আমি মিতালী চাকমা আজকে শেয়ার করবো আমার জীবনের অনাগত দিনগুলোর সুখময় স্মৃতি; যা আজ শুধুই অতীত!
আমার বাড়ি রাঙ্গামাটি জেলা সদরের দেবাশীষ নগর। মিতালী চাকমা আমার ছদ্মনাম। নিরাপত্তাজনিত কারণে নিজের প্রকৃত নাম গোপন রাখতে হলো। আমার বাবা একজন সরকারি চাকরিজীবী, মা গৃহিনী। আমরা তিন ভাই বোনের মধ্যে আমি সবার বড়। আমার নায়িকা মার্কা চেহারা না হলেও অধিকাংশ ছেলেরা আমার দিকে সবসময় তাকিয়ে থাকত। তবে জানি না সেটা কেন।
নানুর বাড়ি নানিয়ারচর উপজেলা হওয়ার সুবাদে আমার বেড়ে ওঠা নানিয়ারচর। আমি প্রাথমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পড়াশোনা নানিয়ারচর থেকে করেছি। স্কুলে নবম শ্রেণীতে পড়াশোনা চলাকালীন আমার সঙ্গে সম্পর্ক হয় মোঃ রিপন নামের এক বাঙ্গালী ছেলের। রিপনের নানিয়ারচর বাজারে দোকান ছিল। মেয়েদের প্রয়োজনীয় প্রায়ই সকল জিনিসই তার দোকানে পাওয়া যেত। তাই কেনাকাটার জন্য মূলত তার দোকানে নিয়মিত আসা-যাওয়া হত। সেই সূত্র ধরে তার সাথে আমার পরিচয়। আরো একটি বিষয় হচ্ছে আমাদের পাহাড়ি সব মেয়েরাই তার দোকানে যেত। তাই আমরা তার দোকানে সবসময় নির্ভয়ে যেতাম। দোকানদার রিপন বয়সে আমার থেকে ১০ বছরের বড় হবে। চেহারা অতুলনীয় না হলেও মধ্যে আলাদা মায়া আছে। ৫ ফুট ৬ ইঞ্চি লাম্বা এই ছেলেকে জীবনে এতোটাই ভালোবেসে ফেলবো তা কল্পনার জগতে ছিলনা। যাক আসল কথায়ই আসি- প্রথম প্রথমেই রিপনের দোকানে যেতাম কেনাকাটার প্রয়োজন মাফিক। তার সাথে কেনাকাটার বাহিরে কথা হত না। এক কথায় বিক্রেতা আর একজন ক্রেতার মধ্যে যা হয়। আমাদের মধ্যেও তাই ছিল। আমার বান্ধবীরা রিপনের সাথে ঠাট্টা মশকারি করত আর ফ্রিতে জিনিসপত্র নেওয়ার ধান্দায় তাকে বিভিন্নভাবে ম্যানেজ করার চেষ্টা করত। আমি আবার ফ্রী খাওয়ার ধান্ধায় নেই। যার কারণে তেমন কথা না বলে বান্ধবীদের তামাশা দেখতাম। নানিয়ারচর চাকমা অধ্যুষিত এলাকা যার প্রভাবে এখানে চাকমাদের আধিপত্য থাকাটা স্বাভাবিক। বাঙ্গালী দোকানগুলোতে পাহাড়ি মেয়েরা বেশি আসা-যাওয়া করলে পিসিপি’র ছেলেরা যথেষ্ট সন্দেহে চোখে দেখতে। এর অন্যতম কারণ ছিল নানিয়ারচরের এক বাঙ্গালী দোকানদারের সঙ্গে রিতা চাকমা নামের এক চাকমা মেয়ে প্রেমের সম্পর্ক ছিল৷ সেসময় পাহাড়ি মেয়ে সেটেলার বাঙ্গালী প্রেমের ঘটনার রেশ ধরে অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা তৈরি হয়েছিল। এছাড়াও নানিয়ারচরে সবসময় পাহাড়ি-বাঙ্গালী দাঙ্গাহাঙ্গামা লেগে থাকত। এই নিয়ে সবসময় উত্তেজনা বিরাজমান। তাই বাজারে পিসিপি’র ছেলেরা চোখে চোখেই রাখত পাহাড়ি মেয়েদের। কোনো পাহাড়ি মেয়ে বাঙ্গালী ছেলের সঙ্গে কথা বা সম্পর্ক করেছে এই খবর যদি পিসিবি’র কানে পৌঁছাত, তাহলে সে মেয়ে ও তার পরিবারের উপর স্টিমরোলার চালানো হত। এই বিষয়গুলোই নানিয়ারচরের মানুষ যারা তারা অবশ্যই কমবেশি জানার কথা।
রিপনকে নিয়ে আমার মনের প্রথম জল্পনা-কল্পনা শুরু হয় আমাদের কঠিন চীবরদান উৎসবের সময়৷ তখন কসমেটিক ও বিভিন্ন সামগ্রী কেনাকাটা করতে আমি তার দোকানে যাই। আমার সঙ্গে হেমা নামে আমার এক বান্ধবী ও তার মা ছিল৷ হেমা ও তার মা কিছু একটা কিনতে অন্য একটা দোকানে যায়। তখন দোকানে আমি আর রিপন ছাড়া অন্য কেউ ছিল না৷ তখন সময়টা সকাল আনুমানিক ১০ টা হবে৷ রিপনের দোকানের মালামাল ছিল দু’ভাবে বিভক্ত। অতিরিক্ত মালামাল দোকানের পেছনের অংশে ছিল৷ সামনের রুমের সঙ্গে পেছনের রুমের যাতায়াত পথ একটাই ছিল। তাই কোন সংকোচ না করে আমরা সবসময় দোকানে পেছনের অংশে যেতাম জিনিসপত্র দেখার জন্য। সেইদিন আমি দোকানের পেছনে গিয়ে পছন্দগুলো দেখতে ছিলাম। এমন সময় রিপন গিয়ে আমার পেছনে ঠেকেছে! পেছনের রুমে মানুষ সচারাচর