অন্তত অসীম:
পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল, যা উন্নয়ন এবং আধুনিক প্রযুক্তির সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরে পিছিয়ে রয়েছে, সেখানে সাম্প্রতিক সময়ে চাঁদাবাজি এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কারণে মোবাইল নেটওয়ার্ক পরিষেবা বিপর্যস্ত হয়েছে। এই সংকট শুধু যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে না, বরং এই অঞ্চলের সার্বিক উন্নয়নকেও বাধাগ্রস্ত করছে।
মালয়েশিয়ান মালিকানাধীন মোবাইল অপারেটর রবি’র পার্বত্য এলাকায় প্রায় ৩২০টি টাওয়ার পরিচালিত হয়। সারা দেশে রবির মোট ১৮,০০০ টাওয়ারের মধ্যে এই অঞ্চলের টাওয়ারগুলো পরিচালনা করতে গিয়ে প্রতিষ্ঠানটি প্রতিমাসে প্রায় ৭০ লাখ টাকা চাঁদা দিতে বাধ্য হয়। তবে সম্প্রতি ইউপিডিএফ (ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট) আরও বড় অঙ্কের অর্থ দাবি করেছে। তাদের চাহিদা পূরণ করতে না পারায় টাওয়ার লাইন কেটে ফেলা, ব্যাটারি লুট করা, এবং জেনারেটর ধ্বংস করার মতো ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছে।
সম্প্রতি অপহরণ ও ধ্বংসযজ্ঞের ঘটনা: এক শ্রমিক, যিনি দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে কাজ করতেন, মঙ্গলবার রাঙামাটি থেকে পানছড়ির একটি টাওয়ার মেরামত করতে গিয়ে অপহৃত হন। ধারণা করা হচ্ছে, তাকে ইউপিডিএফ নিয়ন্ত্রিত শান্তিপুর এলাকায় রাখা হয়েছে। এ ধরনের কর্মকাণ্ড শুধুমাত্র মোবাইল অপারেটরদের অর্থনৈতিক ক্ষতিই করছে না, বরং মানবিক দিক থেকেও তা গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অপহৃত শ্রমিকের পরিবারের পক্ষ থেকে থানায় অভিযোগ না করায় স্থানীয় প্রশাসনের ভূমিকা সীমিত থেকে যাচ্ছে। খাগড়াছড়ির পুলিশ সুপার আরেফিন জুয়েল বিষয়টি খতিয়ে দেখার আশ্বাস দিয়েছেন। তবে এ ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড মোকাবিলায় প্রশাসনের ভূমিকা আরও সক্রিয় হওয়া প্রয়োজন।
টেকসই যোগাযোগ ব্যবস্থা ও ইউপিডিএফের হুমকি: রবি ও অন্যান্য অপারেটর কোম্পানিগুলো পার্বত্য চট্টগ্রামে মোবাইল নেটওয়ার্ক স্থাপন করে স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে আধুনিক প্রযুক্তির সুযোগ দিতে চেয়েছে। এ অঞ্চলের পশ্চাদপদ জনগোষ্ঠীর জন্য ই-কমার্স, ইন্টারনেট পরিষেবা এবং বহির্বিশ্বের সাথে যোগাযোগের সুযোগ তৈরি হয়েছে। কিন্তু আঞ্চলিক দলগুলোর চাঁদাবাজি ও ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড এসব উদ্যোগকে স্থবির করে দিচ্ছে।
ইউপিডিএফের পক্ষ থেকে এককালীন ৫ কোটি টাকা চাঁদা দাবি এবং তা পূরণে ব্যর্থ হলে টাওয়ার ধ্বংস করার ঘটনা প্রযুক্তি খাতে পাহাড়ি অঞ্চলের বিপদগামী রাজনৈতিক দলের এক ভয়াবহ উদাহরণ। ফলে, রবির মতো কোম্পানিগুলোকে প্রতিমাসে প্রায় ৩ কোটি টাকা চাঁদা দিতে হয়, যা তাদের আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি সার্বিক পরিষেবার ওপরও প্রভাব ফেলছে।
অস্ত্র সংগ্রহের পরিকল্পনা ও চাঁদাবাজির অর্থায়ন: বিশ্বস্ত সূত্র থেকে জানা গেছে, ইউপিডিএফ পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে চাঁদা আদায়ের অর্থ ব্যবহার করে ভারী অস্ত্র সংগ্রহ করছে। ত্রিপুরা এবং মিজোরামে সংগঠনের সদস্যদের আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রসহ আটক করার ঘটনা এটি নিশ্চিত করে। হুন্ডির মাধ্যমে সংগৃহীত কোটি কোটি টাকা প্রতিবেশী দেশে অস্ত্র কেনার জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। এ ধরনের কার্যকলাপ শুধু পার্বত্য চট্টগ্রামের নয়, বরং পুরো দেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ।
উন্নয়নের বাধা: মানুষের দুর্ভোগ ও সম্ভাবনার অপচয়: পাহাড়ি অঞ্চলের মানুষ দীর্ঘদিন ধরে উন্নয়নবঞ্চিত। মোবাইল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ইন্টারনেট এবং অন্যান্য সেবার মাধ্যমে তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করার প্রচেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু এসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কারণে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ বাড়ছে। টাওয়ারগুলোর ধ্বংসের ফলে নেটওয়ার্ক সংকট দেখা দিয়েছে, যার ফলে স্থানীয় মানুষের ইন্টারনেট সেবা, মোবাইল যোগাযোগ এবং আধুনিক প্রযুক্তির সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতে হচ্ছে।
প্রশাসনের ভূমিকা ও করণীয়: এ ধরনের সন্ত্রাসী কার্যক্রম বন্ধ করতে প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আরও কার্যকর ভূমিকা প্রয়োজন।
(১) বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন: পাহাড়ি অঞ্চলে সন্ত্রাস দমনের জন্য বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করা যেতে পারে।
(২) প্রযুক্তিগত নজরদারি: অপারেটরদের টাওয়ার এবং সরঞ্জামগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রযুক্তিগত নজরদারি বাড়ানো প্রয়োজন।
(৩) অর্থনৈতিক উৎস বন্ধ করা: আঞ্চলিক দলগুলোর চাঁদাবাজি রোধে তাদের অর্থনৈতিক উৎস বন্ধ করার পদক্ষেপ নিতে হবে।
(৪) সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি: পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে এসব বিপথগামী দলের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তোলা যেতে পারে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে চাঁদাবাজি এবং সন্ত্রাসী কার্যকলাপ মোবাইল নেটওয়ার্ক এবং আধুনিক প্রযুক্তির উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করছে। প্রশাসনের কার্যকর পদক্ষেপ এবং স্থানীয় জনগণের সহযোগিতার মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। পাহাড়ি অঞ্চলের মানুষের জন্য উন্নয়নের দরজা খুলতে হলে এসব নেতিবাচক প্রভাব দূর করে নিরাপদ এবং টেকসই যোগাযোগ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।