| এনামুল হক, বাঘাইছড়ি |
পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস নানা ঘটনাবহুল। নানা সংঘাত, রাজনৈতিক টানাপোড়েন এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাহাঙ্গামার ভেতর দিয়ে এই অঞ্চলের বর্তমান চিত্র রূপ নিয়েছে। এর মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো ২০১০ সালের ১৯ ও ২০ ফেব্রুয়ারি সংঘটিত বাঘাইছড়ি সাজেকের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। দীর্ঘদিন ধরেই এই ঘটনা নিয়ে নানাভাবে অপপ্রচার চালানো হয়েছে, যা প্রকৃত সত্যকে আড়াল করার এক সুপরিকল্পিত প্রচেষ্টা বলে মনে হয়।
কী ঘটেছিল ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে?
২০১০ সালের ১৯ ও ২০ ফেব্রুয়ারি, ইউপিডিএফ (ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট) নামক পার্বত্য বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন বাঙালিদের ওপর ভয়াবহ হামলা চালায়। হামলার মূল লক্ষ্য ছিল বাঙালি ও পার্বত্য শান্তিচুক্তির বিরোধিতা এবং নিজেদের প্রভাব বজায় রাখা। হামলায় নিরীহ দুই বাঙালি নিহত হয়। ছড়িয়ে পড়া সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দিন রাত অবিরত চলতে থাকে। সেদিন সেনাবাহিনী ও পুলিশের সঙ্গে ইউপিডিএফ সশস্ত্র গ্রুপের গুলিবিনিময় হয়। এসময় গুলিতে বুদ্ধপুদি চাকমা ও লক্ষ্মী বিজয় চাকমা নামে দুইজন নিহত হয়। ইউপিডিএফ এর নেতৃত্বে জ্বালিয়ে দেওয়া হয় কয়েকটি জনপদ৷
তৎকালীন সময়ে সাজেক অঞ্চলের গঙ্গারাম বাজার ছিল ব্যবসা ও জনজীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। ইউপিডিএফের সন্ত্রাসীরা বাঙালি জনগোষ্ঠীর ওপর অপ্রত্যাশিত আক্রমণ চালিয়ে বাজার বন্ধ করে দেয়। আজও সেই বাজার কার্যত বন্ধ রয়েছে। তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল এই অঞ্চলে বাঙালিদের ব্যবসা ও বসবাস স্থায়ীভাবে ব্যাহত করা।
ইউপিডিএফ কেবল বাঙালিদের ওপর নয়, উপজাতি জনগোষ্ঠীর উপরও নৃশংস হামলা চালায়। চাকমা সম্প্রদায়ের বসতঘর, স্কুল ও বৌদ্ধ বিহারেও ইউপিডিএফের সন্ত্রাসীরা হামলা চালায় এবং অগ্নিসংযোগ করে। উভয় সম্প্রদায়ের প্রায় ৪ শতাধিক ঘরবাড়ি অগ্নি সংযোগ করে। এ কারণে চাকমা জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশও তাদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করে।
এই ঘটনার জন্য চাকমারা সরাসরি ইউপিডিএফকে দায়ী করে। এমনকি, ইউপিডিএফ নিজের দায় এড়াতে শেষ পর্যন্ত নিজেদের স্বজাতি উপজাতিদের ওপর হামলা চালায়। এতে শত শত উপজাতি ও বাঙালি পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
তথ্যসূত্র বলছে, ইউএনডিপি, দাতা সংস্থা ও এনজিওগুলো থেকে কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ পাওয়ার উদ্দেশ্যেই ইউপিডিএফ এই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি করেছিল। আন্তর্জাতিক মহলে পার্বত্য চট্টগ্রামকে ‘সংখ্যালঘু নিপীড়িত অঞ্চল’ হিসেবে দেখিয়ে তহবিল সংগ্রহের জন্যই এই বিশৃঙ্খলার পরিকল্পনা করা হয়।
এই ষড়যন্ত্র এতটাই সুপরিকল্পিত ছিল যে, ইউপিডিএফ নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ ও আর্থিক লোভে নিরীহ মানুষদের রক্ত ঝরাতেও পিছপা হয়নি।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য ও এলথাঙ্গা পাংখোয়ার স্বীকারোক্তি: সাজেকের সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান এলথাঙ্গা পাংখোয়া নিজেই স্বীকার করেছিলেন যে, এই ঘটনার জন্য ইউপিডিএফ সন্ত্রাসীরাই দায়ী। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের সত্য ঘটনা তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে হত্যা করা হয়। এটি কোনো সাধারণ হত্যাকাণ্ড ছিল না। এটি ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভীষিকাময় এক সত্যের মুখ বন্ধ করার চেষ্টা।
