শান্তিরক্ষা মিশনে সেনা নিয়োগ বন্ধ রাখতে ৬ জুম্ম সংগঠনের আহ্বান-উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

0

মোঃ সোহেল রিগ্যান– পার্বত্য চট্টগ্রামের অখণ্ডতা রক্ষার স্বার্থে এবং এ অঞ্চলের মানুষের জননিরাপত্তা ও জীবনমান উন্নয়নে সেনাবাহিনীর আত্মত্যাগ অনস্বীকার্য। ১৯৭২/৭৩ সালে গঠিত বিচ্ছিন্নতাবাদী ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সংহতি সমিতি’ (জেএসএস) যখন পার্বত্য চট্টগ্রামে দেশভাগের বিদ্রোহ করে তখন কিন্তু সেনাবাহিনী নীরব ছিল এবং পাহাড়ে যায়নি। ১৯৭৫ সালে যখন বিচ্ছিন্নতাবাদী জেএসএস প্রকাশ শান্তিবাহিনীর সন্ত্রাসীরা বনবিভাগ ও রাষ্ট্রীয় স্থাপনায় হামলা শুরু করে তখন কিন্তু সরকার বাধ্য হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনা মোতায়েন করে। ১৯৭৭ সালে বান্দরবান সাঙ্গু নদীতে শান্তিবাহিনীর সন্ত্রাসীরা অতর্কিতভাবে গুলি করে ৫ সেনাসদস্যকে হত্যা করে। এরপরও সেনাবাহিনী নীরব ছিল৷ কারণ বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সহনশীল এবং ধৈর্যশীল ও মানবিক। যার দৃষ্টান্ত বলা যায়, পাহাড়ে উপজাতি প্রসূতি মায়েদের চিকিৎসা প্রদান, কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ এবং অর্থ সহায়তা প্রদান। সেনাবাহিনীর এই নীরবতার সুযোগে শান্তিবাহিনীর সন্ত্রাসীরা বেপরোয়া হয়ে উঠে৷ একের পর এক হামলা করে রাষ্ট্রের সঙ্গে ধৃষ্টতা প্রদর্শন শুরু করে। এরপর সরকার ১৯৭৯ সালে রাষ্ট্রের অখণ্ডতার স্বার্থে সমতল জেলাগুলো হতে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রায় ৩০ হাজার বাঙ্গালী পরিবার সরকারী ভূমিতে পূর্ণবাসন করে। পূর্নবাসিত নিরস্ত্র বাঙ্গালীদের উপর সন্ত্রাসী শান্তিবাহিনী হায়েনারা ঝাঁপিয়ে পড়ে। শুরু করে গণহত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ, অগ্নিসংযোগ ও অমানবিক নির্যাতন। তখন সরকারের নির্দেশেই সেনাবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান শুরু করে। বৈদেশিক ষড়যন্ত্রকারীদের মদদপুষ্ট এদেশীয় সুশীল, বুদ্ধিজীবি ও তথাকথিত গণমাধ্যমগুলো সেনাবাহিনী তথা সরকারের এ অভিযানকে উপজাতি নিধন হিসেবে রূপ দেন। কিন্তু এই উপজাতি সন্ত্রাসীগুলো যে, বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসীগোষ্ঠী তা তারা উন্মোচন করেনি! তারা সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে চরম মিথ্যাচার আরোপ করে। সরকার বারবার চেয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা রাজনৈতিকভাবে সমাধান করার কিন্তু সন্ত্রাসীরা প্রত্যেকবার সরকারের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। এ দীর্ঘ সংঘাতে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঙ্গালী ও পাহাড়িসহ হাজার হাজার মানুষ হতাহতের ঘটনা ঘটে৷ হতাহতের মধ্যে বাঙ্গালীর সংখ্যাই বেশি। প্রায় ৩৫ হাজার বাঙ্গালীকে ২১টি গণহত্যার মাধ্যমে হত্যা করে এম.এন লারমা ও খুনী সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সংহতি সমিতি (জেএসএস)। তবুও সরকার মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকেই পার্বত্য সমস্যা রাজনৈতিক সমাধানের লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালের ২-রা ডিসেম্বর উপজাতি জনগোষ্ঠীর সবধরনের দাবিদাওয়া মেনে নিয়েই সন্তু লারমার সঙ্গে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সম্পাদিত করে। এই চুক্তির ৭২’টি ধারা- উপধারার মধ্যে প্রায় সবকয়’টিতে উপজাতিদের অধিকার এর কথা বলা হয়েছে। সরকারের পক্ষ হতে ১টি মাত্র মৌলিক শর্ত ছিল যে, পার্বত্য চুক্তির মাধ্যমে জেএসএস-কে সম্পূর্ণ অবৈধ অস্ত্র আত্মসমর্পণ করেই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে হবে৷ কিন্তু জেএসএস তা করেনি। তারা মরিচা ধরা, ভাঙ্গাচুরা কিছু অস্ত্র জমা দিয়ে পার্বত্য চুক্তির মৌলিক শর্ত লঙ্ঘন করে এখনো পূর্ববর্তী সময়ের মতো অবৈধ অস্ত্র নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিচ্ছিন্ন করার মানসেই লিপ্ত রয়েছে। যা পার্বত্য চুক্তি লঙ্ঘন করার শামিল। জেএসএস পার্বত্য চুক্তির সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে দেশ-বিদেশে সেনাবাহিনী তথা সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে লিপ্ত রয়েছে। এবং চাঁদাবাজির টাকা ভাগাভাগি ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে একাধিক গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি বাঙ্গালী উভয় সম্প্রদায়ের মানুষদের জনজীবন অতিষ্ঠ করে তুলছে। জেএসএস এর একটি অংশ ইউপিডিএফ ‘৯৭-এর চুক্তির বিরোধিতা করে স্বায়ত্তশাসন দাবি করে পার্বত্য চট্টগ্রামে চাঁদাবাজি, অপহরণ ও খুন-গুম করে অরাজকতা সৃষ্টি করে আসছে। তারাই পাশাপাশি এ দু’টি বিচ্ছিন্নতাবাদী শীর্ষ সন্ত্রাসী সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রামকে বাংলাদেশ মূল ভূখণ্ড হতে বিচ্ছিন্ন করে আলাদা স্বপ্নের জুম্মল্যান্ড নামক রাষ্ট্র গঠন করার পরিকল্পনায় লিপ্ত রয়েছে। দেশদ্রোহীমূলক কার্যকলাপে লিপ্ত হয়ে পার্বত্যাঞ্চল থেকে সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে কুৎসা, গুজব ও প্রাপাগান্ডা রটানোর প্রচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছে। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী নিয়োগ বন্ধ করতে গভীর ষড়যন্ত্রে উপনীত হয়েছে৷ তারই ধারাবাহিকতায় গত ১০ আগস্ট বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে কথিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনীর নিয়োগ বন্ধ করার জন্য তথাকথিত ছয়টি জুম্ম অধিকার সংগঠন জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী কার্যক্রম বিষয়ক দপ্তর (ডিপিকেও) এর কাছে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে আহ্বান করেছে।

