পাহাড়িদের অপপ্রচার আমাদের নিরব ভূমিকা।

0
194

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হিল ভয়েস সহ বেশ কিছু ফ্ল্যাটফর্ম থেকে ধারাবাহিক ভাবে দেশের সেনাবাহিনী সহ বাঙালী ও ইসলাম বিদ্বেষ নিরবিচ্ছিন্ন ছড়ানো হচ্ছে অনেক দিন ধরে।
এদের যে কোন ইসূতে সেনাবাহিনীর চরিত্র হনন ও ইসলাম ফোবিয়া একই কমন বিষয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা একটি ভূ- রাজনৈতিক, অর্থ নৈতিক ও সামাজিক সমস্যা। এখানে কোন কালেই ইসলাম ধর্ম কোন বিষয় নয়। কিন্তু চলমান বিশ্বের ইসলাম ফোবিয়ার ট্রেন্ড কে পার্বত্য চট্টগ্রামে টেনে এনে নতুন এক মাত্রা যোগ করার চেষ্টা খুবই স্পষ্ট। কারনটা খুব দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনার অংশঃ বহির্বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ। সেনাবাহিনী কে সর্বদা ‘ধর্ষক’ বাঙালী কে ‘সেটেলার’ আখ্যা দিয়ে ক্রমাগত ট্রল করার উদ্দেশ্য সেনাবাহিনীর মনোবলকে দমিয়ে দেওয়া আর ‘ বাঙালীরা’ উৎপীড়ক,  চোর,ডাকাতা জমি দখলকারী হিসাবে সর্বসাধারণের মাঝে ধারণা কে ভিওি দেওয়া।
‘সেনা মদদ’ এমন একটি সস যা তারা সব বিরোধ এবং সংঘাতে টেনে এনে নিজেদের অন্তঃকলহ কে আড়াল করবে। জেএস এস এর আক্রমণে ইউপিডিএফ বা ইউপিডিএফ এর আক্রমণে জে এস এস ক্যাডার নিহত হলে তারা তাৎক্ষণিকভাবে এর মধ্যে ‘সেনা মদদ’ এর গন্ধ খুঁজে পায়। সাম্প্রতিক সময়ে কুকিদের সংগঠন ‘কেএনএফ’ এর আবির্ভাবের মধ্যেও সেনা মদদ খুঁজে পায়। জেএস এস এসব অপপ্রচারের জন্য বহুদিন আগে  কে এন এফ এর একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে আতিথ্য গ্রহনকারী স্হানীয় সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের ছবিকে অব্যাহতভাবে ব্যবহার করছে। ছবিতে কেএনএফ র বর্তমান নেতা নাথান বমকে সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের সাথে দেখা গেছে।  অথচ কে এন এফ নেতা নাথান বম জে এস এস র ছাত্র সংগঠন পিসিপি র নেতা। তিনি সন্তু লারমার পালক পুএ হিসাবে আদৃত ছিলেন। ঢাকার চারুকলা ইন্সটিটিউটের ছাএ নাথান বম সন্তু লারমার অর্থায়নে শিক্ষিত। সন্তুু লারমার অর্থায়নে খাগড়াছড়িতে প্রয়াত মানবেন্দ্র লারমার আবক্ষ মূর্তিটি নাথান বমের তৈরী। 
 সাম্প্রতিক সময়ে কেএনএফ এর উত্থানের পিছনের কারন ঐতিহাসিক এবং চলমান শান্তি চুক্তির সুফল থেকে বন্চিত হওয়ার কারনে। হাই ল্যান্ডার নামে খ্যাত অতি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ( ম্রো,লুসাই,পাংখো,বনযোগী, বম,মুরং,খুমি,খিয়াং সহ অন্যান্য) যারা অতি উঁচু পাহাড়ের জীবনে অভ্যস্ত তারা স্বাধীনচেতা ও অদম্য সাহসী। 
” ১৮৬০ সালে গ্রেট কুকি ইনভেশন বলে খ্যাত এক আক্রমণে ৪০০-৫০০ কুকি দল ১৫টি গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়, ১৮৫ জন বৃটিশ প্রজাকে হত্যা করে এবং শতাধিক প্রজাকে বন্দী করে নিয়ে যায়”-সূত্রঃ আনন্দ বিকাশ চাকমা,কার্পাস মহল থেকে শান্তি চুক্তি। 