গণমাধ্যমের মিথ্যাচার ও প্রকৃত সত্য আড়াল করার প্রচেষ্টা: বাঘাইছড়ি দাঙ্গা নিয়ে দেশের তথাকথিত মূলধারার গণমাধ্যমগুলো সত্যকে বিকৃত করে উপস্থাপন করেছে। তারা বিভ্রান্তিকর রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। মূলধারার গণমাধ্যমগুলো বাঙালিদের দায়ী করে সংবাদ প্রকাশ করে। বলা হয়, এটি ‘ভূমি দখলের’ জন্য সংঘটিত সংঘর্ষ। প্রকৃতপক্ষে, হামলা চালায় ইউপিডিএফ প্রসিত গ্রুপের সন্ত্রাসীরা।
সেনাবাহিনী ও রাষ্ট্রের ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা: দাঙ্গার সময় সেনা-পুলিশের সঙ্গে ইউপিডিএফ সন্ত্রাসীদের সংঘর্ষ হয়। এই গুলি বিনিময়ের সময় ২ জন নিহত হয়।
অথচ, মূলধারার সংবাদমাধ্যম এটি এমনভাবে প্রচার করে যেন সেনাবাহিনী পরিকল্পিতভাবে এই ঘটনা ঘটিয়েছে। ইউপিডিএফ বাঘাইহাট জোনের তৎকালীন কমান্ডার লে. কর্নেল ওয়াসিম, টু-আই-সি মেজর জুলফিকার ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে দায়ী করেছে।
বাঙালিদের অন্যায়ভাবে অভিযুক্ত করা: ঘটনায় ইউপিডিএফ সরাসরি দায়ী হওয়া সত্ত্বেও বাঙালিদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। বাঘাইহাট বাজারের ফার্মেসি দোকানদার ডা. নাজিম উদ্দিন, ভিডিপি সদস্য সেলিম, গাড়ি লাইনম্যান কাসেমসহ বেশ কয়েকজনকে অভিযুক্ত করে মামলার আসামী করা হয়। মূল অপরাধীদের আড়াল করা হয়, যাতে বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী নিরাপদে থাকে।
ইউপিডিএফের বিচার হয়নি কেন?
দাঙ্গার মূল হোতা ইউপিডিএফ প্রসিত গ্রুপের সন্ত্রাসীদের আজও আইনের আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। বিচার ব্যবস্থার দুর্বলতা ছিল এর অন্যতম কারণ। পার্বত্য চট্টগ্রামে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিচার হয় না বললেই চলে। আন্তর্জাতিক চাপে সরকার নীরব, দাতা সংস্থাগুলোর চাপে সরকার অনেক সময় কঠোর ব্যবস্থা নিতে পারে না। তদন্তে প্রভাব এবং স্থানীয় প্রশাসনের উদাসীনতাও অনেক ক্ষেত্রে দায়ী।
সুশীল সমাজের ভণ্ডামি: দেশের তথাকথিত সুশীল সমাজ বাঙালি ও সেনাবাহিনীকেই দোষারোপ করে। পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে একপেশে বক্তব্য প্রদান করে। তাদের চোখে উপজাতিরা নিরীহ ও সহজসরল। অথচ এই উপজাতিরা একে-৪৭ ব্যবহার করে!
পার্বত্য চট্টগ্রামের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মূল হোতারা কারা? বাঘাইছড়ির সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতিটি দাঙ্গার মূল হোতা ইউপিডিএফ ও জেএসএস নামক বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলো। তারা নিজেদের স্বার্থের জন্য দাঙ্গা সৃষ্টি করে উপজাতি-বাঙালি উভয় জনগোষ্ঠীকে ব্যবহার করে সংঘর্ষ বাধায়। তারপর আন্তর্জাতিক মহলে নিজেদের ‘নিপীড়িত’ দেখিয়ে অর্থ সংগ্রহ করে।
২০১০ সালের বাঘাইছড়ির সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নিয়ে চলমান অপপ্রচার একটি পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। ইউপিডিএফের দায় এড়ানোর কৌশল হিসেবে মূলধারার গণমাধ্যম এবং তথাকথিত সুশীল সমাজ মিথ্যাচার চালিয়ে গেছে।
এই ঘটনার প্রকৃত অপরাধীদের চিহ্নিত করে যদি দ্রুত বিচারের আওতায় আনা না হয়, তবে পার্বত্য চট্টগ্রামের সংকট আরও গভীর হবে। ইউপিডিএফ, জেএসএসের মতো সন্ত্রাসীগোষ্ঠীগুলো যদি এভাবেই পার পেয়ে যায়, তাহলে ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহ দাঙ্গার আশঙ্কা থেকেই যায়।
সত্য প্রকাশ করা এবং ইতিহাসকে বিকৃতির হাত থেকে রক্ষা করাই আমাদের দায়িত্ব। বাঘাইছড়ি দাঙ্গার প্রকৃত অপরাধীদের চিহ্নিত করতে হবে, বিচার নিশ্চিত করতে হবে এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে হবে।