শিক্ষা-
ফেসবুকের পাতায় দেখলাম ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের সমাবর্তন দিবসে এক ঝাঁক সদ্য গ্রাজুয়েট ডিগ্রিধারী তরুণ-তরুণীদের হাস্যজ্বোল মুখ। সমাবর্তনের গ্রাউনে আবৃত আধুনিক শিক্ষার আলোতে উদ্ভাসিত সব মুখ। তাদের এই হাসিমাখা মুখ গুলো দেখে বহুকাল আগে ১৯৭৩ সালের ২৩ জুন তারিখে ঢাকায় গন পরিষদে দেওয়া পাহাড়ি নেতা মানবেন্দ্র নারায়ন লারমার বক্তৃতার একটি অংশের কথা মনে পরলো-
“মাননীয় স্পীকার, যে অন্চল থেকে আমি এসে,সে অন্চল বাংলাদেশের একটি পিছিয়ে পড়া অঞ্চল। আপনারা বিশ্বাস করতে পারবেন না যে, আমাদের ওখানে এখনও আদিম যুগের মানুষ রয়েছে।…..আপনারা বিশ্বাস করবেন না, এরা অর্ধ-উলঙ্গ অবস্থায় এখনও বাস করে।….মাননীয় স্পীকার সাহেব, ব্রিটিশ সময়ে এবং পাকিস্তানের আমলে আমাদেরকে চিড়িয়াখানার জীবের মতো করে রাখা হয়েছিল।”
আমার দৃঢ় বিশ্বাস আজ মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা( এম এন লারমা) বেঁচে থাকলে পাহাড়ি তরুন প্রজন্মের এই অগ্রগতি দেখে তৃপ্তি পেতেন।
একই দিনে দেখলাম একজন চাকমা পুলিশ অফিসার পদোন্নতি পেয়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হয়েছেন। প্রায় প্রতি দিনই কেউ না কেউ নানা ধরনের ছবি পোস্ট করে আমাদের সদা জানান দেন ‘জুম্মজাতি’র কোন কোন সন্তান শিক্ষা, সংস্কৃতি গবেষণা,ব্যবসা ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তাদের সাফল্যের কথা।
পাহাড়ি জন গোষ্ঠীর ইতিহাস যারা পর্যবেক্ষণ করেন তারা সকলেই স্বীকার করবেন মাত্র ৯২০২১৭ (৪৯.৯৪%) জন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর এই জনসংখ্যা বাংলাদেশের পাহাড়ি অন্চলে বসবাসকারী বাঙালীদের ৯২২৫৯৮ (৫২.৮২%) চেয়ে শিক্ষায় দারুণভাবে এগিয়ে আছে। যদিও কেউ কেউ পাহাড়িদের এই অগ্রগন্যতার (চাকমা-মারমা- ত্রিপুরা বাদে) মাঝে অতিক্ষুদ্র অপরাপরা জাতি স্বত্বার উপস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন। সব ক্ষেত্রেই ‘Winner Takes All’ এর মতো চাকমাদের উপস্থিতি খুবই প্রবল প্রায় একচেটিয়া। এতে তাদের ‘দোষ’ কতটুকুই বা। পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক ও সশস্ত্র সংগ্রামের পুরোধা হিসাবে তারা তো ‘Lion Share’ পাবেই। জল বিদ্যুৎ প্রকল্পের কারনে যে চল্লিশ হাজার পরিবার বাস্তুচ্যুত হয় তার সিংহভাগই চাকমা সম্প্রদায়ের। তবে ইদানীং এই ‘সিংহের ‘ সিংহভাগ পাওয়া নিয়ে ‘হাইল্যান্ডার নামে খ্যাত অতিশয় ক্ষুদ্র হেড হান্টার কুকিরা আপওি করে নতুন ‘কুকিল্যান্ড’ এর দাবী নিয়ে এসেছেন।
কুকিল্যান্ডের দাবীর বিতর্কে না যেয়ে জনমিতির পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট বলা যায় পার্বত্য চট্টগ্রামে স্বাক্ষরতার হার ৭৬.৫৩%। আর এই শিক্ষিত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মধ্যে অপেক্ষাকৃত সমতলে বসবাসকারী চাকমারা ( যারা খ্যাংথা বা নদীর সন্তান নামে পরিচিত, নদীর কাছাকাছি থাকে এবং নৌচালনায় দক্ষ) শিক্ষায়, রাজনৈতিক নেতৃত্ব,অর্থনৈতিক সাফল্য, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক বিকাশ ইত্যাদি ক্ষেএে ঈর্ষনীয় সাফল্যের অধিকারী। আর এর সবই অর্জিত হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকতলে। স্বাধীন বাংলাদেশে গত ৫০ বছরে পাহাড়ের যে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে তা তো এখন দিবালোকের মতো স্পষ্ট। শান্তি চুক্তির ( ডিসেম্বর ১৯৯৮) পরবর্তী সময়ে পাহাড়ের উন্নয়নের ধারা চমকপ্রদ। শুধু অবকাঠামো গতভাবেই নয় শিক্ষার বিস্তার পাহাড়িদের কে পার্বত্য চট্টগ্রামের বৃটিশদের অনুসৃত বহির্ভূত নীতির এক অন্ধকূপ থেকে (হিল ট্র্যাক্টস রেগুলেশন ১৯০০) জাতীয় জীবনের মূল ধারায় নিয়ে এসেছে। আজ বাংলাদেশের সরকারি চাকুরীতে পাহাড়িদের যে উপস্থিতি আমরা দেখি তা স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৩ সালে রাঙামাটিতে দেওয়া বঙ্গবন্ধুর প্রতিশ্রুতির ( পাহাড়িদের সর্বক্ষেত্রে সম অধিকার ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বজায় রাখার অংগীকার) প্রতিফলন। সচিবালয়ে, বিদেশের দূতাবাসে, সেনাবাহিনী, পুলিশের উর্ধতন পদে আপনি চাকমাদের ব্যাপক সংখ্যায় দেখতে পাবেন। তারা আছেন সচিব পদে, তারা আছেন রাষ্ট্রদূত পদে,তারা আছেন জেনারেল পদে,তারা আছে আইজি /এ আইজি সহ নানান স্তরে।
ভাবুন তো একবার ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত ২৩ বছরে আমাদের বাংলাদেশে কয়টা জেনারেল পদ, কয়টা সচিব পদ বাঙালীদের ছিলো? বাঙালীরা ছিলো মোট জনসংখ্যায় সংখ্যাগুরু অথচ ন্যায্য সুবিধা বঞ্চিত। পাহাড়ের মোট জনসংখ্যা (ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী) মোট জাতীয় সংখ্যার মাত্র ০.১০%। অথচ স্বাধীন বাংলাদেশের সুবাদে তারা আজ শিক্ষায় পুরো বাংলাদেশের অন্যান্য অন্চলের চেয়ে অধিক অগ্রসর।
পাহাড়ি কিছু কিছু নেতা এবং সংগঠন কথায় কথায় “যুগ যুগ” ধরে পাহাড়িদের দুঃখের কারন হিসাবে বাংলাদেশ সরকার ও বাঙালীদের দোষ ধরে হিংসাত্মক বক্তব্য রাখেন। অথচ বৃটিশদের সময়কাল থেকে তাদের সামন্তবাদী রাজাদের শাসনকালে তারা যেভাবে অধিকার বন্চিত হয়েছিলেন সে ইতিহাসটা তুলে ধরেন না। বাংলাদেশের ৫ দশকে পাহাড়িদের জীবনমান উন্নয়নে যে মনোযোগ ও আন্তরিকতা দেখানো হয়েছে তা বর্তমান সময়ে দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে থাকা পাহাড়িদের কর্মকাণ্ডের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। দেশের কোন একটা বিশ্ববিদ্যালয় পাওয়া যাবে না যেখানে আপনি একটি চাকমা