রক্তাক্ত অরণ্যের আর্তনাদ, পাহাড়ের চোখের জল কতদিন ঝরবে?

সংঘাতের এক অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে, সাধারণ মানুষ যে আঘাত পায়, তা কখনোই সাময়িক থাকে না।

0
ছবি: নিহত রূপসী চাকমা ও তার তিন বছরের শিশুকন্যা বন্ধনা চাকমা

টিনা চাকমা, মেকি চাকমা ও পাভেল করাচিন | পানছড়ি, খাগড়াছড়ি থেকে

আমি কীভাবে শুরু করি? আমি বাকরূদ্ধ ও শীতল হয়ে গেছি, যখন শুনলাম তিন বছরের নিষ্পাপ শিশুর কান্না, আর কিছুক্ষণের মধ্যে যখন চোখের সামনে সেই মায়ের মৃতদেহ পড়তে দেখলাম—যে মা কেবলমাত্র স্বাভাবিক জীবনযাপন করছিল। তার জীবনের পণ ছিল কৃষিকাজ, খেটে খাওয়া মানুষের জীবন। এখনো মনে পড়ছে সেই কণ্ঠ, যেটি বিলীন হয়ে গিয়েছিল মৃত্যুর আগে। পাহাড়ের বুকে, যেখানে মানবিকতা অনিশ্চিত, সেখানে এক নিষ্পাপ শিশুর কান্না এবং মায়ের খুনের ঘটনাটি সবার অন্তরকে যেন চিরতরে বিদ্ধ করে দেয়।

এটা কোনো দুঃখজনক ঘটনা নয়, এটি পার্বত্য চট্টগ্রাম তথা আমাদের নিজস্ব সমাজে অত্যাচারী শক্তির নির্মমতা। এটা এমন এক সময়, যখন পাহাড়ের সব নারী, পুরুষ এবং শিশুদের সামনে গভীর একটা প্রশ্ন এসে দাঁড়িয়েছে—এবং সেই প্রশ্ন হচ্ছে, তারা কি চুপ করে থাকবে?

পাহাড়ের মানুষ, যারা কখনো অস্ত্রধারীদের গোলাবারুদ, চাঁদাবাজি, এবং আধিপত্যের সংগ্রামে নিপতিত হয়েছে, তাদের উচিত একত্রিত হয়ে প্রতিহত করা, তাদের শক্তিকে ঠেকানো। তারা শান্তি চায়, তারা নিরাপত্তা চায়, কিন্তু তাদের দাবি তো নীরবতাতেই যেন চাপা পড়ছে!

চুক্তির পরও রক্তের স্রোত কেন?

পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল ১৯৯৭ সালে। উদ্দেশ্য ছিল সহিংসতার অবসান, অস্ত্রের নল থেকে মুক্তি। কিন্তু বাস্তবতা কী? শান্তির পরিবর্তে পাহাড় আজ রক্তক্ষয়ী সহিংসতার কারাগারে বন্দি। এটি কী জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) সন্তু লারমা গংদের বিশ্বাসঘাতক নয়?

৩ মার্চ, সোমবার, এই বিষয়টি আবারো এক নতুন রূপে সামনে এসেছে, যখন পার্বত্য চট্টগ্রামের চুক্তি বিরোধী সংগঠন ও চুক্তিপন্থী সংগঠনের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে গোলাগুলি বিনিময় হয়েছে। সীমান্তবর্তী এলাকায় অস্ত্র চালানের পথটি দখলে রাখার জন্য মূলত দীর্ঘদিন ধরে আধিপত্য প্রশ্নে সংঘর্ষ। খাগড়াছড়ি জেলার পানছড়ি উপজেলার ধুধুকছড়ার হাতিমারা ছড়ার একটি এলাকায়, যেখানে উভয় পক্ষই অস্ত্রের শক্তিতে বিশ্বাসী, সেখানে প্রতিপক্ষকে টার্গেট করে গুলি ছোঁড়া হয়। ইউপিডিএফ এর ছোঁড়া গুলি এতে এক নিষ্পাপ নারী, রূপসী চাকমা, মৃত্যু বরণ করেন। স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, নিহত রূপসী চাকমার শিশুকন্যা, যে তার মা’কে কেন কথা বলছে না, সেই প্রশ্ন করেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে।

