জেএসএস’র তত্ত্বাবধানে পরিচালিত বেশ কিছু অনলাইন সাইটে সেনাবাহিনীকে নিয়ে নানান ধরনের কল্পকাহিনী অবিরামভাবে প্রচার করে যাচ্ছে। সেনাবাহিনী নিয়ে তাদের এলার্জী এতোই তীব্র যে সরল পথে হেঁটে যাওয়া কোন সেনাসদস্য দেখলেই তাদের গাত্রদাহ শুরু হয়।
বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হওয়ার প্রথম থেকেই মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের কৌশল হিসাবে তারা সেনাবাহিনীর কার্যক্রমকে বিতর্কিত বা Defanc করার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর উপস্থিতিকে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর কর্মকাণ্ডের সঙ্গে মিলিয়ে দেখাত। শান্তিচুক্তির পরও জেএসএস তাদের রাজনৈতিক লক্ষ্য হাসিলের উদ্দেশ্যে পাহাড়ে ‘সেনাবিদ্বেষ’কে জিইয়ে রাখছে।
বাম ধারায় উজ্জীবিত জেএসএস অপপ্রচারের অন্যতম লক্ষ্যবস্তু হিসাবে সেনাবাহিনীকে সব সময় সব ফোরামে তুলে ধরে। ১৯৭৬’র পরবর্তি সময়ে পাহাড়ে বিদ্রোহ দমনে সেনাবাহিনী নিয়োজিত হলে দেশে চলমান সেনাশাসনের সাথে পার্বত্য পার্বত্য চট্টগ্রামের অভিযানকে চমৎকারভাবে মিশিয়ে দেয়। সমতলে সেনাশাসন ও পাহাড়ের সেনা অভিযানকে একই তুলিতে চিত্রিত করতে সদা সচেষ্ট থাকতো।
দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংগঠনগুলোতে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদসহ নানান নামের সংগঠনগুলো সফলভাবে অনুপ্রবেশ করে। সেনাশাসন অবসানে সমতলের বাম রাজনৈতিক বা প্রধান রাজনৈতিক দলের সামরিক শাসন বিরোধীর কর্মসূচির আড়ালে নিজেদের দাবিগুলো তুলে ধরার সুযোগ নিতো। বাম ছাত্র সংগঠন বা প্রধান বিরোধী দলের কর্মসূচির সাথে যুগপৎ কর্মসূচি দিয়ে তারাও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিতো।
‘৯০-র পর গণতান্ত্রিক ধারার রাজনীতির সূচনা হলে পাহাড়ী ছাত্র সংগঠনসহ সকল সামাজিক সংগঠন প্রকাশ্যে
সশস্ত্র সংগঠনের মুখপাত্র হিসাবে কাজ করতে থাকে। পাহাড়ে সংগঠিত যে কোনো ঘটনা বা দুর্ঘটনাকে তারা
তাদের অনুকূলে নিতে খুবই তৎপর থাকতো।
সেনাবাহিনী একটি পেশাদার সংগঠন হিসাবে আভিযানিক কর্মকাণ্ডে বেশি মনোযোগী হওয়ার কারণে মিডিয়াওয়ারে সব সময়ই পিছিয়ে ছিল। যে কোনো ঘটনার ব্যাখ্যা প্রদানে যেহেতু সরকারের আমলাতান্ত্রিক ধারাগুলো পার হতে হয়, তাই পাহাড়ে তাৎক্ষণিকভাবে ঘটে যাওয়া কোন ঘটনার সঠিক বিশ্বাসযোগ্য সংবাদ ও বিশ্লেষণ যোগাড় করতে যে সময় ব্যয়িত হতো তার পূর্বেই একটি একপেশে সংবাদ (পাহাড়ী বা লোকাল ভার্সন) জাতীয় গণমাধ্যমে মোটামুটি বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করে ফেলতো। বিলম্বে প্রাপ্ত সঠিক তথ্য ইতিপূর্বে প্রচারিতত তথ্যের বিভ্রান্তিকে অতিক্রম করে ড্যামেজ কন্ট্রোল আর হতো না। পার্বত্য চট্টগ্রামে সঠিক তথ্য সংগ্রহে বাঁধাগুলো নিম্নরূপ:
ক. দীর্ঘদিন সেনাশাসন বলবৎ থাকায় সংবাদকর্মীদের সাথে মিলিটারীর মনস্তাত্ত্বিক দূরত্ব।