প্রয়োজন ছাড়া যায় না, এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে রিপন আমি বুঝে ওঠার আগেই আমার সঙ্গে ঘেঁষে যায়। এমন একটা মূহুর্ত বা পরিবেশ যেখান থেকেই তাকে পাশ কাটিয়ে বের হওয়ার আমার কাছে সুযোগ ছিলনা। মনে হচ্ছে ঘেঁষাঘেঁষির মধ্যে আমি আর সেই এক দৃষ্টিতে ৩০ সেকেন্ডের মত ছিলাম৷ এবং প্রায় ২ মিনিট ছিলাম ঘেঁষাঘেঁষির মধ্যে। অবশ্যই সেই আমাকে একপ্রকার বাধ্য করেছে। এছাড়া আমার আর কোনো উপায় ছিলনা। সেদিন আমি এতটা বিব্রত হয়েছিলাম এবং এতটা হতবাক হয়েছিলাম যা ভাবনার জগতে ছিলনা। কোনভাবে নিজেকে সামলিয়ে দ্রুত দোকান থেকে বাসায় ফিরে আসি। এই বিষয়টি নিয়ে আমি বেশ কয়েকদিন চিন্তিত ছিলাম। একপ্রকার খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিয়েছিলাম৷ সেদিনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাটি নিয়ে প্রচন্ড ঘৃণা ও জেদ হয় রিপনের প্রতি। একবার ইচ্ছে করেছিল ঘটনাটি সবাইকে জানিয়ে দিব। কিন্তু এসব কিছু জানিয়ে দিলে মেয়েদের ইজ্জত থাকে না। যেহেতু আমি পাহাড়ি মেয়ে আর সেই বাঙ্গালী ছেলে বিষয়টি জানালে তার অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে। মেয়ে হিসেবে আমার জন্যও কলঙ্কর হবে। তাই নীরবেই ক্ষোভ ও ঘৃণা চাপা দিয়েছিলাম। এরপর হতে রিপনের দোকানে আসা-যাওয়া বন্ধ করে দিই। আমার সব বান্ধবীরা তার দোকানে যেত। এভাবেই মাস তিনেক কেটে যায়। একদিন রিপন আমার বান্ধবী হেমাকে বললো আমাকে দোকানে নিয়ে আসতে আমি কেন তার দোকানে আসিনা ইত্যাদি প্রশ্ন? হেমা এসে আমাকে বলার পরও যাইনি৷ কিন্তু রিপনের উপর প্রচন্ড ঘৃণা থাকলেও কেন জানি প্রায়ই তাকে মনে পড়ে৷ অবসর সময় সেদিনের সেই মূহুর্তগুলোই চোখে ভাসে। এভাবে আরো কিছুদিন চলে গেল।
নানিয়ারচর টিএন্টি বাজার হচ্ছে পাহাড়ি অধ্যুষিত গ্রামের একটি ছোট বাজার৷ এখানে কোনো বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া বাঙ্গালীরা আসেনা। রিপন কেন জানি সেদিন এসেছে। আমি ও আমার মামা এবং আমার মামার কথিত বন্ধু বিভাস চাকমা (নানিয়ারচর কলেজ পিসিপি’র সভাপতি) সহ মোবাইলে রিচার্জ কার্ড নেওয়ার জন্য এসেছি। এমন সময় দেখা হয়ে গেল রিপনের সাথে একই দোকানে। আমি তো তাকে না চেনার বান করে আছি। কারণ এখানে তার দিকে তাকানো বা তার সাথে কথা বলা মানে নিজের জীবন বিপন্ন করা৷ তাই স্বাভাবিকভাবে থাকলাম৷ কিন্তু রিপন এমনভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছে যেনো সেই আমাকে কিছু বলার চেষ্টা করছে৷ এমন মূহুর্তে রিপনকে কথা বলা থেকে বিরত রাখার সুযোগও নেই। আসেপাশে লোকজন সব পাহাড়ি, সাথে মামা ও তার মদখোর বন্ধু বিভাস। মামার বন্ধু সবসময় আমাকে চোখে চোখেই রাখে। সেই এ অঞ্চলের একটি সন্ত্রাসী সংগঠনের নেতা। আমার দিকে তার তীক্ষ্ণ নজর থাকে। এই পরিস্থিতিতে বাঙ্গালীর সঙ্গে কথা বলা মানে পিঠের চামড়া তোলা আর কলঙ্ক গায়ে মাখা। কৌশল করে রিপনের পাশে দাঁড়িয়ে আমার মোবাইলের মেসেজ অপশনে গিয়ে রিপন দেখার মত করে লিখলাম Pls… রিপন এখন এই মূহুর্তে কথা বলিও না, তুমি কথা বললে আমার সমস্যা হবে। তুমি কী চাও আমার সমস্যা হোক? রিপন এটা দেখে তার মোবাইলের মেসেজ অপশনে গিয়ে লিখলো, হ্যাঁ কথা বলবো না ঠিক আছে কিন্তু একটা শর্ত আছে, শর্ত হলো তুমি কালকে আমার দোকানে আসতে হবে। আমি বাঁচার তাগিদে কোনকিছুই চিন্তা না করেই তার কথায় সায় দিয়ে Ok লিখে এই যাত্রায় বেঁচে গেলাম৷ এরপর রিপন দোকান থেকে বের হয়ে চলে যায়৷ আমার মধ্যে সজীবতা ফিরে আসে৷ তবে এতোটাই ভয় পেয়েছি এটা বলে বুঝানো যাবেনা। ভয় পাওয়ার কারণ হল সেটেলার বাঙ্গালীদের তো কোনো কমনসেন্স নেই, কখন কী বলে পেলে বা করে পেলে। এই ভয়টাই আমার মনে বেশি কাজ করেছিল। যাক মোবাইলের রিচার্জ কার্ড নিয়ে মামা ও বিভাসসহ ঘরে ফিরে আসি৷ ঘরে এসে চিন্তায় ও নানান প্রশ্নেই পড়ে গেলাম, রিপনের দোকানে যাব নাকি না যাব? ভয়ও কাজ করছিল। কিছুটা সময় নিয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম গেলে সঙ্গে হেমাকে নিয়ে যাব। একা যাব না একা গেলে ভয় আর সেদিনের মত ঘটনার সম্মুখীন হব। এই ভাবনা থেকে সিদ্ধান্ত নিলাম কাল সকাল ১০ করে যাব। কিন্তু হেমাকে আগে থেকে বলা হয়নি, তাই সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে হেমার ঘরে চলে গেলাম। এখন ভয় পাচ্ছি হেমাকে বলবো কি না? যদি আবার হেমা কাউকে বলে দেয়। ভাবলাম বিনয়ের সঙ্গে হেমাকে বলব, যাতে সেই কাউকে কিছু না বলে। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। হেমাকে সবারথেকে আলাদা করে ডেকে নিয়ে বিস্তারিত ঘটনা বললাম৷ হেমা রেগেই তেলেবেগুনে আগুন। সেই বলে ওঠলো “হত্তোর বাচ্চুনি সেটেলার বাঙ্গালীর চেদর লের হেয়জ!” সেই আরো বলেই সেটেলার বাঙ্গালী ছাড়া কি আর পাহাড়ি ছেলে নেই? সেটেলার বাঙ্গালীরা নাকি খুবই খারাপ, মেয়েদের ধর্ষণ করে এবং ধর্ষণ করে মেরে ফেলে। পাহাড়ি মেয়েদের লাভ জিহাদের মাধ্যমে বিবাহ করে কিছুদিন পর ছেড়ে দেয়। তখন মেয়েরা কোথাও যাবার পথ খুঁজে পায়না। হেমার এই কথা শুনে কিছুটা ভয়ও পেলাম এবং অবাক হলাম৷ ভাবলাম বাঙ্গালীরা এতো খারাপ কেন? আর হেমা এসব আমাকে বলে লাভ কী? আমি কী সেটেলার বাঙ্গালীকে ভালোবাসবো নাকী বিবাহ করব? কিন্তু আমি তো একটা ফাঁদে পড়ে গেছি এটা থেকে নিজেকে উত্তোরন তো করতেই হবে। তাই নিরাশ না হয়েই হেমার মন গলানোর জন্য এমনভাবেই কান্নার অভিনয় করলাম যাতে মন গলে যায়। একটু অভিনয়ে কাজ হয়ে গেছে। আবেগ আর কান্না দেখে হেমা নিজেই কেঁদে দিল। তাকে পটানোর পর বললাম চল রিপনের দোকানে যায়। দ্রুত হেমাকে নিয়ে রিপনের দোকানে চলে যাই। রিপন আমাদেরকে দেখে অনেক খুশি হয়। সেই ফুল দিয়ে আমাদের স্বাগত জানায়৷ আমাদের জন্য দ্রুত হরেক রকমের নাস্তার আয়োজন করে। তার আপ্যায়ন দেখে আমরা মুগ্ধ হই। বেশ করে সেই এত ভদ্র ও বিনয় তা আগে জানা ছিলনা। নারীকে সেই এত সম্মান করে এটা বিশ্বাস করা ছিল কষ্টসাধ্য। কারণ তার পূর্বের আচরণ তাকে আমার কাছে চরিত্রহীন ও অসভ্য হিসেবে দাঁড় করিয়েছে। আজকে সেই স্পেশালভাবে আমাকে একটি ফুল দিয়ে Proposal দেয়। আমি তা গ্রহণ করিনি জাতি, ধর্ম ও পার্থক্য বিবেচনা করে। আমি তাকে সাফ জানিয়ে দিই জাতি ধর্ম ছেড়ে বেজাতি বাঙ্গালী ছেলেকে গ্রহণ করতে পারব না। আমার এই কথা শুনে রিপন যেমন কষ্ট পেয়েছে তেমনি হেমাও কষ্ট পেয়েছে। হেমাও চেয়েছিলো আমি যেনো Proposal Accept করি। লক্ষণীয় বিষয়, রিপন খুবি লজ্জা পেয়েছে এবং মন খারাপ করে আনমনা হয়ে গেছে। আমরা আসার সময় সেই কিছু কসমেটিক আমাদের দু’জনকে দিল। আমি নিতে চাইনি৷ কিন্তু হেমার রিকুয়েষ্টে নিতে বাধ্যহলাম। তারপর বাসায় ফিরে এলাম।
বাসায় এসে নিজেকে অসহায় ও অপরাধী মনে হল। কারণ, রিপনের Proposal Accept করিনি। আবার তার কসমেটিক নেওয়া কী ঠিক ছিল? এসব কিছু ভাবতে লাগলাম। এভাবে দুই তিনদিন কেটে গেল। কিন্তু আমি এখন আগের মত নেই৷ প্রতিটি মূহুর্তে রিপনের কথা মনে পড়ে৷ রিপন ছেলেটি দেখতে অতটা সুন্দর নয় এবং অতটা স্মার্টও নয়। তবে চেহারাটা মায়াবী এবং চোখ দু’টি অসাধারণ। মনে হয় তার দু’টি চোখ দিয়ে সেই আমাকে যখন দেখে তখন ধর্ষণ করে আর গিলে ফেলে। চোখের সৌন্দর্যটা এই জন্য বর্ণনা করলাম, কারণ আমাদের পাহাড়ি ছেলেদের চোখ ছোটছোট ও ভাসা ভাসা হয়। দেখতে বাঙ্গালীদের চোখের মত অতটা সৌন্দর্য নয়। এখন রিপনের প্রতি আমার যে, ভালো লাগাটা কাজ করছে সেটা হচ্ছে, তার ভদ্রতা ও চোখ দু’টো। আগের মত তার প্রতি ক্ষোভ অভিমান নেই। এখন আছে শুধু তার প্রতি সহানুভূতি ও ভয়।