এতটুকু ছিল এই নিষ্পাপ শিশুর অপরাধ? কোথায় ছিল তাদের অপরাধ? কেন রূপসী চাকমার প্রাণ কেড়ে নেওয়া হলো? তার স্বামী হেমন্ত চাকমা তো ছিল সাধারণ কৃষক, খেটে খাওয়া মানুষ। আজকের পৃথিবী, যেখানে শক্তিশালী অস্ত্রের মাঝে মানবিকতা ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে, সেখানে এই নারীর মৃত্যু কী কোনো অপ্রত্যাশিত ঘটনা ছিল?

কিন্তু তাদের স্বার্থের পথে যারা হাঁটে, তাদের কাছে এই মৃত্যুগুলোর কোনো মূল্য নেই। কেননা, তাদের মূল লক্ষ্য থাকে ক্ষমতার সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছানো, যার জন্য তারা নিজেদের অস্ত্রের ক্ষমতাকে ব্যবহার করে সাধারণ মানুষের রক্তে রাজনীতি রচনা করতে চায়। এই ধরনের সংঘর্ষ পাহাড়ি জনগণের জন্য নতুন কিছু নয়। দীর্ঘকাল ধরে এসব সন্ত্রাসী সংগঠন একের পর এক অপরাধের অঙ্গীকার করে যাচ্ছে, আর প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের পেছনে রয়েছে ক্ষমতার ক্ষুধা, চাঁদাবাজি এবং সাম্প্রদায়িক বিভাজন। বাঙালিরা এই হত্যা নির্যাতনের সবচেয়ে বড়ো শিকার।

অথচ, কি অদ্ভুত একটা মিথ্যাচার! যারা জাতির অধিকারের কথা বলে, তারা কি নিজেদের অপরাধকে ঢেকে রাখতে চায়? ইউপিডিএফ কিংবা জেএসএস, যারা পাহাড়ি জনগণের অধিকারের কথা বলে, তারা কিভাবে এই আধিপত্য বিস্তার ও চাঁদাবাজির লড়াইয়ের পথে মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়? তাদের অস্ত্রের আগ্রাসনে, তাদের চাঁদাবাজির প্রবণতায়, সাধারণ মানুষই তাদের বলি হয়ে যায়।

আমাদের সমাজে, যারা বীরত্বের সুরে চিৎকার করে, তারা কখনোই নিজেদের অপরাধের দায় স্বীকার করতে চায় না। ইউপিডিএফ ও জেএসএস, যারা নিজেদের ‘জাতির অধিকারের’ কথা বলে, তারা কী কখনো বুঝবে যে, সাধারণ পাহাড়ি জনগণের গায়ে গুলি ছুঁড়তে, তাদের জীবনের মূল্যহীন হয়ে যেতে শিখিয়েছে? তাদের প্রেরণা কি সত্যিই পাহাড়ি জনগণের কল্যাণে? নাকি এটি শুধুমাত্র চাঁদাবাজি ও আধিপত্য বিস্তার?

চিরসবুজের পাহাড়ে আজ রক্তাক্ত অরণ্যের আর্তনাদ, পাহাড়ের চোখের জল কতদিন ঝরবে? কে দিবে সে প্রশ্নের সোজা উত্তর?

১৯৯৮ সাল থেকে ইউপিডিএফ, পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় খুন, গুম, অপহরণসহ অন্তত ১৫০০ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। ২০০৪ সালে পানছড়িতে অষ্টম শ্রেণীর স্কুল ছাত্রী ও পানছড়ি উন্নয়ন কাজের বাঙালি লেবার এবং আজ রূপসী চাকমার হত্যাকাণ্ড তারই একটি নিদর্শন, যা পাহাড়ের শান্তিপ্রিয় জনগণের বুক চেপে ধরেছে। তারা যখন ইউপিডিএফের স্রষ্টা প্রসীত বিকাশ খীসা, রবি শংকর চাকমা ও প্রদীপন খীসার নাম উচ্চারণ করে, তারা সেই নেতাদের খোঁজ পায় যারা আজও বিদেশে বসে আরাম আয়েশে জীবন কাটাচ্ছে, অথচ তাদের চাঁদাবাজি এবং সহিংসতার বলি হয়ে যাচ্ছে পাহাড়ি জনগণ।

