জিহান মোবারক
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি অস্থির অঞ্চলে পরিণত হয়। উপজাতি নেতৃত্বের মধ্যে আশঙ্কা তৈরি হয় যে, নতুন রাষ্ট্র হয়তো তাদের স্বকীয়তা ও স্বায়ত্তশাসনের দাবি উপেক্ষা করবে। এই আশঙ্কা থেকেই ১৯৭২ সালে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা (এম.এন লারমা) পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিদের জন্য বিশেষ স্বীকৃতি ও স্বায়ত্তশাসন দাবিতে ৪ দফা দাবি সরকারের কাছে উপস্থাপনা করে এবং আন্দোলন শুরু করেন।
তবে, এ আন্দোলন রাজনৈতিক দাবির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি; বরং ভারতীয় প্রভাব ও সহায়তায় তা একটি সশস্ত্র বিদ্রোহে রূপ নেয়। গঠিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) এবং এর সশস্ত্র শাখা, যা ‘শান্তিবাহিনী’ নামে পরিচিত। দীর্ঘ সময় ধরে চলা এই সংঘাত, শান্তিচুক্তি ও বর্তমান বাস্তবতা নিয়ে বিশদ আলোচনা করব এই লেখায়।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি নেতাদের মধ্যে একাংশ মনে করেছিল, নতুন রাষ্ট্র হয়তো তাদের সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার খর্ব করতে পারে। ফলে, এম.এন লারমা ১৯৭২ সালে সংবিধানে উপজাতিদের পৃথক জাতিসত্তার স্বীকৃতি এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে স্বায়ত্তশাসনের দাবি উত্থাপন করেন।
কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই দাবি প্রত্যাখ্যান করেন এবং স্পষ্ট করে দেন যে, বাংলাদেশে বসবাসকারী সকল জনগোষ্ঠী বাঙালি জাতির অংশ। এই সিদ্ধান্ত উপজাতি নেতৃত্বকে ক্ষুব্ধ করে তোলে এবং তারা সশস্ত্র বিদ্রোহের পথে হাঁটতে শুরু করে। এমনটাই কথিত আছে।
১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি জেএসএস গঠিত হয় এবং ১৯৭৩ সালের ৭ জানুয়ারি ভারতের প্রত্যক্ষ সহায়তায় জেএসএস-এর সশস্ত্র শাখা ‘শান্তিবাহিনী’ প্রতিষ্ঠিত হয়।
শান্তিবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামে একের পর এক নৃশংস হামলা চালায়, যা রাষ্ট্রের জন্য হুমকিস্বরূপ হয়ে ওঠে। ১৯৭৭ সালে খিরাম বন বিভাগে বনকর্মীদের হত্যা করা হয়। জুরাছড়ি পুলিশ ক্যাম্পে হামলা চালানো হয়। সাঙ্গু নদীতে টহলরত সেনাদের উপর গুলিবর্ষণ করা হয়, যাতে পাঁচজন সেনা সদস্য নিহত হন। সূত্র হিলনিউজবিডি
এই ধরনের হামলা ও সন্ত্রাসী কার্যক্রমের ফলে সরকার ১৯৭৭ সালে বিপুলসংখ্যক সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নেয়। সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করা হয়।
লারমার ছোটভাই সন্তু লারমাকে গ্রেফতার করে আলোচনার টেবিলে আসার জন্য ছেড়েও দেওয়া হয়। কিন্তু কিছু সুফল বয়ে আনেনি।
পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে জিয়াউর রহমান ১৯৭৯ সালে অক্টোবর-নভেম্বর থেকে বাঙালি পুনর্বাসন প্রকল্প শুরু করেন, যা ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত চলে।
সরকারের এই পরিকল্পনার মাধ্যমে লক্ষাধিক বাঙালিকে পার্বত্য চট্টগ্রামে পুনর্বাসিত করা হয়। তবে অনেক বাঙালি শান্তিবাহিনীর হামলা, ম্যালেরিয়া ও প্রতিকূল ধ্বংসাত্মক পরিবেশের কারণে সমতলে ফিরে যায়। অবশিষ্ট বাঙালি সরকারের নামমাত্র সহায়তায় ঘর নির্মাণ করেন। এতে উপজাতিরা নিজেদের আধিপত্যের জায়গা সংকুচিত হতে দেখে এবং তাদের মধ্যে ক্ষোভ জন্ম নেয়।