এই কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই সুন্দর একটা ঘুম আসল এবং রাত শেষ সকাল হল। সকালে ঘুম ভাঙলো হেমার ডাকে। হেমা এসেই রিপনের প্রশংসা করতে শুরু করল। রিপন এত ভালো ও বন্ধুসুলভ সেটা নাকি হেমাও জানত না। কিন্তু রিপনের এমন সম্মান প্রদর্শন হেমাও অবাক হয়েছিল। মূলত এই কারণে হেমা আমার সামনে রিপনের প্রশংসা করে অতিবেশি।
কয়েকদিন অতিবাহিত হওয়ার পর সিদ্ধান্ত নিলাম রিপনের দোকানে যাব। হেমাকে নিয়ে দোকানে গেলাম। আমাদেরকে দেখে যেনো রিপনের মরা প্রাণ জীবিত হল! এত খুশি সেই আমাদের দেখে হয়েছে, যেটা ভাষাই প্রকাশ করা যাবেনা। রিপন নাকি ভেবেছিল আমরা নাকি আর তার দোকানে যাব না। আমাদেরকে দেখে নাকি সেই চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। তার কাছে নাকি সব অবিশ্বাস্য! রিপন বলল, ১৪ তারিখ নাকি তার বোনদের বিয়ে, তাই অনুষ্ঠান আছে। আমরা যদি যেতে আগ্রহী হই তাহলে সেই আমাদের নিমন্ত্রণ করবেই। জিজ্ঞাসা করলাম তোমার বাসা কোথায় সে জানাল গাইবান্ধা জেলা। নামটা মনে হয় জীবনে প্রথম শুনলাম। তাই অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করছিলাম এখান থেকে কত দূর বা কত সময় লাগে? সে বলল প্রায় ১দিন সময় লাগে। বললাম এতদূর যাওয়া কোনভাবেই সম্ভব নয়। তাছাড়া বর্তমানে স্কুল খোলা আর এতদূর ঘর থেকেও যেতে দিবেনা আর ওখানে কোনো পাহাড়ি নেই। বাঙ্গালী একটা ছেলের সাথে এত দূর যাওয়া নিরাপদ নয়। কারণ বাঙ্গালী ছেলেরা নাকি মেয়েদের বিক্রি করে দেয়। এমন সব নানান চিন্তা মাথায় গুরুপাক খাচ্ছে। আমাদের কিছুটা নীরবতা দেখে রিপন বলল ভয় পেলে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। তবে আমি নিশ্চিয়তা দিয়ে বলতে পারি আমার কারণে তোমাদের ক্ষতি কোনো হবে না, তোমাদের সম্পন্ন সেফটি আমি দেব। তোমাদের মত আমারও ছোট বোন আছে আমি তোমাদের কোনো ক্ষতি হতে দেবো না। তোমরা সর্বোচ্চ দুই-তিনদিন থাকবে। তারপর চলে আসতে পারবে। যাতায়াতের সম্পন্ন খরচ আমি বহন করব। কিন্তু আমাদের কী যাওয়া সম্ভব? হেমাকে প্রশ্ন করলাম এতদূরে বাসায় কি বলে যাব? হেমা বলল তুই তোর নানুকে বল রাঙ্গামাটিতে মা-বাবাকে দেখতে যাবি। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে গাইবান্ধা যাব আর আমি ঘরে মাকে বলব রাঙ্গামাটি তোদের বাসায় বেড়াতে যাব৷
এই কথা শুনে আমি অবাক হলাম! হেমা মেয়েটার মাথায় এতসব পাকনা বুদ্ধি কীভাবে জন্মায়! এত বুদ্ধি নিয়ে সে কিভাবে থাকে? হেমার কথা মত রিপনকে যাওয়ার কিছুটা সম্মতি দিলাম। কিন্তু একটা শর্ত বেধে দিলাম। শর্তটা হল রিপনকে অবশ্যই তার পরিচয় ও বাড়ি ঠিকানা আমাদেরকে সরবরাহ করতে হবে। এই কথা আমরা মুখ থেকে বের করতে দেরি সেই সাথে সাথেই তার ভোটার আইডি কার্ড ও দোকানের ট্রেড লাইসেন্স ও ব্যাংক চেক আমাদের দিয়ে দিল।
রিপন তার পরিচয় নিশ্চিত করার কারণে তার প্রতি আমাদের বিশ্বাস স্থাপন হল। কিন্তু এখন প্রশ্ন হল নানিয়ারচর থেকে কিভাবে যাব? যদি পাহাড়ি ছেলেরা দেখে বা কেউ দেখে ফেলে তাহলে তো সর্বনাশ। হেমা বললো আমরা রিপনের সঙ্গে নানিয়ারচর থেকে একসাথে যাবনা। আমরা দু’জন বাসে বা সিএনজি যোগে চট্টগ্রাম চলে যাব। চট্টগ্রাম গিয়ে রিপনের সাথে একত্র হয়ে গাইবান্ধা যাব। যেমন ভাবনা তেমন কাজ, রিপন বললো দারুণ বুদ্ধি তো। আলোচনার এক পর্যায়ে সিদ্ধান্ত হল, যেহেতু ১৪ তারিখে তার বোনের বিবাহ তাই দু’দিন আগে ১২ তারিখ যেতেই হবে। এই কথাতে সম্মতি দিয়ে আমরা দোকান থেকে বাসায় যাব বলে বিদায় নেওয়ার সময় চট্টগ্রাম পর্যন্ত যাওয়ার অগ্রীম গাড়িভাড়া বাবদ রিপন আমাদের হাতে ৫ হাজার টাকা ধরিয়ে দিল!
