সম্প্রতি কুকি-চিন সন্ত্রাসীগোষ্ঠী আলোচনায় আসার জন্য আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামের বম (Bawm) জাতিগোষ্ঠীর মানুষদের ব্যাপারেও জানতে পারছি। যদিও তারা সংখ্যায় খুব বেশি না, ১৫ হাজারেরও কম হবে। কিন্তু তাদের ভাষায় বাইবেল অনুবাদ হয়ে গেছে। সেই বাইবেল অনলাইনে কিনতে পাওয়া যায়, গুগল প্লেস্টোরে বম (Bawm) ভাষায় ফ্রি বাইবেলের অ্যাপও পাওয়া যায়। বম জাতিগোষ্ঠীর মানুষেরা মূলত খ্রিষ্ট ধর্মালম্বী। আমাদের বাংলাদেশ খুব বড় দেশ না হলেও এই দেশে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী ও ভাষার মানুষ বাস করে। চাকমা, মারমা, গারো, সাঁওতালসহ আরো বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী এদের মাঝে অন্যতম। তাদের অধিকাংশই এখন খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত। তাদের প্রত্যেকের ভাষাতেই এখন বাইবেল অনুবাদ আছে এবং সেগুলোর হার্ডকপির সাথে সাথে ফ্রি অ্যাপও রয়েছে। যদিও ৩০-৪০ বছর আগেও হয়তো চিত্র এমন ছিল না, তাদের অন্য ধর্মবিশ্বাস ছিল। এটা ভেবে কি অবাক লাগে না যে এত অল্প সময়ের মধ্যে তারা খ্রিষ্ট ধর্মে দীক্ষিত হয়ে গেল আর তাদের ভাষাতে বাইবেলের মতো বিশাল গ্রন্থ অনুবাদ হয়ে গেল আর এত সহজলভ্য হয়ে গেল?
.
পশ্চিমা দেশগুলোর বিশেষ করে আমেরিকান খ্রিষ্টান মিশনারীরা বিশ্বময় তাদের ধর্ম প্রচারের জন্য ব্যাপক আত্মনিয়োগ করছে। পৃথিবীর হেন অঞ্চল নেই যেখানে তাদের পদচারণা নেই। পৃথিবীর নানা দুর্গম অঞ্চলেও তারা তাদের ধর্ম প্রচার করে, হাজার হাজার ভাষায় বাইবেল অনুবাদ করে তারা মানুষের জন্য সহজলভ্য করে দিয়েছে। বাংলাদেশ আর ভারতের এত ভাষাতে তারা বাইবেল অনুবাদ করেছে ও অনলাইনে ফ্রিতে উন্মুক্ত করে দিয়েছে যা রীতিমত অবিশ্বাস্য। এই অঞ্চলে এত ভাষা আছে সেটাই হয়তো অনেক মুসলিম জানে না, অথচ খ্রিষ্টান প্রচারকরা সাত সমুদ্র তের নদী পার হয়ে এসে এসব ভাষা শিখেছে, এরপর সেই ভাষায় নিজেদের ধর্মগ্রন্থ অনুবাদ করেছে।
.
আমরা মুসলিমরা হাজার বছর ধরে এই অঞ্চলে আছি, অথচ বাংলা ভাষাতেই খুব ভালো মানের সাবলীল কুরআনের অনুবাদ খুব বেশি নেই। এই দেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোর ভাষায় কুরআন বা কোনো হাদিসের গ্রন্থ অনুবাদ করার কথা তো আমরা স্বপ্নেও ভাবিনি, আল্লাহর কালামকে আমরা এসব মানুষের কাছে পৌঁছে দেবার কথা চিন্তাও করিনি। ওদিকে ইউরোপ-আমেরিকার খ্রিষ্টান প্রচারকরা দূর দেশ থেকে এসে এদেরকে নিজ ধর্মে দীক্ষিত করে ফেলেছে। আমরা আমাদের দ্বীনকে এসব মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারিনি, কেননা আমরা অনেক ‘জরুরী’ কাজে ব্যাস্ত। তারাবী ৮ রাকাত নাকি ২০ রাকাত, হাত নাভির উপরে নাকি নিচে বাঁধব – এসব নিয়ে যুদ্ধ না করলে কি উম্মাহ উদ্ধার হবে নাকি? আমাদের ওয়াজ-মাহফিলে অনেক মানুষের ভিড় হয়, এটাই আমাদের জন্য যথেষ্ট। সেখান থেকে ভিন্ন মাসলাকের ভাইকে কিছু কটূ কথা বললে বা কিছু ভাইরাল ডায়লগ দিলে তো আরো ভালো। পাহাড়ী মানুষদের কাছে দ্বীন পৌঁছানোর আর কী দরকার।
.
