জিহান মোবারক পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সরেজমিনে।
পার্বত্যাঞ্চলের বনাঞ্চল ধ্বংস করে অসাধু কাঠ পাচারকারীরা পার্বত্য চট্টগ্রামকে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে এর ফলে পাহাড়ি অঞ্চলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ অন্যান্য বছরের তুলনায় বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর এই কাজের অন্যতম সহযোগী হচ্ছে বন বিভাগের অসাধু কর্মকর্তা, কর্মচারী ও প্রশাসনের কতিপয় কর্মকর্তারা।
সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রাম ঘুরে দেখা যায়, সন্ধ্যা নামলে অবৈধ কাঠ পাচারকারীদের একাধিক গ্রুপকে সক্রিয় হতে। তথাকথিত কাঠ ব্যবসায়ী সমিতি বেআইনিভাবে অবৈধ কাঠের পারমিশন দিয়ে থাকে। অথচ তারা এই কাজের কোন বৈধ কর্তৃপক্ষ নয়।
অবৈধ কাঠ পাচারে সহযোগী ও চাঁদার ভাগবাটোয়ারা ভোগকারী করা তা জেনে নিন-
পার্বত্য ষড়যন্ত্রকারী গোষ্ঠী ইউপিডিএফ-জেএসএস, চাকমা সার্কেল ও স্থানীয় বনবিভাগ, নির্বাহী প্রশাসন, পুলিশ, কতিপয় গোয়েন্দা সংস্থার মাঠ পর্যায়ে প্রতিনিধি, আনসার বিডিপি, আওয়ামীলীগ, প্রেস ক্লাব সহ সর্বমোট ২১টি দপ্তরকে অবৈধ কাঠের গাড়ি প্রতি চাঁদা দিয়ে প্রতিটি অবৈধ কাঠের গাড়ি যেতে দেওয়া হয়। কাঠের গাড়ি সড়ক দিয়ে যাওয়ার সময় রাস্তায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে কাঠ সমিতির সভাপতি/সাধারণ সম্পাদক ও সদস্যরা চাঁদা আদায় করেন। প্রতি গাড়ি প্রতি ১২০০ থেকে ২০০০ এবং ২১,০০০ হাজার হতে ২৬,০০০ হাজার টাকা পর্যন্ত আদায় করা হয়। এই চাঁদার টাকা ভাগবাটোয়ারা করে নেন বর্ণিত দপ্তরের ব্যক্তিরা।
অনেকেই বলবে, পাহাড়ে কাঠ ছাড়া মানুষ চলার আছে টা কী? এখানে বাঙ্গালীরা কাঠ ব্যবসা করে কোনোভাবে চলে! যারা এই কথা বলেন, তাদেরকে বলবো যদি বাঙ্গালীদের জীবিকানির্বাহ করার জন্য অবৈধ কাঠ পাচার করা প্রয়োজন হয়; তাহলে প্রতিটি অবৈধ কাঠ পাচার করার গাড়ি যাওয়ার সময় কেনো ইউপিডিএফ-জেএসএস, চাকমা সার্কেল ও স্থানীয় বন বিভাগ, নির্বাহী প্রশাসন, পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থা, আনসার বিডিপি, মুক্তিযোদ্ধা, আওয়ামীলীগ, প্রেস ক্লাব চাঁদার ভাগ নেয়??? তারা কেন কাঠকে বৈধ করে দেয় না? তাদের তো উচিত ছিলো…
গরীব বাঙ্গালী ব্যবসায়ীদের প্রতিটি গাড়ি হতে চাঁদা আদায় না করে মানবতার খাতিরে গাড়ি এমনিতেই যেতে দেওয়া। কিন্তু তারা সেটা না করে কেন অবৈধ কাঠ থেকে চাঁদা নেয়? সুতরাং এই থেকে প্রতিয়মান হয় যে, বাঙ্গালীরা কাঠ ব্যবসা না করলে খাবে কী? এই কথাগুলো একটা ধোঁকাবাজি মাত্র। বস্তুত এখানে বাঙ্গালীদের জীবিকানির্বাহের জন্য কাঠ অন্যতম নয়। এখানে অবৈধ কাঠের ‘চাঁদা’ বর্ণিত ব্যক্তিদের জীবিকানির্বাহের জন্য কাঠ অন্যতম।
কিছু সংখ্যক অসাধু কাঠ পাচারকারীর জন্য সমগ্র পার্বত্যাঞ্চলের বনাঞ্চল এইভাবে উজাড় করে পার্বত্য জনজীবন ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য হুমকির মুখে ফেলা পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি।
আরেকটি তথ্য-
কাঠ ব্যবসা পাহাড়ের মানুষ হাতগোনা কযেকজন করে। বেশিরভাগই কাঠ ব্যবসা করে চট্টগ্রাম জেলার মানুষ। যারা পাহাড়ের মানুষকে অমানুষ মনে করে! চট্টগ্রাম রাঙ্গুনিয়া, রাউজান, হাটহাজারী, চন্দনাইশ ও সাতকানিয়া মানুষ এই অবৈধ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত৷ তাদের লাভের জন্য কেনো পাহাড় ধ্বংস হবে পাহাড়ের মাটি ও মানুষ ধ্বংস হবে???