ভাড়ার টাকা যেহেতু দিয়েছে এবার তো যেতেই হবে। আমরা এখন অপেক্ষা করতে লাগলাম ১২ তারিখের জন্য। কবে আসবেই ১২ তারিখ এজন্য দিন গুনতে লাগলাম। এরমধ্যে রাঙ্গামাটিতে যাব এই কথা নানুকে বলে রেখেছি। তাই আর কোনো প্রকার বাধা থাকল না। অপেক্ষার প্রহর গুনে ১২ তারিখ সকালে হেমা ও আমি সেজেগুজে নানিয়ারচর থেকে চট্টগ্রামের বাসে বাসে উঠলাম৷ চট্টগ্রাম অক্সিজেন এসে কথা অনুযায়ী দেখা পেলাম রিপনের। সে পূর্ব থেকে মাইক্রো গাড়ি প্রস্তুত করে রেখেছে। আমাদের অক্সিজেন বাস কাউন্টার থেকে রিসিভ করেই দ্রুত মাইক্রোতে উঠেন। মাইক্রোতে রিপন চেয়েছিল আমাদের সাথে বসার জন্য। কিন্তু আমি সম্মতি দিইনি৷ তাই সেই চালকের পাশের সিটে বসল। আমি ও হেমা তাদের পিছনের সিটে বসেছি। অনেক দূরের পথ পাড়ি দিয়ে রিপনদের গাইবান্ধা জেলায় পৌছালাম। গাইবান্ধা শহরটা উন্নত হলেও রিপনের এলাকাটা একদম গ্রামাঞ্চল। আমাদের জন্য এলাকাটা একদম অচিন। এলাকাটি ভয়ানক মনে হল। কিছুটা মন খারাপ হয়েছিল ওই সময়। একদম চুপচাপ থাকলাম তবে দু’জনের মন খারাপ হয়ে যায়। কারণ অচেনা বাঙ্গালী ছেলে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে আমাদের গ্রামের মেঠোপথ ধরেই। একদম গ্রাম আর গ্রাম চারপাশে সারি সারি পাঠের ক্ষেত। পুরো গ্রাম শুনশান নীরবতা। মনে হচ্ছে রিপন আমাদের ধোঁকা দিয়ে কোথাও নিয়ে যাচ্ছে। এমন চিন্তা ভাবনা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। একপ্রকার আমি তো কেঁদে দিয়েছি। আমার কান্না দেখে রিপন ভয় পেয়ে যায়৷ সেই বলে তুমি কান্না করো না। তুমি কান্না করলে মানুষ অন্য কিছু মনে করবে। মানুষ ভাববে আমি তোমাদের অপহরণ বা জোরপূর্বক নিয়ে যাচ্ছি। আমি গণধোলাই খাব। এবং সব এলাকায় কিছু খারাপ লোক থাকে তারা তোমাদের ক্ষতি করবে। তাই কান্না না করে দ্রুত বাড়ি চলো। আমি নানিয়ারচর লাখ লাখ টাকার ব্যবসা-বাণিজ্য রেখেই তো এসেছি। এমনকি তোমাদের ঘরেই তো আমার পরিচয়পত্র, ট্রেডলাইসেন্স ও ব্যাংক চেক বই জমা আছে। সেসূত্র ধরে তো তোমাদের এবং আমাকে খুঁজে বের করা খুবি সহজ পথ। আমি তোমাদের ক্ষতি করে কী বাঁচতে পারব? এই কথা স্মরণ করে দেওয়াই কিছুটা আশ্বস্ত হলাম৷ নীরব হয়ে হাঁটা শুরু করলাম অচেনা মেঠোপথ ধরে। কিছুপথ যেতেই রিপনের বাড়ি আসল। ওখানকার বাঙ্গালীগুলো আমাদেরকে দেখে চায়নিজ মেয়ে, জাপানি মেয়ে, বিদেশি মেয়ে বলতে লাগল!!! বিষয়টি কোনভাবেই আমার কাছে ভালো লাগল না। তারা যেভাবে আমাদের দিকে তাকাচ্ছে মনে হল আমরা ভিনগ্রহের বাসিন্দা!!! যাক এসব পরোয়া না করে দ্রুত চলতে লাগলাম রিপনের ঘরের আঙিনার দিকে।
রিপনের ঘরের আঙ্গিনা বোনের বিবাহ ও আমরা আসার কারণে নতুনভাবে সেজেছে৷ ঘরের ও গ্রামের আশেপাশের নারী-পুরুষ দেখে মনে হল উপস্থিতির সংখ্যা ২০০ জন হবে। আমাকে ও হেমাকে দেখে সবাই উচ্চঅভ্যর্থনা জানাল। একদম উৎসবের আমেজের পরিবেশ৷ কেন্দ্র বিন্দুতে শুধুই আমরা। কারণ এ অঞ্চলের মানুষগুলো কখনো চাকমা দেখেনি। তাই তাদের উৎসাহ ও উদ্দীপনা আমাদের নিয়ে। কিন্তু আমরা আঙ্গিনার শত আয়োজন রেখেই ক্লান্ত শরীরে সিকিউরিটি সম্পূর্ণ একটি নিরিবিলি রুমে ঢুকে গেলাম। সে রুমে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে বিশ্রাম নিলাম। বিশ্রাম শেষে দুপুরে খাওয়ার জন্য ডাক পড়ল। রিপন ১৮/১৯ বছর বয়সী দু’টা মেয়ে নিয়ে এসে অট্টহাসি হেসেই বলল এখনো ভয় করছে তোমাদের? হেমা বলছে, ভয় করছে না। তবে তোমাদের বাঙ্গালীদের স্বভাব চরিত্রটা তো অতো ভালো নয়। নারী ধর্ষক বেশি। মানুষ হত্যা ও অন্যায়-অবিচার বেশি করে। তাই সবসময় সর্তক থাকতে হয়। কিন্তু তোমার প্রতি আমাদের বিশ্বাস আছে কারণ এই পর্যন্ত তোমার সবকিছু ঠিকঠাক আছে৷ আমাদেরকে যে রুমটা দিয়েছ তা এককথায় চমৎকার এবং সিকিউরিটি সম্পূর্ণ মনে হল। আমাদের মুখ থেকে এ কথা শুনে রিপন ভিষণ খুশি হয়েছে। মনে হচ্ছে সে মহাকাশ জয় করে এসেছে! রিপন সাথে করে নিয়ে আসা মেয়ে দু’টোকে আমাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল ওদের একজনের নাম মিতালী চাকমা, অন্যজনের নাম হেমা চাকমা। কোনো পুরুষ মানুষ বা অন্য কেউ যেনো তাদের রুমে আসতে না পারে এবং কোনো সমস্যা যেনো না হয়। এজন্য তোমরা দু’জন তাদের গার্ড হিসেবে সার্বক্ষণিক থাকবে৷ এদের কিছু হলে তোমাদের নিস্তার হবে না। মেহমানদের প্রয়োজনীয় যা কিছুই লাগে তা সাথে সাথেই দিবে এবং রুম থেকে বের হলে এদের সাথে সাথেই লেগে থাকবে৷ এই বলে আমাদেরকে ডাইনিং রুমে নিয়ে গেল। ডাইনিং রুমে যারা আপ্যায়নের কাজে নিয়োজিত ছিল তাদেরকে লক্ষ্য করে বলল ১০ মিনিট পরে টেবিলে খাবার নিয়ে আসার জন্য। এই ১০ মিনিট পরিচয় পর্ব সেরে নিবে। এই ফাঁকে একটা তথ্য দিয়ে রাখি রিপন সম্পর্কে ও তার পরিবার সম্পর্কে। রিপন’রা গ্রামে বসবাস করলেও তারা ওই গ্রামের প্রভাবশালী। একসময় তার বাবা ছিলেন নাকি গাইবান্ধা জেলার প্রভাবশালী নেতা। এলাকার সামাজিক বিচার-আচারসহ প্রায় সবকিছুতে রিপনদের পরিবারের আধিপত্য বেশি। বলা যাই ওই এলাকার সবকিছুর নিয়ন্ত্রক তারা। এলাকার অন্যান্য ঘরগুলোর মধ্যে রিপনের ঘরটি সবচেয়ে আলাদা। ঘরকে নান্দনিক ভাবে সাজিয়েছে। কথায় আছে না বড় লোকের বিরাট কারবার। তারাও তাই।
রিপনরা ৩ ভাই ও ১ বোন। রিপন সবার বড়, বোন দ্বিতীয়, আর দু’ই ভাই ছোট। পরিবারে রয়েছে- মা-বাবা ও তারা ৪ ভাই বোন। রিপন ব্যবসায়িক কারণে থাকে রাঙ্গামাটি নানিয়ারচর৷ তার মামা সরকারি চাকরিজীবী। একসময় নানিয়ারচর উপজেলা সমাজ সেবা অফিসে চাকরি করতেন। মামার সূত্র ধরে তার মূলত নানিয়ারচর যাওয়া। এবং অদূরে দোকান করা।
রিপনদের ডাইনিং রুমটা বিশাল৷ এককথায় সভা-সেমিনার রুমের মত। চারপাশে ঘুরানো ডাইনিং। যারা ডাইনিং এ রয়েছে তারা সবাই রিপনদের পরিবারের সদস্য এবং ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজন। তাই সবার সাথে সবার পরিচয় টা হওয়া জরুরি৷ রিপন প্রথমে রিপনের মায়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তবে আমার কাছে কেন জানি মনে হল রিপনের মা তেমন একটা খোলা মনের না। যে কোনো কাউকে সহজেই মেনে নিতে তার কষ্ট হয়। তাই দু-চারটা কথা বলে শেষ করলেন। কিন্তু তার ভাই বোন খুবি প্রাণবন্ত, আড্ডাবাজ আর তাদের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজন গুলোও খুবই আন্তরিক। সবার সাথে পরিচয় শেষ করে খেতে বসলাম। বিভিন্ন ধরনের তরকারি আইটেম ছিল৷ যা আমরা পূর্বে দেখিনি। তারা আপ্যায়নে ঘাটতি রাখেনি।
রাত শেষ হলে রিপনের বোন সামিয়ার বিবাহ। তাই সবাই ওদিকে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। রিপনের বোন HSC পাশ & Degree 2 Year Study চলমান। যে ছেলের সাথে বিয়ে হচ্ছে সেই নাকি পড়াশোনায় ঘোড়ার ডিম। এই বিয়েটা নাকি শুধু রিপনের খালা ও তার বাবার চাপের কারণে হচ্ছে। না হয় এমন অশিক্ষিত ছেলের সঙ্গে বিবাহ হতই না। পরিবারের বেশিরভাগেরই সদস্য এই বিবাহতে অমত। তারপরও ঠিকঠাক মত বিয়ের আয়োজনটা হল। জামাই পক্ষ এসে খেয়ে গেল আনন্দ ফূর্তি করল। এদিকে আমরাও জামাইয়ের বাড়িতে গেলাম, কিন্তু জামাই ভালো না হওয়ার কারণে মেয়ে পক্ষকে তেমন গুরুত্ব দেয়নি। মেয়েদের পক্ষের অতিথিরা কে ভাত খেলো আর কে খেলনা তার কোনো খবরই তারা রাখেনি। বুঝা গেলা জমাই খুবই বেয়াদব প্রকৃতির এবং তার মা-বাবা ও ভাইবোন অহংকারী ও অশিক্ষিত। সঠিক শিক্ষা নেই। শুধু মাত্র এখানে রিপনের খালা ও বাবার চাপের কারণে বিবাহটা হচ্ছে। এলাকাবাসীসহ সবাই বলাবলি করছে ছেলে পক্ষ নাকি অমানুষ। এত সুন্দর ও ভদ্র শিক্ষিত মেয়েটাকে অমানুষের হাতে তুলে দিল। মেয়েটি নির্যাতনের শিকার হবে। যাক এই পর্ব শেষ করি এটা তাদের পারিবারিক বিষয়।
রিপনের বোনের বিবাহ শেষ করার পর তাদের ঘরের অধিকাংশ অতিথি চলে গেছে। বেশ করে যে, প্রচন্ড ভিড় ঘরে ছিল সেটা এখন আগের মতই নেই। পরিবেশটা শান্ত। এখন রিপন ও তার পরিবারের সদস্যরা আমাদের আপ্যায়নে ব্যস্ত হয়ে গেল। মনে হচ্ছে আমরা তাদের বিশেষ কেউ। তাদের গ্রাম ও বিভিন্ন গ্রাম থেকে প্রতিদিনি মানুষের ঢল নামে আমাদের দেখতে। আমরা ৩/৪ দিনের জন্য গিয়ে প্রায় ৮ দিন ছিলাম। এই ৮দিনে অনেক মানুষের সাথে পরিচয় হল। বাঙ্গালীদের মধ্যে যে খারাপ আছে সেটার প্রমাণ আমরা পেলাম। বস্তুতঃ অধিকাংশ বাঙ্গালীরা নারী লোভী এইটা একদম সত্য নয়। পেছন থেকে নারীদের প্রতি বাজে মন্তব্য ও খারাপ চিন্তাধারায় বাঙ্গালীরা সবসময় বিভোর থাকে সেটা অবশ্যই ঠিক। তা বাঙ্গালী সমাজে অবস্থান করে বুঝতে পেরেছি। এইখানে সবচেয়ে বড় সত্য হলো বাঙ্গালীদের মধ্যে সবাই খারাপ নয়। আমাদের পাহাড়ি সমাজে একটা প্রবাদ বা বার্তা সময় থাকে বাঙ্গালীদের মা দিলে বাপ হয়না, বোন দিলে দুলাভাই হয়না। আসলে এটা ডাহামিথ্যা এবং একটা অপপ্রচার বাঙ্গালীদের প্রতি। আমি এই গ্রামে এসে দেখেছি বাঙ্গালীদের মধ্যে অনেকেই আছেন খুবই ভালো। তারা নারীদের সম্মান করে এবং ধর্মের প্রতি ও সৃষ্টিকর্তার প্রতি বিশ্বাসী। তারা অন্যায় কাজ করে না, নারী অতিথিদের প্রতি অনেক দ্বায়িত্ববান ও কর্তব্যবান। গ্রামের মানুষ অল্প সময়েই আমাদের সঙ্গে মিশে গেছে।