এখন প্রশ্ন উঠছে, ইউপিডিএফ চুক্তি বিরোধী এবং জেএসএস চুক্তি পক্ষ, এই সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো কী জানে পাহাড়ের কত মা, কত বোন তাদের হাতে বিধবা হয়েছে, কত পরিবার নিঃস্ব হয়েছে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর তাদের কাছে নেই। তারা জানে না, তাদের কর্মকাণ্ডের ফলে সৃষ্ট জাতিগত ভেদাভেদ, বৈষম্য ও বিভক্তি কতটা ধ্বংসাত্মক হতে পারে। তারা কখনোই আমাদের সম্মান বুঝবে না, আমাদের হৃদয় বুঝবে না, কারণ তারা শুধু নিজেদের স্বার্থে পাহাড়ে অশান্তি সৃষ্টি করতে চাইছে।

এই সংঘাতের এক অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে, সাধারণ মানুষ যে আঘাত পায়, তা কখনোই সাময়িক থাকে না। তাদের দুঃখ, কষ্ট, এবং ক্ষোভ শুধু একটি মুহূর্তের জন্য থাকে না; বরং তা যুগ যুগ ধরে, প্রজন্মের পর প্রজন্মের জন্য বেড়ে চলে। রূপসী চাকমার মৃত্যুর পর তার তিন বছরের শিশুকন্যার চোখে যে হতাশা, অসহায়ত্ব, এবং প্রতিশোধের আগুন জ্বলছে, তা এখন আর কোনো সীমা মানে না। এটি সমস্ত পাহাড়ের নারীর জন্য একটি সংকেত, একটি আহ্বান, যা বার্তা দিচ্ছে যে, পরিবর্তন সময়ের দাবী।

আজকের ঘটনা, যেখানে একজন মা নিহত হয়েছেন, তার শিশুকন্যা আর কিছু বলতে পারছে না, তার কান্না পুরো পাহাড়কে যেন শেকলবদ্ধ করেছে, এটাই আমাদের আসল শত্রু—সন্ত্রাস, অপহরণ, খুন, এবং ক্ষমতার মোহ। আমাদের উচিত, এই সব সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে একত্রিত হয়ে দাঁড়িয়ে, তাদের বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিবাদ গড়ে তোলা। প্রতিটি পাহাড়ি জনগণকে, যে-কোনো সংগঠন বা ব্যক্তির দ্বারা অত্যাচারিত না হতে, তাদের অবস্থান স্পষ্ট করতে হবে।

এখনই সময় এসেছে, সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তোলার। এখনই সময়, তাদের আধিপত্য বিস্তারকে প্রতিহত করার। এবার পাহাড়ি জনগণকে জানিয়ে দেওয়া দরকার, তাদের কোনো জায়গা এখানে নেই। তাদের অস্ত্র ও খুনের রাজত্ব পাহাড়ে কখনোই চলবে না।

এতদিন পর, যখন আমরা পাহাড়ের শান্তিপূর্ণ চিত্রের কথা ভাবি, তখন আমরা নিশ্চয়ই সেদিকে ফিরে তাকাতে চাইব যেখানে মানুষ একে অপরকে সহানুভূতির চোখে দেখেছিল, যেখানে অস্ত্রের পরিবর্তে মনুষ্যত্বের জয়ধ্বনি ছিল। কিন্তু সেই সময় আসতে দেরি না হয়ে আজই পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সন্ত্রাসী শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানাতে হবে।

আগের পোস্টসন্ত্রাসীদের গুলিতে নীরিহ গৃহবধূ নিহত: পাহাড়ে অশান্তির অধ্যায় দীর্ঘ হচ্ছে।
পরের পোস্ট‘মা হত্যার বিচার চাওয়াও যেখানে মানা।’

রিপ্লাই দিন

আপনার কমেন্ট লিখুন
আপনার নাম লিখুন