একসময় পাহাড়ে গিয়ে দাঁড়ালে দেখা যেত, নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি, চারদিকে পাহাড়ে গাছপালা, পাখিদের কিচিমিচি শব্দ, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এবং বিভিন্ন পাহাড়ি গাছের সমাধি; যা আজ বিপন্ন ও পাহাড়গুলো নেড়া; সবুজের চিরচেনা এই পাহাড় আজ অবৈধ কাঠ পাচারকারীদের কারণে একখানা মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে।
বন বিভাগের অসাধু বন কর্মকর্তারা ভুলভাল তথ্য দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামের কাঠ কাটা বন্ধ রেখেছে। তারা মনে করে যদি বৈধভাবে পাহাড়ে কাঠ কাটা হয় তাহলে তারা কোনভাবেই চাঁদা নিতে পারবে না আর কাঠের গাড়ি প্রতি অবৈধভাবে টাকা নেওয়াও সম্ভব হবে না। তাই বনাঞ্চল ধ্বংসের অজুহাত দিয়ে সংরক্ষিত পারমিটের নাম করে বছরের পর বছর কাঠ কাটা বন্ধ রেখে অবৈধভাবে কাঠ কাটার পথ ও পাচার বেছে নিয়েছে। বন বিভাগের এই কূটকৌশলের কারণে একজন দিনমজুর মানুষ তার বাগান হতে গৃহের প্রয়োজনে এবং নিজের অর্থের প্রয়োজনে পাকাপোক্ত হওয়া গাছগাছালি কাটতে পারেন না। কঠিন শর্ত দিয়ে বন বিভাগের কাঠের পারমিটের ব্যবস্থা রেখেছে, যার মাধ্যমে একজন দিনমজুর কাঠের পারমিট পাবেন না। এই পারমিট পায় শুধু অসাধু কাঠ সিন্ডিকেট। এই পারমিটেও হয় পাক্কা ২নাম্বারি। এক বাগানের নামে পারমিট হলেও বিভিন্ন বাগান থেকে কাট কেটে পারমিটে ঢোকানো হয়। পারমিট জালিয়াতি ও কম হয়না পাহাড়ে। এ চক্রে জড়িত রয়েছে বনবিভাগ।
অবৈধ কাঠ পাচার রোধে বন বিভাগ, পুলিশ, নির্বাহী প্রশাসন, গোয়েন্দা সংস্থা ও দায়িত্বশীলরা কোনভাবেই সক্রিয় নয়৷ তারা তথাকথিত কাঠ সমিতির মাধ্যমে মোটা অংকের চাঁদা পেয়ে গোপনে -প্রকাশ্যে এই ব্যবসা চলমান রাখার বেআইনি বৈধতা দিয়েছে। দিনে রাতেই তো প্রশাসনের নাগাল দিয়ে কাঠের গাড়ি যায়। বেশ করে সন্ধ্যা নামলে অবৈধ কাঠের গাড়ির আওয়াজে উক্ত জনপদের মানুষের ঘুম হারাম হয়। অবৈধ কাঠের গাড়ি অতিরঞ্জিত লোড দেওয়ার কারণে সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ব্রীজ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং বিদ্যুৎ লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয় ও মানুষের বসতবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
মৌসুমে অবৈধ ইট ভাটার জ্বালানির জন্য ছোটছোট সেগুনবাগিচা ধ্বংস করা হয়। দুঃখজনক এসব দেখেও প্রশাসন খিটখিটে হাসে আর সাপ্তাহিক ও মাসিক কাঠ ব্যবসায়ী সমিতি থেকে চাঁদা নিয়ে বিলাসবহুল জীবনযাপন করছে। কাঠ ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি/ সাধারণ সম্পাদকরা পাহাড়ের কোটি পতি। তাদের রয়েছে হাজার কোটি টাকা মূল্যে সম্পত্তি। তারা অবৈধভকবে কাঠ পাচার করার জন্য ইউপিডিএফ-জেএসএস সন্ত্রাসীদের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক গড়ে তুলে৷ রাস্ট্রীয় অনেক গোপন তথ্য সন্ত্রাসীদের সরবরাহ করে। কাঠ ব্যবসায়ী সমিতির সঙ্গে কতিপয় গোয়েন্দা সংস্থার মাঠ প্রতিনিধিদের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক। এই সম্পর্কের মাধ্যমে গোয়েন্দাদের থেকে বিভিন্ন তথ্য আদায় করে তথাকথিত কাঠ ব্যসায়ী সমিতির সভাপতি/ সাধারণ সম্পাদক। আর এইসব তথ্য ইউপিডিএফ-জেএসএসকে দিয়ে কাঠ পাচার চলমান রাখে তারা।