গ্রামের বাঙ্গালী যুবতী মেয়েগুলো খুবি পর্দাশীল। চলাফেরায় খুবি সতর্কতা অবলম্বন করে। প্রকাশ্যে পুরুষদের সাথে নারীরা চলাফেরা করে না৷ কিছু খারাপ বাঙ্গালীর কারণে আমরা বাহির থেকে শুনি বাঙ্গালীরা অনেক খারাপ, মা-বোন সবাইকে ধর্ষণ করে। আসলে এসব ভুলভাল তথ্য। এর বিন্দুমাত্র সত্যতা নেই৷ সব অহেতুক কথাবার্তা৷ বাস্তবিক অর্থে বাঙ্গালী সমাজ ব্যবস্থা ও ধর্ম ব্যবস্থা খুবই কঠিন অনুশাসন, নারী-পুরুষ অবাধে চলাফেরা করতে পারেনা এবং অশালীন কাজের প্রতি কঠোর। যা বাঙ্গালী সমাজে না থাকলে জানতে পারতাম না। যদি গাইবান্ধা না যেতাম তাহলে বাঙ্গালীদের প্রতি আমাদের একটা ভুল ধারণা থেকে যেত। বাস্তবতা হল বাঙ্গালীরা আমাদের মত রক্ত মাংসে গড়া মানুষ। তারা অনেক পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও হালাল পথের অনুসারী। বাঙ্গালী নারীদের রান্না-বান্না ও সাংসারিক কাজ খুবি গোছানো এবং পরিচ্ছন্ন। সবসময় পাক-পবিত্রতা রক্ষাকরে চলে। পুরুষরাও তার ব্যতিক্রম নয়। তবে ভালো খারাপ সব জাতিতে থাকে৷ আমাদের পাহাড়িদের মধ্যেও সবাই সাধু না। হয়তো কোন জাতিতে খারাপ বেশি বা কোন জাতিতে খারাপ কম। পার্থক্য শুধু এতোটুকুই। ৮দিন থাকার পর আমরা ২১ তারিখ গাইবান্ধা থেকে চলে আসি। চলে আসার সময় শতশত নারী-পুরুষ ও যুবক-যুবতী আমাদের বিদায় জানায়। বিদায় বেলায় তাদের যেমন মন খারাপ হয়েছে ঠিক আমাদেরও মন খারাপ হয়েছে৷ একদম মনটা খারাপ করে আসতে হয়েছে। ওদের ছেড়ে আসতে ইচ্ছে করছিল না। বেশ করে আমাদের সাথে কম কথা বলা রিপনের মা নিজেই কেঁদেছেন আসার সময় জড়িয়ে ধরে। বলেছে আমার মতো মেয়েকে পুত্রবধূ হিসেবে সেই বরণ করতে প্রস্তুত। তবুও পড়াশোনার কারণে এবং বাসায় জেনে যাবে সেই ভয়ে চলে আসতে বাধ্যহলাম। গাড়ি করে আসার সময় রিপন আমার সাথে বসার চেষ্টা করে কিন্তু আমার চোখ রাঙানি দেখে সেই চালকের সিটে চলে যায়।
নানিয়ারচর আসার পর ভয়ে ছিলাম নানু বা মামা কিছু জানল কীনা? আমি বাড়িতে যাব বলেছি। কিন্তু বাড়িতে যায়নি কেউ কিছু বলে দিয়েছে কীনা এমন চিন্তা ঘুরপাক। নাকি মা আসছে নানুর বাড়িতে এই ভয় কাজ করেছিল বেশি। এরপর নানুর কাছে গিয়ে দেখি নানু স্বাভাবিক। নানু হেসে হেসেই বলে ৩/৪ দিনের জন্য রাঙ্গামাটি বাড়িতে গিয়ে অনেকদিন থেকে আসলি মিতালী। আমিও হেসে উত্তর দিলাম হ্যাঁ নানু বলে৷ সবকিছু ঠিক থাকায় মনে প্রশান্তি আসল। বেশ কয়েকদিন ধরে স্কুলে যায়নি তাই পড়াশোনা ফাঁকি দেওয়া বাদ দিয়ে নিয়মিত স্কুলে যেতে শুরু করলাম। পড়াশোনার প্রতি মনোযোগ দিলাম। কিছুদিন অতিবাহিত হওয়ার পর রিপনের সাথে দেখা হয়। এরপর থেকে আমাদের নিয়মিত দেখাও হচ্ছে। এসব কারণে কিন্তু আমার পড়াশোনা এবং সবকিছু আগের মত যাচ্ছে না। কিছুতেই ভালো লাগেনা। শুধু আমার রিপনের কথা মনে পড়ে। সারাটা সময় তাকে মিস করি। জানি না এটা তার প্রতি ভালোবাসা ছিল কীনা? কেন জানি আমি দিনদিন তার প্রতি দূর্বল হয়ে যাচ্ছি৷ আমি খেতে পারিনা। সবসময় শরীর দূর্বল দূর্বল লাগে, নিজেকে অসহায় মনে হয়। সামনে পরীক্ষা। সবকিছুতে অলস লাগে একটুও ঘুম হয়না আর পড়াশোনার প্রতি মনযোগ বসেনা। তাই রিপনের সাথে যোগাযোগে দূরত্ব বাড়ালাম।