স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ও লুসাইরা এবং শান্তি বাহিনীর সশস্ত্র সংগ্রামের সময়ও এরা চাকমাদের বিরুদ্ধে কাজ করেছে।  শান্তি চুক্তির ছিটেফোটাঁও সুবিধাও এরা পায়নি।  উপজাতি বা আদিবাসী বলে সম্পাদিত চুক্তির কোন সুবিধা এরা পায়নি। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী র মধ্যে অতিশয় ক্ষুদ্রাকৃতির এই অংশের বন্চনার বহিঃপ্রকাশ ‘কেএনএফ’। কেএনএফ র লক্ষ্য শুধু পার্বত্য চট্টগ্রাম কেন্দ্রীক নয়। আরাকান- মিজোরাম -ত্রিপুরা – মায়ানমারে বিস্তৃত সকল ইথনিক বা নৃগোষ্ঠির সম্বয়ে এক বৃহৎ কুকিল্যান্ড বা খৃষ্টান অধ্যুষিত অন্চল গড়ে তোলা যেন তারা অপরাপর বৃহৎ গোষ্ঠী থেকে আলাদাভাবে স্বশাসিত অন্চলে বসবাস করতে পারে। 


জে এস এস এর প্রপাগান্ডা সেল খুব সূক্ষ্মভাবে কেএনএফ কে সেনা মদদ প্রাপ্ত বলে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সন্তুর আঞ্চলিক পরিষদে বা তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় কতজন হাইল্যান্ডার চাকরি পেয়েছে বা তাদের অনুকূলে কত শতাংশ পাহাড়ি কোটা ছাড় দেওয়া হয়েছে তার কোন প্রকাশ নেই।  বাঙালীদের কে ‘ সেটেলার’ বলে গালি দেওয়ার মতো এদের সামাজিক পরিমন্ডলেও কুকিদের ‘ নেংটী পরা’ বলে নেতিবাচক শব্দে অভিহিত করা হয়।
বান্দরবানের ৯০% হাইল্যান্ডার খৃষ্টান ধর্মে দীক্ষিত হয়েছে।  ইভানজেলিস্ট খৃষ্টান পাদ্রীরা দীর্ঘদিন থেকে এখানে সক্রিয় আছে। তারা ধর্মান্তরন কার্যক্রমে সফল। পাহাড়িদের এই ধর্মান্তরিত হওয়াকে জেএসএস খুব বেশি উচ্চ -বাচ্য করে না। কিন্তু একটি মুসলিম পাড়ায় মসজিদের আজান শুনলে “জাত গেল জাত গেল ” বলে তার স্বরে চীৎকার শুরু করে দেয়।

পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনী কে ১৯৭১ সালের পাক বাহিনীর সাথে তুলনা করে একই তুলিতে চিত্রিত করা হয়। ” পাহাড়ে প্রতিদিন শত শত নারী নিরাপওা বাহিনীর ধর্ষণের শিকার হচ্ছে “- এ রকম একটা নেরেটিভ দেশে বিদেশে ছড়ানো হয়। জাতিসংঘের আদিবাসী ফোরামে যেয়ে রাজাকার ত্রিদিব রায়ের পুত্র দেবাশীষ রায় জাতিসংঘের শান্তি বাহিনীর কার্যক্রম থেকে সেনাবাহিনী কে বিরত রাখতে জোরালো বক্তব্য রাখেন। অথচ তাদের জ্ঞাতি-গোষ্ঠীর বিরাট একটি অংশ সেনাবাহিনীর উচ্চ পদে থেকে চাকুরী করে যাচ্ছেন। তারা কিন্তু কখনো ধর্ষণের মতো কোন অভিযোগ কখনো করেননি। আজ সেনাবাহিনীতে পাহাড়ি সদস্যদের সিংহভাগ চাকমা সম্প্রদায় থেকে আগত। এদের নারী সদস্য সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য। অব্যাহত চরিত্র হননের মতো অপপ্রচার চালিয়ে দেশ ও বিদেশের মাটিতে সেনাবাহিনীর সম্মান কে ভূলুণ্ঠিত করা একটা সূদুর প্রসারী ষড়যন্ত্রের অংশ।
সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে নির্মিত রাস্তা ঘাট, ব্রীজ, স্কুল কলেজ চিকিৎসা কেন্দ্র ধর্মীয় উপাসনালয় সব কিছুতে জেএস এস সেনা শাসনের গন্ধ পায়। কিন্তু চাকুরির জন্য যখন লাইন ধরে দাড়ায়, যখন সেনা পরিচালিত স্কুলে ভর্তির জন্য চেষ্টা তদবীর করে যখন সেনাবাহিনীর কঠোর পরিশ্রমে দূর্গম পাহাডে নির্মিত রাস্তায় চলাচল করে তখন সেনা গন্ধ খারাপ লাগে না। 
বাংলাদেশের অধিকাংশ প্রচার মাধ্যমে নিয়োজিত কর্মীরা এক ধরনের এক পেশে মনোভাব নিয়ে খবর সংগ্রহ ও প্রচার করেন, যারা একইভাবে পক্ষ পাত দুষ্ট বা সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভংগী নিয়ে কাজ করেন। তাই যখনই কোন ঘটনা সংঘটিত হয় তার প্রাথমিক বয়ানটা পাহাড়ি দৃষ্টিভংগীকে আনুকুল্য দেয়। এ ক্ষেএে বহু বছর আগের কল্পনা চাকমার অপহরণ অধ্যায়ের কথা মনে করা যেতে পারে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে সশস্ত্র সংগ্রামের শুরু এবং এর ব্যাপ্তির সময়টা সামরিক শাসনের আড়ালে ঘটেছে বলে এই অন্চলটি একটি ” নিষিদ্ধ এলাকার ” চাদরে মোড়া ছিলো।  ফলশ্রুতিতে সরকারী কর্মকর্তাদের  বদৌলতে যে ছিটেফোঁটা খবর প্রকাশ পেত তা সাধারণ জনগনের চেতনাকে সঠিক ভাবে বিকশিত করেনি। আর একপেশে প্রচারের মাধ্যমে সশস্ত্র সংগঠন গুলো জন মানুষের মধ্যে পাহাড়ে সেনাবাহিনী জুলুম করছে এরকম একটা ধারনা স্হান করে নেয়।