খ. পার্বত্য চট্টগ্রামে অবাধ চলাচলের উপর বিধি নিষেধ।
গ. তথ্য প্রবাহে বিধি নিষেধ।
ঘ. গণমাধ্যমের কর্মীদের উপর পাহাড়ী (জেএসএস) নেতৃবৃন্দের প্রভাব এবং গণমাধ্যমে অধিকহারে পাহাড়ী সংগঠনের কর্মীদের নিয়োগ।
দুই দশকের বেশি সময় ধরে চলা সশস্ত্র সংঘাতের খুব কম খবর জাতীয় সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম সংক্রান্ত যে কোনো ধরনের সংবাদকেই তখনকার সামরিক শাসক ব্যক্তিগণ তাদের বৈধতার প্রতি এক ধরনের চ্যালেঞ্জ মনে করতো। সামরিক শাসকরা সবসময়ই দেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে বৈধতা প্রাপ্তিতে সচেষ্ট থাকতো এর মাঝে পাহাড়ের সংঘাত তাদের বৈধতা অর্জন বা সক্ষমতার প্রতি একটি চ্যালেঞ্জ মনে করতো।
রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ সামরিক সরকারকে অধিকতর চাপে রাখার জন্য পাহাড়ী তৎপরতাকে প্রকাশ্যে কোন নিন্দা করতো না। অতএব স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ের পাহাড়ের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন বা সশস্ত্র সংগ্রামকে Crying Baby of Military অথবা সেনাসৃষ্ট একটি সামরিক সমস্যা বলেই মনে করতো। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ মনে করতো তারা ক্ষমতায় এলে তারাই সমস্যার সমাধান করবেন। তাই সামরিক শাসনামলে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের উদ্যোগ খুব বেশি সফল হতে পারেনি।
পাহাড়ে সেনাবাহিনীকে সকল বিরোধের মূল প্রতিপক্ষ হিসাবে দাঁড় করাতে পাহাড়ী নেতৃবৃন্দ (স্পষ্ট করে বললে সন্তু লারমা) সব সময়ই সরব। সমস্যাটি যে রাজনৈতিক নেতাদের ভুল বা অস্পষ্ট সিদ্ধান্ত থেকে জন্ম সে কথাটি খুব বেশি চাউর হয় না। সেনাবাহিনীর পার্বত্য চট্টগ্রামে গমন যে একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ফল সে বিষয়টি চাপা পড়ে গেছে সামরিক নেতৃবৃন্দ তখন রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন ছিলেন বলে।
বেসামরিক আমলা, বুদ্ধিজীবীদের একটি বিরাট অংশ, সংবাদ মাধ্যমের কর্মীসহ দেশের অনেক মানুষের কাছে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাটি ‘সেনবাহিনীর নিরাপত্তা’ সংক্রান্ত একটি বিষয় হিসাবে থেকে গেছে, যার দায় প্রতিনিয়ত সেনাসদস্যদের বহন করতে হয়েছে সেনাবান্ধব বা প্রকৃত তথ্যানুসন্ধানী সংবাদকর্মী সেনাবাহিনীর পাশে না থাকার কারণে। সে দায় এখনো সেনাবাহিনী বহন করে যাচ্ছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে জেএসএস এবং অন্যান্য সশস্ত্র সংগঠনগুলোর মুখপাত্রগুলো প্রতিনিয়ত সেনাবাহিনীর চরিত্র হননের জন্য ‘ধর্ষক’ ‘নারী নির্যাতনকারী’ মানবাধিকার ক্ষুণ্নকারীসহ নানাবিধ উপাধিতে ভূষিত করে দেশ-বিদেশে প্রচার চালাতে সদাই সচেষ্ট। অথচ এসব অপপ্রচারকারীদের আত্মীয়-স্বজনের সিংহভাগ অংশ সেনাবাহিনীতে অব্যাহতভাবে চাকরি করে যাচ্ছে। জাতিসংঘের আদিবাসী ফোরামের চাকমা সার্কেল চীফ মানবাধিকার লংঘনের কল্পিত অভিযোগ তুলে বিদেশে সেনাবাহিনীর মিশন বন্ধ করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। অথচ একটি সময় তিনি নিজে ওয়ান ইলেভেনের সরকারে উপদেষ্টার পদ অলঙ্কিত করেছেন।