এদিকে হেমা নাকি রিপনের দোকানে গেছে। রিপন তার মাধ্যমে খবর দিল ইসলামপুর গিয়ে দেখা করার জন্য৷ ওদিকে নাকি বাঙ্গালীরা বেশি তাই দেখা করলে সমস্যা হবে না। কিন্তু আমার ভয়ে করে যদি কেউ দেখে ফেলে। তবুও রিপনের কথা রাখতে গিয়ে ইসলামপুর একটি বাঙ্গালী ঘরে আমরা দেখা করি। রিপন হাঁটু গেড়ে বসে ফুল নিয়ে Proposal দেয়। আমি যাতে না করি সেজন্য সেই হেমাকেও রাজি করিয়েছে। কিছুতেই সেই আমার থেকে না শব্দ শুনতে চায়না৷ আমি না শব্দ করলে নাকি সেই মরে যাবে৷ চাকু একটা নিয়েছে হাত কাটার জন্য। কী করব? আমার ধর্ম ও তার ধর্ম আলাদা। সমাজ কী এসব মেনে নিবে? আমি কী তাকে বিবাহ করতে পারব? আমাদের সমাজ ব্যবস্থা বাঙ্গালীদের সঙ্গে বিবাহ হলে অনেক কঠিন শাস্তির বিধান। তাছাড়া আমাকে নানিয়ারচর কলেজের পিসিপি’র সভাপতি বিভাস চাকমা পছন্দ করে। তাকে আমি পছন্দ করিনা সেই বলেছে “আমি যদি অন্য কাউকে বিবাহ করি তাহলে নাকি আমার স্বামী ও আমাকে সে মেরে ফেলবে।” বিভাস চাকমা আবার আঞ্চলিক দলের এক নেতার ছেলে৷ এলাকায় তাদের প্রচুর দাপট। আমি SSC পাশ করলে আমাকে জোর করে বিবাহ করবে। আমি বাঙ্গালীকে ভালোবাসি এটা যদি বিভাস শুনে আমার অবস্থা খারাপ হবে। এটা চিন্তা করে আমি খুবি টেনশনে পড়ে গেলাম। কিন্তু সামনের পরিস্থিতি অথাৎ রিপনের কৌশলের কাছে আমি হেরে গিয়ে তার Proposal Accept করি। সেদিন অশ্রু টলটল করিয়ে রিপন আমাকে তার প্রেমের সাগরে ভাসায়। কিন্তু রিপন শর্ত দেয় তার সাথে প্রতিদিন দেখা করতে না পারলেও অন্তত যাতেই দুই তিন দিন পরপর দেখা করি। সামনে পরীক্ষা যার কারণেই আমি রাজি হইনি। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার আগে আমি আর হেমা চলে আসি বাড়িতে।
এরপর আমার SSC পরীক্ষা শুরু হয়ে গেল। আমি পরীক্ষা দিলাম৷ পাশ করলাম ঠিক কিন্তু রেজাল্ট তেমন ভালো হয়নি৷ তাই বকাঝকা খেয়েছি পরিবার থেকে। তাই ২/৩ মাস রিপনের সঙ্গে তেমন যোগাযোগ করিনি। আর নিজেকে শোধরাবার চেষ্টায় রিপনের সঙ্গে যোগাযোগ কম রেখেছি। কিন্তু আমার মন তো সবমসময় রিপনের দিকে। নিয়মিত দেখা করতে না পারার কারণে রিপন খুবি রাগ। তাই দেখা করলাম। রিপন বলল, ২৮ তারিখ নাকি তার জন্মদিন। ইসলামপুর একটি বাসায় তার জন্মদিন পালন হবে রাত ৯টায়। আমরা থাকতে হবে। কিন্তু রাতে আমরা কীভাবে থাকব? রিপন বলল যেভাবে হোক থাকতেই হবে। জন্মদিনে আসার জন্য আমি নানুকে বললাম আজ রাতে হেমাদের ঘরে থাকব। নানু বললো আচ্ছা। হেমাও বললো আজ রাতে আমাদের ঘরে থাকবে৷ এই বলে বিকাল ৬টায় দু’জন দু’জনের ঘর থেকে বের হয়ে বাজার থেকে কিছু গিফট নিয়ে ইসলামপুর চলে আসি। ইসলামপুর এসে দেখি রিপন জন্মদিন পালনের জন্য বিশাল আয়োজন করে আছে। আমরা গল্প করতে করতে রাত প্রায় নয়টা হল। ঠিক সময় কেক কেটে তাকে উইশ করলাম। রিপন যেভাবে আমাদের আপ্যায়ন করল মনে হচ্ছে জন্মদিনটা আমাদেরই!
দিন যত যাচ্ছে ততই আমি রিপনের প্রতি দূর্বল হয়ে পড়ি। সারাদিন শুধু রিপনকে ভাবি। আমি তাকে সারাজীবন আপন করে নেওয়ার জন্য সবসময় সৃষ্টি কর্তার নিকট প্রার্থনা করেছি। এইভাবে আমাদের ভালোবাসা অনেক গভীরেই চলে যায়। একটা সময় রিপনের সঙ্গে আমার সম্পর্কের কথা পিসিপি’র বিভাস চাকমা জেনেই যায়। আমাকে তুলে নিয়ে বিভাস চাকমা নির্যাতন ও অত্যাচার করে। পরবর্তীতে আমাকে ঘরবন্দী করা হয়। আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে আমাকে বিভাস চাকমা বিয়ে করে। বিভাস চাকমা হচ্ছে অকর্মা, মদ, গাঁজাখোর ও উশৃংখল প্রকৃতির। সে সবসময় আমাকে মারধর করে। আমার জীবনটা একদম অসুখী। আমি দাম্পত্য জীবনে সম্পূর্ণভাবে অসুখী। আমি সংসার জীবনে এতটাই অসুখী সেটা লেখার ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব। আমি এখনো প্রতিটি মূহুর্তে রিপনকে মিস করি। আমার সাথে যতদিন রিপনের সম্পর্ক ছিল ততদিন পৃথিবীর সমস্ত সুখ আমার ছিল। রিপন এমন বাঙ্গালী যাকে আমি পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি আপন ও বিশ্বাসী মনে করি। যে আমার জন্য সারাটি জীবন চিরকুমার রয়ে গেলো। আমাকে আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে একটা অসভ্যের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে৷ যেকারণে আজো বিছানায় আমার চোখের জল পড়ে। আমার হৃদয়ের পরতে পরতে রিপন। আমি চোখ দু’টি বন্ধ করলে শুধু রিপনকে দেখি। রিপন যেভাবে আমাকে শিহরিত করেছে সেভাবেই আমি আমার স্বামী কর্তৃক শিহরিত হয়নি। আমি এখনো রিপনের স্পর্শকে অনুভব করি। জানি না ভালোবাসা পাপ কীনা তবে রিপন আমার জন্য পাপ নয়। আমি এক মহাকাল তাকে ভালোবেসে যাব। আমার আর রিপনের দেখা হয়তো একদিন স্বর্গে হবে।
আমি মনে করি প্রতিটি পাহাড়ি মেয়ের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা থাকা উচিত।