জুম্ম প্রবাসী সংগঠনগুলি নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সচিবালয়ের শান্তিরক্ষা মিশন বিভাগের শান্তিরক্ষা অপারেশনের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল মি: জিন পিয়েরে ল্যাক্রোইক্স সহ জাতিসংঘের নিকট যোগাযোগ করেছে। আহ্বানটির অনুলিপি প্রদান করা হয়েছে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার মিসেল ব্যাচেলেট, আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক স্পেশাল র‌্যাপোটিয়র মিঃ ফ্রান্সিসকো ক্যালি জে এবং জেনেভায় জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনার কার্যালয়ের বাংলাদেশ ফোকাল পার্সন এর কাছে।

আহ্বান জানিয়ে স্মারকলিপি দাখিলকারী সংগঠনগুলো হল কানাডার পার্বত্য চট্টগ্রাম আদিবাসী পরিষদ, নিউইয়র্কে অবস্থিত আমেরিকান জুম্ম নেটওয়ার্ক, প্যারিসে অবস্থিত ইউরোপীয় জুম্ম আদিবাসী কাউন্সিল, দক্ষিণ কোরিয়ায় অবস্থিত জুম্ম পিপলস নেটওয়ার্ক কোরিয়া, ভারতের আগরতলায় অবস্থিত চাকমা ন্যাশনাল কাউন্সিল এবং এবং জাপান ভিত্তিক জুম্ম পিপলস নেটওয়ার্ক।

জুম্ম সংগঠনগুলো আবেদনে উল্লেখ করেছে, “বাংলাদেশ সরকার ও তার সংস্থা, বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী সব সময় জুম্ম জনগণের ওপর মানবাধিকার লঙ্ঘন করে থাকে। যদিও ২ ডিসেম্বর ১৯৯৭, বাংলাদেশ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের জন্য সীমিত আত্মনিয়ন্ত্রণের নিশ্চয়তা দিতে আদিবাসী জুম্ম জনগণের সাথে একটি শান্তি চুক্তি করেছিল, কিন্তু সরকার তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি। বরং চুক্তির আগের মতোই সামরিকভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। এখন এটা খুবই স্পষ্ট যে, বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীই হচ্ছে আদিবাসী জুম্ম জনগণের (১৩ জনগোষ্ঠী ঐক্যবদ্ধভাবে জুম্ম হিসেবে) দমন ও নিপীড়নের প্রধান অনুঘটক।

