হুময়ান কবির, কাউখালী প্রতিনিধি
রাঙামাটি জেলার কাউখালী উপজেলার ৩ নং ঘাগড়া ইউনিয়নের ১ নং ওয়ার্ডের কাশখালী গ্রামের বাসিন্দা মোঃ আলী হোসেন। সেনাবাহিনীর চাকরির সূত্রে মূলত পাহাড়ে বসবাস। তিনি দীর্ঘদিন কাশখালী সেনা ক্যাম্পে ছিলেন, এবং তিনি তৎকালীন সেনাবাহিনীর নায়েক ছিলেন। সন্তান মোঃ জহির-কে হত্যার প্রক্কালে তিনি লংগদু উপজেলার মাইনি সেনা ক্যাম্পে কর্তব্যরত ছিলেন৷ এসময় পরিবারের সদস্যরা সবাই কাউখালী উপজেলার কাশখালী গ্রামে ছিল।
তৎকালীন পাহাড়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস) তথাকথিত শান্তিবাহিনীর সন্ত্রাসীরা পুরোদমে নির্বিচারে বাঙালি গণহত্যায় মেতে উঠে ছিল।একের পর এক বাঙালি হত্যা করে পাহাড় থেকে বাঙালিকে নিধন করা যেনো তাদের নেশা ছিল।
কাশখালী গ্রাম থেকে নাভাঙ্গা মোঃ জহির (১৫) ও মোঃ হাসেম (২০) লাকড়ি সংগ্রহ করতে যান। নাভাঙ্গা গিয়ে শান্তিবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে দু’জনেই। প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপে শান্তিবাহিনীর দু’টি গ্রুপ থেকে দৌড়ে পালিয়ে রক্ষা পেলেও তৃতীয় ধাপে শান্তিবাহিনীর একটি তৃতীয় গ্রুপের হাতে সর্বশেষ ধরা পড়ে হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে হয় জহির-কে। কিন্তু এখান থেকে বেঁচে ফিরে আসেন মোঃ হাসেম।
ঐদিন আরো ২ জনকে হত্যা করে শান্তিবাহিনীর সন্ত্রাসীরা। সর্বমোট ঐদিন ৩ জনকে হত্যা করে।
ঐদিন নিহত ৩ জনের মধ্যে মোঃ জহির, মোঃ নাজিম উদ্দিনের পিতা ও মোঃ জালাল উদ্দিনের পিতাও ছিল। নাজিমের পিতা ও জালালের পিতা দু’জনেই একসাথে লাকড়ি সংগ্রহ করতে যায়। এ দু’জনকে একসাথে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।
জহির সহ ৩ হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটা ঠিক পার্বত্য চুক্তির ১ বছর আগে হয়েছিল। ১৯৯৬ সালে
মোঃ জহিরের বয়স ছিল ১৫ বছর। কাউখালী পোয়াপাড়া হাই স্কুলের মেধাবী ছাত্র ছিল জহির। নবম শ্রেণীতে ১ নম্বর রোল নাম্বার ছিল তার। এমন মেধাবী ছাত্রকে শান্তিবাহিনীর সন্ত্রাসীরা নির্মমভাবে হত্যা করে। জহির হত্যাকাণ্ডের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে জহিরের ছোটভাই ফারুক কান্নায় ভেঙে পড়েন।
যে স্থানে জহিরকে হত্যা করা হয় সেস্থান থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে ছিল তৎকালীন নাভাঙ্গা সেনাক্যাম্প, যেটা পার্বত্য চুক্তির শর্ত অনুযায়ী প্রত্যাহার করা হয়েছিল।
ফারুক বলেন, সাপ্তাহিক বাজারের আগের দিন, বুধবার সকাল সাড়েটার সময় ঘর থেকে লাকড়ি সংগ্রহ করতে জহির ও হাসেম একসঙ্গে নাভাঙ্গা যায়৷ নাভাঙ্গা গিয়ে শান্তিবাহিনীর একটি গ্রুপের হাতে সর্বপ্রথম তারা দু’জনেই আটক হয়। শান্তিবাহিনী তাদের দুইজনকে বেধড়ক মারধর করেন, এখান থেকে দৌড়ে পালিয়ে গিয়েছে সামনে শান্তিবাহিনীর দ্বিতীয় একটি গ্রুপের হাতে আটক হয় তারা। এখানে তাদের দুইজনকে কুপানো হয়, সারা শরীরে ব্লেড দিয়ে কেটে কেটে রক্তাক্ত করাও হয়। দেওয়া হয় অসহ্য যন্ত্রণা। কোনভাবেই এখান থেকেও পালিয়ে যায় দু’জন। অচেনা পাহাড়ি পথে পালিয়ে আশ্রয় খুজে থাকে৷ তড়িঘড়ি করে দৌড়ে একটি পাহাড়ে দেখতে পায় সেনাবাহিনী। তারা সেনাবাহিনী দেখেই তাদের উপর দুই ধাপে হওয়া নির্যাতনের ঘটনার বর্ণনা দিলেন। কিন্তু তারা যাদেরকে সেনাবাহিনী ভেবে নিশ্চিন্তে নির্যাতনের ঘটনা বললেন তারা কেউ সেনাবাহিনী নয়, তারা সবাই সেনাবাহিনীর পোষাকে শান্তিবাহিনী!