ফলস্বরূপ, শান্তিবাহিনী পাহাড়ে বাঙালিদের ওপর ব্যাপক গণহত্যা চালায়। বাঙালিদের গ্রামে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। সাধারণ বাঙালিদের ওপর বর্বরোচিত হামলা চালানো হয়। নারীদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালানো হয় শিশুদেরও রেহাই দেওয়া হয়নি।
এ সময় সেনাবাহিনীর সঙ্গে শান্তিবাহিনীর সংঘর্ষ বৃদ্ধি পায়। সংঘর্ষে সেনাবাহিনী, শান্তিবাহিনী, বাঙালি ও উপজাতিরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে, শান্তিবাহিনী ও উপজাতিদের তুলনায় সেনাবাহিনী ও বাঙালিরা বেশি ক্ষয়ক্ষতির শিকার হন।
১৯৮২ সাল থেকে সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যার সমাধানে শান্তিবাহিনীর সঙ্গে আলোচনা শুরু করে। প্রায় ২৪ টি বৈঠকে আলোচনার পর ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর শেখ হাসিনা সরকার এবং সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন শান্তিবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষর করে।
তবে, এই চুক্তি নিয়ে বিতর্ক থেকে যায়।
চুক্তিতে বাঙালিদের স্বার্থ রক্ষা হয়নি।চুক্তির মাধ্যমে জেএসএস অনেক সুযোগ-সুবিধা পেলেও, অবৈধ অস্ত্র পুরোপুরি জমা দেয়নি। চুক্তির পরও জেএসএস চাঁদাবাজি, অপহরণ, খুন এবং আধিপত্য বিস্তারের লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।
শান্তিচুক্তির পর জেএসএসের একাংশ বিদ্রোহ ঘোষণা করে এবং ১৯৯৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) প্রতিষ্ঠা করে। এর ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের সংঘাত আরও দীর্ঘায়িত হয়।
পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির পরও সহিংসতা কমেনি। চুক্তির পূর্বে যেভাবে শান্তিবাহিনী সশস্ত্র অবস্থায় ছিল, চুক্তির পরও তারা অস্ত্র জমা না দিয়ে গোপনে তাদের বাহিনী টিকিয়ে রাখে।
শান্তিবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামে ৩০ হাজারের বেশি বাঙালিকে হত্যা করেছে। অপহরণ, গুম, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ছিল শান্তিবাহিনীর অন্যতম অস্ত্র।
বর্তমানে জেএসএস এবং ইউপিডিএফ পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে একে অপরের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত। এই সংঘর্ষে সাধারণ পাহাড়ি এবং বাঙালিরা ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন।
পার্বত্য চট্টগ্রামের সংকটের শেকড় বহু গভীরে। স্বাধীনতার পর থেকেই এটি একটি স্পর্শকাতর ইস্যু ছিল, যা সময়ের সাথে পরিবর্তিত হয়ে এখনো বিদ্যমান।
অবৈধ অস্ত্রের আধিপত্য এবং জেএসএস-ইউপিডিএফ সংঘাত পার্বত্য অঞ্চলের স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করছে।বাঙালিদের স্বার্থরক্ষা না করেই চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ায় অনেকেই মনে করেন, এটি একপক্ষীয় সিদ্ধান্ত ছিল।
সরকারের উচিৎ পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী শান্তির জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করা এবং সাধারণ জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। অন্যথায়, এই সংঘাত অব্যাহত থাকবে, যা পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়ন ও সম্প্রীতিকে বাধাগ্রস্ত করবে।