প্রয়োজনীয় দলিল সংযুক্ত করে প্রমাণ হিসেবে আদিবাসী শব্দ ব্যবহারে বিধিনিষেধ আরোপ করে প্রতিরক্ষা গোয়েন্দার মহাপরিচালকের সদর দপ্তরের নির্দেশনা এবং মিলন চাকমাকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড সহ সাম্প্রতিক কিছু ঘটনাবলী তুলে ধরে উল্লেখ করেছে যে, জুম্ম জনগণের উপর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে সামরিক বাহিনীই প্রধান লঙ্ঘনকারী। বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী বর্ণবাদ, বৈষম্য এবং ধর্মীয় পরিহানি সংক্রান্ত এই সমস্ত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাবলী সংঘটিত করে চলেছে।”

তথাকথিত জুম্ম সংগঠনগুলো পার্বত্য চট্টগ্রামের বিচ্ছিন্নতাবাদী জেএসএস ও ইউপিডিএফ এর মদদপুষ্ট সহযোগী অঙ্গসংগঠন। যারা বৈদেশে বাংলাদেশ বিরোধী প্রচারণায় লিপ্ত৷ তাদেরকে আগস্টিনা চাকমার উত্তরসূরী বলা যায়। তারা পার্বত্য চট্টগ্রামের বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে কূটনীতিক যোগাযোগ এবং লবিং হিসেবে বৈদেশে অবস্থান করছে বলে তাদের বিগত ও বর্তমান দেশবিরোধী কার্যকলাপে প্রতিয়মান হয়।

বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী সংগঠন মদদপুষ্ট ছয় জুম্ম সংগঠন কর্তৃক আনীত অভিযোগগুলো সম্পূর্ণ মিথ্যা, বানোয়াট ও ভিত্তিহীন এবং উদ্দেশ্যেপ্রণোদিত। এমন মনে হওয়ার অন্যতম কারণ, বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো পার্বত্য চট্টগ্রামকে বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে এ অঞ্চলে অবৈধভাবে ভারী অস্ত্র মজুদ করেছে এবং চাঁদাবাজি, অপহরণ, খুন-গুম করে অত্র অঞ্চলকে অশান্ত করে জনজীবনে দুর্ভোগ সৃষ্টি করেছে৷ স্থানীয় অধিবাসীদের নিরাপত্তায় সেনাবাহিনী বেসামরিক প্রশাসনকে সহযোগিতা করে আসছে এবং পার্বত্য চুক্তির শর্ত অনুরূপ চুক্তি বাস্তবায়নে শান্তি, সম্প্রীতি ও উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখছে।

উল্লেখ যে, পার্বত্য চুক্তির শর্ত মোতাবেক সরকার ‘৯৭ সালের পর থেকে ২৩৯ সেনা ক্যাম্প ব্যারাকে ফিরিয়ে আনেন। তারই কারণে পাহাড়ে নিরাপত্তা ঘাটতি বা সংকট তৈরি হয়েছে। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে উপজাতি বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো পার্বত্য চট্টগ্রামে অবৈধ ভারী অস্ত্রের অনুপ্রবেশ ঘটাচ্ছে এবং অবশিষ্ট সেনাসদস্যদের এ অঞ্চল থেকে প্রত্যাহার করে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করার জন্য সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে জাতিসংঘে মিথ্যা বানোয়াট অভিযোগ করেছে। সেনাবাহিনী যখন অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে অভিযান পরিচালনা করে তখন সেনাবাহিনীকে তারা বাধা মনে করে এবং সেনাবাহিনী এ অঞ্চলে থাকার কারণে তাদের স্বপ্নের জুম্মল্যান্ড বাস্তবায়ন বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে।

মানবিক ও নিষ্পাপ এই সেনাবাহিনীকে আজকে যে সন্ত্রাসীরা দোষারোপ করে তা চরম সীমালঙ্ঘনের বহিঃপ্রকাশ।

দেশবিরোধী কার্যকলাপে জড়িত থাকা বৈদেশে অবস্থানকারী উপজাতি সংগঠনগুলোর মূল হোতাদের বিরুদ্ধে যথাযথ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা সময়ের দাবি।

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More