ছেলে মেয়ে পাবেন না। (কোটায়) ভর্তির সহজ সুযোগে তারা নিজেদের শিক্ষিত করে তুলছেন। ১৮৬৩ সালে চন্দ্র ঘোনায় প্রথম বোর্ডিং স্কুল স্হাপনের মাধ্যমে সরকারি ভাবে আধুনিক শিক্ষাব্যবস্হা চালু করে বৃটিশ জেলা সুপারিন্টেন্ডেন্ট ক্যাপ্টেন লুইন। ১৮৬৯ সালে জেলা সদর রাঙামাটি তে স্থানান্তরিত হলে বোর্ডিং স্কুলটিও তার অনুগামী হয়। কিন্তু শিক্ষা বিস্তারে রাজ পরিবারের সামন্তবাদী মনমানসিকতা পাহাড়িদের পিছিয়ে রাখে। ব্রিটিশদের আগমনের পূর্বে পার্বত্য চট্টগ্রামে ভার্নাকুলার বা স্হানীয় ভাষায় কিয়াং বা বৌদ্ধ মঠ কেন্দ্রীক পড়ালেখার প্রচলন ছিলো। ইতিহাসবিদ উইলিয়াম হান্টার জেলার স্কুল ইন্সপেক্টরের বরাত দিয়ে ১৮৭৩-৭৪ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে ৪৭টি কিয়ং ছিল বলে উল্লেখ করেছেন।
বৃটিশরা ঔপনিবেশিক প্রশাসনযন্ত্র পরিচালনার জন্য আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষা ব্যবস্হা চালু করেন।১৮৬৩ সালে চন্দ্রঘোনা বোর্ডিং স্কুলের জন্য প্রথম দুই বছরের জন্য দেওয়া হয় মাত্র ১২৩ টাকা।কিন্তু প্রথম দিকে শিক্ষা কার্যক্রম আশানুরূপ হয়নি। পাহাড়িদের কৌম জীবনবোধ,দুর্গম যোগাযোগ ব্যবস্হা, বিক্ষিপ্ত বসতি, সামন্তবাদী সংশয় প্রভৃতি প্রতিবন্ধকতা ছিলো। সামন্তবাদী শাসনের টুলস দেওয়ান, হেডম্যান,কারবারি, রোয়াজারা সাধারন প্রজাদের শিক্ষার লেভেল ঠিক করে দিতেন। দেওয়ানদের অনুমতি না পেলে কেউ লোয়ার প্রাইমারী স্কুল থেকে উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারতো না। দেওয়ানদের সংশয়বাদী মনোভাবের কারনেই বড়াদমের একটি মাইনর ইংলিশ স্কুল করার সরকারি অনুমোদন হওয়া সত্বেও ত্রিলোচন দেওয়ান স্কুলটি করতে দেন নাই।
পাকিস্তান আমলে কাপ্তাই বাঁধের কারনে চাকমারা চাষযোগ্য জমি হারালে তাদের মধ্যে নতুন করে শিক্ষাবোধ তীব্র হয়। রাঙামাটি সরকারি কলেজ এতদ অন্চলে শিক্ষার আলোর বিকাশ ও রাজনৈতিক চিন্তা চেতনাকে গাঢ় করে। ১৯৭৩ সালে রাঙামাটি কলেজে স্নাতক কোর্স শুরু হয়।
কিন্তু খুবই অবাক করা কান্ড ঘটে শান্তি চুক্তির পর পুরাতন ধ্যান ধারনার ধ্বজাধারী দেওয়ানদের মতো বাম চিন্তায় আলোকিত বলে কথিত সন্তু লারমা রাঙামাটিতে প্রযুক্তি বিশ্ব বিদ্যালয় করা সরকারি সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের সময় গত ৫০ বছরে পার্বত্য চট্টগ্রামে শিক্ষার পিছনে ব্যয় অকল্পনীয়। আজ পার্বত্য চট্টগ্রামে কতগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে তা কিন্তু পরিসংখ্যান না দেখে চট করে বলা সম্ভব নয়। আজ শিক্ষার পিছনে ব্যয় সরকারের আন্তরিকতার বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু দেওয়ানদের মতো জেএসএস বিশ্ববিদ্যালয় না করার জন্য শক্ত আন্দোলনে নামলেন। পার্বত্য ভূমি বেদখল করার