্তসাপেক্ষ হলেও পুরো শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণের উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে। প্রয়োজনে শিক্ষার একটি মান নির্ধারণ করা যেতে পারে। জাতীয়করণের ফলে ব্যবস্থাপনা কমিটির অযাচিত হস্তক্ষেপ বন্ধ হবে এবং এতে করে তাদের চাকরির নিশ্চয়তা পাবে। পাশাপাশি আর্থিক সুবিধা বৃদ্ধি পাওয়ায় শিক্ষকদের কোচিংসহ বাড়তি আয়ের জন্য অন্যত্র সময় ব্যয় না করে পঠন-পাঠনে অধিক মনোযোগী হতে পারবেন। এতে করে শিক্ষক ও শিক্ষার মান বৃদ্ধি পাবে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষকদের শিক্ষকতা পেশাকে শুধু চাকরি মনে না করে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে শিক্ষকতার মহান পেশার মর্যাদাকে সর্বাগ্রে স্থান দিতে হবে।

 

শিক্ষার মান রাতারাতি উন্নয়ন করা সম্ভব নয়, এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। বর্তমান সরকারের শাসনামলে শিক্ষাক্ষেত্রে আগের তুলনায় অনেক অগ্রগতি হয়েছে। তবে চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জন তথা শিক্ষাকে বিশ্বমানে পৌঁছানোর জন্য আরও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ প্রয়োজন। শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি, অবিলম্বে শিক্ষা আইন বাস্তবায়ন, শিক্ষকদের আর্থিক সুবিধা বৃদ্ধি, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ আরও বৃদ্ধি, শিক্ষাঙ্গনের অবকাঠামোর আরও উন্নয়ন এবং শিক্ষা উপকরণের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি, শিক্ষা প্রশাসন, বিভিন্ন অধিদপ্তর, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সৎ, যোগ্য এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কর্মকর্তাদের পদায়ন, প্রশ্নপত্র ফাঁস, কোচিং বাণিজ্য, প্রশ্ন বাণিজ্য, বই বাণিজ্য এবং নৈতিকতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্নিষ্টদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে বাণিজ্যিকীকরণের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ, মাদ্রাসা শিক্ষাকে আরও আধুনিকীকরণ ও যুগোপযোগী করার পাশাপাশি আরবি শিক্ষাকে আরও জোর দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক যে বিশাল কর্মবাজার রয়েছে, তা করায়ত্ত করার সুযোগ গ্রহণ করতে হবে।

সেক্রেটারি ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অব টিচার্স ইউনিয়ন সাধারণ সম্পাদক, স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদ

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More