পার্বত্য চট্টগ্রামের কাঠ পাচারের কয়েকটি স্পষ্ট-
১. বান্দরবান লামা হতে কক্সবাজার সড়ক ।
২.বান্দরবান সদর ও রাজস্থলী হতে কাপ্তাই রাঙ্গুনিয়া মূল সড়ক।
৩. বান্দরবান বাইশাড়ি হয়ে চন্দনাইশ চট্টগ্রাম সড়ক।
৪. কাউখালী হতে রাঙ্গুনিয়া রানিরহাট সড়ক।
৫. কতুকছড়ি ও রাঙ্গামাটি সদর হয়ে রাঙ্গুনিয়া সড়ক হয়ে চট্টগ্রাম।
৬. রামগড় ফেনী সড়ক।
৭. মানিকছড়ি হতে হাটহাজারী চট্টগ্রাম সড়ক।
এই ৭টি স্পোর্ট দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের ৯০% অবৈধ কাঠ সমতলে পাচার হয়। অবৈধ কাঠ থেকে আদায় করা চাঁদার টাকা বিকাশের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়কে নিয়োজিত থাকা পুলিশ কর্মকর্তা, বন বিভাগ ও অক্টরির চেকপোস্টে পৌঁছে যায় কাঠ ব্যবসায়ী সমিতির মাধ্যমে।
পরিসংখ্যানে দেখা গেছে বন বিভাগে যারা পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকরি করে তারা এ অঞ্চল থেকে কয়েকশো হাজার কোটি টাকা নিয়ে গেছে। এর মাধ্যমে তারা পাহাড়কে মরুভূমি করেছে এবং পাহাড়ের মানুষকে মেরুদণ্ডহীন করেছে।
এদিকে পার্বত্য ষড়যন্ত্রকারীগোষ্ঠী ইউপিডিএফ-জেএসএস অবৈধ কাঠ থেকে চাঁদাবাজি করা এই অর্থ দিয়ে কেনে অবৈধ অস্ত্র। এই অবৈধ অস্ত্র জনগণ ও রাস্ট্র তার বাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যবহার করে। পার্বত্য চট্টগ্রামে সন্ত্রাসবাদে জড়িত থাকা সংগঠন গুলোর চাঁদাবাজির ৮০% আসে অবৈধ কাঠ পাচার থেকে। এই চাঁদাবাজির টাকায় মূলত সংগঠন অত্যাধুনিক অস্ত্র শস্ত্র কিনতে সক্ষম হয়।
পাহাড়ে চাঁদাবাজির মহোৎসবে কাঠ অন্যতম হওয়ার মূল কারণ হচ্ছে, যে বাগান সৃজন করে তাকে ইউপিডিএফ-জেএসএস কে চাঁদা দিতে হয়; যে বাগান বিক্রি করে তাকে চাঁদা দিতে হয়;যে বাগান ক্রয় করে তাকে চাঁদা দিতে হয়; যে কাঠ ব্যবসা করে তাকে চাঁদা দিতে হয়; যে গাড়ি কাঠ বহন করে তাকেও চাঁদা দিতে হয়; যে কাঠের গাড়ি পাচার করে তাকেও চাঁদা দিতে হয়।
এই থেকে পরিষ্কার যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে অবৈধ কাঠ থেকে কি পরিমাণ চাঁদা আদায় করে সন্ত্রাসী সহ সংশ্লিষ্টরা।
পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, বনাঞ্চল ও পরিবেশ রক্ষা করতে হলে অবৈধ কাঠ পাচার রোধ করতে হবে এইজন্য সংশ্লিষ্ট মহলকে দায়িত্বশীল হতে হবে। আইনের আওতায় আনতে হবে কাঠ ব্যবসায়ী সমিতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের বেশ করে যারাই অবৈধ কাঠের গাড়ি হতে রাস্তায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে চাঁদা আদায় করে।