তিনি বা সন্তু লারমা যখন সরকারে বরাদ্দকৃত এসইউভি চরে সেনাবাহিনীর শ্রমে নির্মিত একদা দুর্গম পাহাড়ী পথ পাড়ি দেন এক লহমায় তখন সবুজ পাহাড়ের প্রান্তে কোনো সেনাশাসন দেখেন না। যখন হঠাৎ ভূমিধসে পাহাড়ী পথ বন্ধ হয়ে যায়, এক হাঁটু কাঁদার মধ্যে কোদাল হাতে মাটি সরাতে ঘর্মাক্ত সেনাসদস্যের মধ্যে কোন সেনাশাসন।
দেখেন তা জানতে ইচ্ছে করে। জানতে ইচ্ছে করে দুর্গম পাহাড়ী পাড়ায় চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত সেনাসদস্যরা কোন সেনাশাসন চালাচ্ছেন দরিদ্র মানুষের সেবার মাধ্যমে।
ব্রিটিশরা যুগ যুগ ধরে পলিসি অব এক্সক্লুজন বা রাজনৈতিক বহির্ভূতকরণ নীতি যা হিল ট্যাক্স ম্যানুয়েল ১৯০০ নামে পরিচিত এক ঘেরাটোপে পাহাড়ীদের আবদ্ধ করে রেখেছিল। যার মূল উদ্দেশ্য ছিল বৃহত্তর বাঙালিদের থেকে আলাদা করে রাখা। সেই নীতির কারণে পাহাড়ীদের মধ্যে সন্দেহপ্রবণতা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে প্রবাহিত হচ্ছে। ঘোরতর সশস্ত্র সংগ্রামের সময় পার্বত্য চট্টগ্রামে রাস্তাঘাট নির্মাণকে সামরিক অভিযানের নিমিত্তে তৈরি করা হচ্ছে বলা হতো। এখন বলা হয়, পর্যটনের জন্য, পাহাড়ীদের ভূমি গ্রাসের জন্য রাস্তা তৈরি করছে সরকার। তাই প্রত্যন্ত অঞ্চলের ১০ ফুট রাস্তাকে ৩০ ফুটের প্রশস্তকরণ বা সীমান্ত সড়ককে সামরিক কাজে ব্যবহারের জন্যই তৈরি করা হচ্ছে বলে অপপ্রচার করছে। পাহাড়ের উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা নির্মাণে সেনাবাহিনী দিনরাত পরিশ্রম করছে কিন্তু বাঁশের চোঙার মতো দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বলা হচ্ছে এসবই সেনাশাসনের নিমিত্ত মাত্ৰ।
পার্বত্য চট্টগ্রামের বিরাজমান গোষ্ঠীগুলো স্বাধীন বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রতীক বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পার্বত্য চট্টগ্রামের উপস্থিতিকে সেনাশাসন হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। সকল মানবিক ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে সেনাবাহিনীর কার্যক্রম দেখে নিরব থাকে। সেনা কর্তৃক নির্মিত রাস্তা ভালো, সেনা পরিচালিত স্কুল ভালো, কোভিডের টিকা কার্যক্রমে সেনা ভালো, ভূমিধস পরবর্তী উদ্ধার কাজে সেনা ভালো, পাহাড়ী কোটায় চাকরি নিতে সেনাবাহিনী ভালো। তারপরও ২রা ডিসেম্বর এলে মনে হয় এই বুঝি সেনা এলো। আসলে সেনাবিদ্বেষ, দেশ বিদ্বেষ, মুসলিম বিদ্বেষ সবই একটি সূতায় বাঁধা বাঙালি বিদ্বেষ।
লেখক-মেজর নাসিম (অব:)
১. ১২ .২০২২
ঢাকা