অজুহাত তুললেন। শুধু কি বিশ্ববিদ্যালয়ে কি শুধু বাঙালী ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করবে? পাহাড়ি ছেলেমেয়েরা কি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি বা শিক্ষক হবে না? পার্বত্য চুক্তির অনেক ধারা অবাস্তবায়িত থাকলেও শিক্ষায় অগ্রগতি কিন্তু থেমে নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন গ্রাজুয়েট হওয়া এসব তরুন পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রায় স্বাভাবিক অবস্থার দিকেই ইংগিত করে। এরা উচ্চতর জীবন ও চিন্তার অধিকারী বলেই মনে করতে চাই। এরা কেউ চেগুয়াভেরা হতে বলিভিয়ার জংগলে হিজরত করবে না বলেই বিশ্বাস করি। এখন সময় চেগুয়াভেরা হওয়ার নয়। সামনেই চুক্তির বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানে অনেকে “যুগ যুগ ধরে বাঙালির শোষণ শাসনের নিন্দা ” করে বক্তব্য রাখবে। তারা যেন পার্বত্য চট্টগ্রামে ৭৬% শিক্ষার হার কেমন করে হলো সেজন্য বাঙালীদের ত্যাগ ও সরকারের আন্তরিকতাকে মনে রাখে। পাহাড়ের সকল নৃগোষ্ঠী যেন চুক্তির সুফল পায় সে দিকে “লায়ন” শেয়ার হোল্ডার কে নজর দিতে হবে।
যোগাযোগ ব্যবস্হা।
“চলুন মেঘের রাজ্য সাজেক ঘুরে আসি”- পাহাড়ে আজ যারা সাজেক বেড়াতে যান তারা অনেকেই বছর দশেক আগে এর দুর্গমতা কতটা গভীর ছিলো তা বুঝতে পারবেন না। একটা সময় ছিলো যখন থানচিতে কোন কর্মকর্তার পোস্টিং হলে তিনি এটাকে তার গত জীবনের কর্মফল মনে করতেন। তারা এখন থানচিকে নেপাল বা ভুটানের বিকল্প ভাবতে পারেন। ১৯৯১ সালে আমার চাকুরীকালীন সময়ে লংগদু উপজেলার শেষ প্রান্ত ইয়ারংছড়ি বাঙালী বসতিতে যেতে শুধু রাঙামাটি থেকেই আধাবেলা লাগতো নৌপথে। আজ ঢাকা থেকে দিনে ইয়ারংছড়ি যেয়ে আবার ফেরত আসা যায়। আজ যুগ যুগ ধরে যে পথে পাহাড়িরা পিঠে বয়ে কৃষি পণ্য বাজারে নিতো তা আর পিঠে বইতে হয় না।
রাস্তা বা জলপথের বিকাশ শুধু যোগাযোগ ব্যবস্হাকেই সহজ করেনি বাংলাদেশের বিপুল জনগোষ্ঠীর সাধারণ মানুষের কাছে পার্বত্য চট্টগ্রামকে পরিচিত করেছে। যোগাযোগের দূর্গমতা নিশ্চিত ভাবেই পাহাড়ি ও প্রত্যন্ত অন্চলের বাঙালীদের কে কাছে এনেছে। ১৯৭৩ সালের বাঙালী কে জানতো পাহাড়ের কি সমস্যা? এখন তো মোটামুটি সবাই জানে ওখান কার রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতা। যোগাযোগ ব্যবস্হার উন্নতি শুধু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই নয় নিরাপত্তার উপর বেশ প্রভাব ফেলছে।দিন-রাত অবাধ চলাচল মানুষের মধ্যে আস্হার ভিওি তৈরি করবে।
উন্নত সড়ক বা নৌযোগাযোগ দূর্গম অন্চলে পাহাড়িদের বিক্ষিপ্ত পাড়াগুলো কে একটা স্হায়ী গ্রামে পরিনত করার সুযোগ এনে দিয়েছে। বিদ্যুতের আলোকে আলোকিত হয়েছে অনেক গ্রাম।
লেখক- মেজর নাসিম (অব:)
২৭.১১.২০২২
ঢাকা।