পাহাড়ী গরিব মানুষের চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই, শিক্ষার ব্যবস্থা নেই, ঐদিকে আমরা দৃষ্টি দেইনি; খ্রিষ্টান মিশনারীরা ঠিকই তাদের খাবার দিয়েছে, চিকিৎসা দিয়েছে, তাদের জন্য স্কুল করেছে। এদিকে আমরা মিলাদ পড়িয়ে আর মানুষের থেকে ‘হাদিয়া’ নিয়ে সন্তুষ্ট থেকেছি। খ্রিষ্টান মিশনারীরা ওদের হাতে পৌঁছে দিয়েছে বাইবেল, তাদের জন্য ঐ অঞ্চলে চালু করেছে খ্রিষ্টীয় এফএম রেডিও। এদিকে আমরাও “বিশাল” কাজ করে চলছি, “Yahooদি-নাসারার চক্রান্ত” বলে কিছু হুঙ্কার দিচ্ছি। আমাদের হুঙ্কারে কিছু শ্রোতা উদ্বেলিত হচ্ছে। ওদিকে পার্বত্য অঞ্চলে, উত্তরাঞ্চলে, সীমান্ত অঞ্চলে এমনকি শহরাঞ্চলেও দলে দলে মানুষের কাছে যিশুর বাণী পৌঁছে দিয়ে ব্যাপ্টাইজ করছে খ্রিষ্টান মিশনারীরা। এদিকে আমরা এমন কার্যকলাপ করছি তা দেখে যারা দ্বীনের মধ্যে আছে তারাও দ্বীন ছেড়ে দেবার উপক্রম। এসব নিয়ে ভেবে আর কী হবে, কিছুদিন পরে হয়তো ঈদের নামাজে কয় তাকবির, লোকাল নাকি গ্লোবাল, খাদ্য নাকি টাকা – এইসব নিয়ে কিঞ্চিত মহাযুদ্ধ চালিয়ে দ্বীনের শান-মান বৃদ্ধিতে আমরা ঝাঁপিয়ে পড়ব।
.
আমাদের উচিত নিজেদের কর্মপন্থা নিয়ে আরেকবার ভাবা। আমরা কি আসলেই রহমাতাল্লিল আলামিন মুহাম্মাদ(ﷺ) এর আনিত দ্বীন অনুসরণ করছি, নাকি এর নাম করে অন্ধ মাসলাকবাজি, স্বার্থপরতা, দুনিয়াপ্রীতি আর হিংসা-বিদ্বেষের চর্চা করছি – এই জিনিসটা একবার চিন্তা করা দরকার। খ্রিষ্টান মিশনারীরা তাদের বিকৃত হয়ে যাওয়া কিতাব ও ধর্মের জন্য যা করছে আমরা কি আল্লাহর সত্য দ্বীনের জন্য এর সিকিভাগও করছি? এই পোস্টটায় আমি খ্রিষ্টানদের প্রশংসা করলাম এবং মুসলিমদের সমালোচনা অর্থাৎ আত্মসমালোচনা করলাম। নিজেদের অবস্থার সংশোধণের জন্য আত্মসমালোচনার দরকার আছে।
লেখক: মোহাম্মদ মুশফিকুর রহমান মিনার
অনলাইন এক্টিভিটিস
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=pfbid02K9gs93VKFHTY5jcbo7LMSya8v9d4NTviZABNBq76UJ8nCAEhWiynRbmyNjsP73UFl&id=100000561910678&mibextid=Nif5oz