যখন তারা দেখলো চেহারাই সবাই উপজাতি, কিন্তু পোষাক শুধু সেনাবাহিনীর তখন তাদের আর বুঝতে বাকি রইলো না যে, তারা ভূল জায়গাতে এসে ধরা পড়েছে৷ এরপর তাদের দু’জনকে নারকেল গাছের সাথে বেধে মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্মম নির্যাতন করতে লাগলো সন্ত্রাসীরা। তাদের আর্তচিৎকারে নিস্তব্ধ পাহাড়ের কুকুর ও পাখপাখালি জেগে উঠলো ঠিক। কিন্তু কেউ এগিয়ে আসলো না তাদের রক্ষা করতে। এভাবেই তাদের উপর চলতে থাকলে অমানুষিক নির্যাতন। তাদের গাছের সাথে বেধে চলে গেলো শান্তিবাহিনীর সদস্যরা দুপুরের আহার করতে৷ এই সুযোগে হাসেম জহিরকে বলে দুই কোনরকম আমাকে বেধে রাখার রশি গুলো দাঁত দিয়ে কেটে দে। আমি মুক্ত হতে পারলে তুর বাধ খুলে তোকে মুক্ত করব। এ কথা শুনে জহির রক্তাক্ত অবস্থায় অনেক কষ্ট করে দাঁত দিয়ে রশি কেটে হাসেম-কে মুক্ত করে সক্ষম হল। কিন্তু বেইমান মীরজাফর হাসেম ১৫ বছরের জহিরকে আর নারকেল গাছের বাধ থেকে মুক্ত করলেন না। নিজেই দ্রুত পালিয়ে গেল। এই যাত্রায় হাসেম বেঁচে গেলেও আর বাঁচতে পারেনি হতভাগা জহির৷
ঘটনার দুইদিন পর হাসেম কাশখালী গ্রামে ফিরে এল। ফিরে এসে বাঙালিদের ও কাশখালী সেনাক্যাম্পকে ঘটনার বিস্তারিত জানাল৷ কিন্তু সেনাবাহিনী রিস্ক নিয়ে নাভাঙ্গা জহির-কে উদ্ধারে যেতে আগ্রহী হয়নি৷ তার মূল কারণ, তৎকালীন সেনাবাহিনীরা বাঙালি ও হিল ভিডিপির সহযোগিতা ছাড়া ক্যাম্প থেকে শান্তিবাহিনী কবলিত এলাকায় যেতেন না। এতটা ভয় পেতো শান্তিবাহিনীকে।
পরবর্তীতে কাউখালীর কাশখালী, রাঙীপাড়া, পোয়াপাড়া ও বেতছড়ি সহ কয়েকটি গ্রামের বাঙালিরা সংঘটিত হয়ে রওনা হয় জহির-কে উদ্ধার করার সন্ধানে। হাসেমের দেখানো পথে গিয়ে মিললো জহিরের বিভৎস দেহখানা৷
নারকেল গাছের সাথে বাধা অবস্থায় আছে মৃত্য দেহ।
শরীরের থেকে মাথা কেটে ফেলা হয়েছে, আংশিক লেগে আছে মাথা শরীরের সাথে। আর পরনে লুঙ্গিটাও নেই৷ পুরুষাঙ্গ কেটে ফেলা হয়েছে৷ সারা শরীর কেটে ক্ষতবিক্ষত করা হয়েছে। শরীরে যেনো আর বিন্দুমাত্র রক্ত নেয়। দা দিয়ে কুপানোর দাগ গুলো রক্ত শূন্যতার কারণে স্পষ্টভাবে ‘সাদা’ দেখা যাচ্ছে। কি নিষ্ঠুরতা! কতটা নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে জহির-কে। সেটা দেখে উপস্থিত বাঙালিদের মধ্যে অনেকেই তৎক্ষণাৎ জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল৷
উপজাতি সন্ত্রাসীরা কী মানুষ নাকী জংলী জানোয়ার? এভাবে একজন নিরপরাধ বাঙালি কিশোরকে হত্যা করা মানুষের কাজ হতে পারে না। এমন নৃশংস ও নির্মম হত্যারকাণ্ড দেখে প্রতিবাদে ফেটে পড়েন তৎকালীন জহিরের লাশ বহন করা বাঙালিরা।
বুধবার লাকড়ি সংগ্রহ করতে যাওয়া নাজিম উদ্দিনের পিতা ও জালাল উদ্দিনের পিতার লাশ অবশ্য বৃহস্পতিবার সকালেই পাওয়া গেছে বাঁশের চালির উপর। বৃহস্পতিবার ছিল সাপ্তাহিক বাজারের দিন। চাকমারা বাজারে বাঁশ বিক্রি করার জন্য খালে একদিন আগে বাঁশ রেখে যেত। সে বাঁশের চালির উপর দু’টি লাশ ফেলে রাখে শান্তিবাহিনীর সন্ত্রাসীরা। পরে গোপনে খবর এলো বাঁশের চালির উপর খালে দু’টি লাশ আছে। বাঙালি ও সেনাবাহিনী গিয়ে লাশ দু’টি উদ্ধার করল। জালাল উদ্দিনের পিতার লাশটি বেশি কুপানো হয়েছিল। সারা শরীরে কুপানোর দাগ ছিল৷ যেটা দেখে উপস্থিত সবাই মর্মাহত হয়েছিল।
১৯৯৬ সালে কাউখালীর এই ৩ (তিন) জন বাঙালি হত্যার ঘটনা থেকে দায়মুক্তি পায় শান্তিবাহিনীর সন্ত্রাসীরা অসাংবিধানিক পার্বত্য চুক্তির মাধ্যমেই। এ বাঙালি হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়নি, নিহতদের পরিবারকেও দেওয়া হয়নি সাহায্য সহযোগিতা। এর আগে ১৯৮০ সালে ২৫ মার্চ কলমপতি গণহত্যায় ২৫০ জনের অধিক বাঙালিকে হত্যা করে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন শান্তিবাহিনীর সন্ত্রাসীরা।