পার্বত্য চট্টগ্রামে সশস্ত্র সংগ্রামের শুরুতে জে এস এস র ছাত্র সংগঠন গুলো দেশের বামপন্থীদের ছাত্র সংগঠন, বাম প্রভাবিত সংবাদ মাধ্যম, মানবাধিকার সংগঠন ও বুদ্ধিজীবিদের একাংশ কে তাদের সংগ্রামের প্রতি সহানুভূতিশীল করে নেয়। প্রকারন্তরে তাদের কেউ কেউ পাহাড়িদের মুখপাত্র হিসাবে দিনরাত কাজ করে আসছে। এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়,বর্তমান কালে যুদ্ধ বা সংঘাতে মিডিয়া দারুণ অনুঘটকের কাজ করে। ইউক্রেন -রাশিয়ার যুদ্ধে পশ্চিমা প্রচার মাধ্যমের একতরফা প্রচার পেয়ে জেলেনেস্কি খুব সাহসের সাথে রাশিয়ার মোকাবিলা করেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সংঘাতের সময় যেহেতু সেনাশাসন চলছিলো তাই  সে শাসনের বিরোধিতা করতে গিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র সংগ্রামের  বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর কার্যক্রম কম আনুকূল্য পেয়েছে। এখানে অবশ্য সেনাবাহিনীর দায় রয়েছে, কারন পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিবেশ পরিস্থিতির প্রকৃত চিএ পেতে সংবাদ মাধ্যমের প্রবেশাধিকারকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। তার উল্টো ফল সরকারের বা সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে গেছে। যেমন ১৯৮০ সালের কমলপতির হত্যাকান্ডে সেনাবাহিনী যতটুকু নিন্দিত হয়েছে ১৯৮৬ সালের ভূষণছড়িতে বাঙালী হত্যা বা ১৯৯৬ সালের জুন ৩০ জন বাঙালী কাঠুরিয়াকে ডেকে নিয়ে জবাই করার মাধ্যমে জেএসএস মোটেই নিন্দিত হয়নি। 

এসব ঘটনার বিবরন ব্যাপক প্রচার না পাওয়ায় সশস্ত্র সংঠন জেএসএস এর হাতে লেগে থাকা রক্ত আমরা দেখতে পাই না। এই রক্তমাখা হাত নিয়ে সন্তু লারমা বাঙালির গর্ব একুশের শহীদ  মিনারে দাড়িয়ে  প্রতি বছর আদিবাসীর দাবী তুলেন। আমরা জানতে পারি না এই সেই সন্তুু লারমা যিনি ১৯৭৩ সালে দীঘিনালায় গাছে গাছে পোস্টার ঝুলিয়ে শ্লোগান তুলেছিলেন, ” পাহাড়িরা অস্ত্র ধরো বাঙালীরা পাহাড় ছাড়ো “।
“বাঙালির রক্ত নিবা পাহাড়িরা স্বাধীন হবা”।

লেখক: মেজর নাসিম (অব:)
২৮.১১.২০২২
ঢাকা।

আগের পোস্টশান্তিচুক্তিতে পাহাড়িদের অর্জন। 
পরের পোস্টএপারে আদিবাসী ওপারে সেটেলার!

রিপ্লাই দিন

আপনার কমেন্ট লিখুন
আপনার নাম লিখুন