সিএইচটি হেডম্যান নেটওয়ার্ক গিলে খাচ্ছে বাঙ্গালীদের।

0

হেডম্যান এর দায়িত্ব ও কর্তব্য-
সার্কেল চীফ জেলার প্রশাসন সংক্রান্ত বিষয়ে ডেপুটি কমিশনারকে পরামর্শ দিয়ে থাকেন। তিনি একটি উপদেষ্টা কাউন্সিল গঠন করেন এবং কাউন্সিলের সুপারিশ অনুসারে তিনি ডেপুটি কমিশনারকে পরামর্শ দিয়ে থাকেন (বিধ নং-৩৯)।
তিনি মৌজা হেডম্যান নিয়োগ ও অপসারণে ডেপুটি কমিশনারকে পরামর্শ দিয়ে থাকেন, যদিও ডেপুটি কমিশনার তাঁর পরামর্শ মেনে নিতে বাধ্য নন। তবে তাঁর পরামর্শ সর্বোচ্চ বিবেচনার দাবি রাখে (বিধি নং ৪৮)।

মৌজা হেডম্যান কর্তৃক খাজনা আদায় ও এলাকার শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখাসহ অপরাধ দমনে তাদের প্রতি আদেশ, নির্দেশ ও পরামর্শ প্রদান তাঁর দায়িত্বের আওতাধীন (বিধি নং-৩৮)।

মৌজা হেডম্যান কর্তৃক আদায়কৃত খাজনা সরকারি কোষাগারে জমাদান নিশ্চিত করা তাঁর অন্যতম প্রধান দায়িত্ব (বিধি নং-৩৮)।

এলাকার জনগণের মধ্যে শান্তি- শৃঙ্খলা ও স্বাস্থ্য সচেতনতা সৃষ্টি তার একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব (বিধি নং-৩৮)।

ডেপুটি কমিশনারের আদালতে বিচারাধীন মামলায় প্রথাগত আইন সামাজিক রীতিনীতির কোনো ব্যাখ্যার প্রয়োজনে ডেপুটি কমিশনার সংশ্লিষ্ট সার্কেল চীফ এর নিকট মতামত আহবান করলে তিনি তাঁর ব্যাখ্যা ও মতামত দিয়ে থাকেন (বিধি নং-৪০)।

তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন অনুযায়ী প্রাপ্তক্ষমতা-
১৯৮৯ সানের তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনে (১৯, ২০ ও ২১ নং আইন) প্রদত্ত ক্ষমতাবলে সংশ্লিষ্ট সার্কেল চীফ পরিষদের যে কোন সভায় যোগদান ও সভার আলোচ্য বিষয়ে মতামত ব্যক্ত করতে পারবেন- (ধারা নং-২৬)।

মৌজা গঠন ও হেডম্যান নিয়োগ প্রথা-

১৮৯২ সনের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধির ৪নং বিধিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের ৩৩টি তালুককে ১.৫ থেকে ২০ বর্গমাইল এলাকা নিয়ে মৌজায় বিভক্ত করার ব্যবস্থা রাখা হয়। এই বিধি মোতাবেক মৌজা ব্যবস্থায় উদ্ভব ঘটে। ১৯০০ সনের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধির (হিল ট্রাক্টস ম্যানুয়েল) ৩৭ নং বিধিতে তিনজন সার্কেল চীফ ৩টি সার্কেলকে মৌজায় বিভক্ত করার পুনঃবিধান করা হয়। সেই একই বিধিতে প্রত্যেক মৌজায় ১ জন করে মৌজা হেডম্যান নিয়োগের বিধান রাখা হয়। তিন পার্বত্য জেলার তিনটি সার্কেল বর্তমানে ৩৯০ টি মৌজায় বিভক্ত।

ব্রিটিশ প্রণীত পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি (হিলট্র্যাক্স ম্যানুয়েল ১৯০০) প্রথার অন্তর্ভুক্ত তিনটি সার্কেল। জেলা প্রশাসক সংশ্লিষ্ট সার্কেল চীফের সুপারিশক্রমে হেডম্যান নিয়োগ করেন৷ জেলা প্রশাসক সার্কেল চীপ এর সুপারিশে হেডম্যানকে নিয়োগ দেন। মূলত সার্কেল চীফ এবং হেডম্যানরা জেলা প্রশাসকের কর্মচারী। দেশের প্রচলিত ভূমি আইনের আওতায় তসিলদারের যে কাজগুলো রয়েছে সে কাজ বা তার চেয়ে অধিক কাজ পার্বত্য জেলার হেডম্যানগণ করে থাকেন। তারা ভূমির খাজনা আদায় করেন এবং ভূমির বিভিন্ন বিষয়ে কাজ করেন। এই অসাংবিধানিক সুযোগ কাজে লাগিয়ে ঘুস বাণিজ্য করেন হেডম্যানরা। কিন্তু এর হয়রানির হচ্ছে বাঙ্গালীরা। এই পার্বত্য শাসন বিধির হেডম্যান প্রথা বাঙ্গালীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়। অনেক সময় ক্ষমতার দাপটে হেডম্যানরা বাঙ্গালীদের থেকে ভূমির খাজনা গ্রহণ করেন না এমনকি বিভিন্ন প্রয়োজনে হেডম্যান প্রতিবেদনও দেননা৷ যারা দালালদের মাধ্যমে মোটা অংকের টাকা দিতে পারেন তারা পেয়ে থাকে হেডম্যান প্রতিবেদন। বাকীরা বৈষম্য ও হয়রানির শিকার হয়। খাজনা পরিশোধে ব্যর্থ হলে ভূমির মালিকানা নিয়ে আইনী জটিলতা তৈরি হতে পারে। পার্বত্য চট্টগ্রামে অনেক মৌজাতে হেডম্যান অসাংবিধানিক প্রথার বাহানা দিয়ে বাঙ্গালীদের থেকে খাজনা গ্রহণ করেন না।

সিএইচটি হেডম্যান নেটওয়ার্ক সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণকে দেশের প্রচলিত আইন ও সংবিধান থেকে দূরে রাখছে। এই হেডম্যান নেটওয়ার্ক এর রয়েছে বিশাল ক্ষমতা এবং দাপট। পাহাড়ে তাদের রাজস্ব কায়েম চলে। দেশি-বিদেশি এনজিও, মিশনারী ও দাতাসংস্থা এবং স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান গুলো তাদের অর্থের মূল জোগানদাতা। পাহাড়ের হেডম্যান এবং কার্বারিরা রাজা বাহাদুরের মত আচরণ করে। তারা মনে করে পাহাড়ের মানুষ তাদের প্রজা বা দাস! মূলত এই হেডম্যানরা জেলা প্রশাসকদের কর্মচারী।

খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার মাটিরাঙ্গা উপজেলার বেলছড়ি মৌজার হেডম্যান শুভ রঞ্জন রোয়াজার বিরুদ্ধে ঘুস লেনদেনের অভিযোগ উঠেছে। জমির রেকর্ড সংশোধন, খাজনা আদায় ও অন্যান্য ভূমি সংক্রান্ত সেবার ঘুস না দিলে তিনি প্রতিবেদন দেন না বলে অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীরা। অবৈধ আর্থিক লেনদেন করতে হয় সেবাগ্রহীতাকে। সহকর্মীদের থেকেও ঘুস আদায় করেন তিনি। এই নিয়ে ৮ ডিসেম্বর যুগান্তর পত্রিকায় একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। এ সংক্রান্ত একটি অডিও ও ভিডিও ক্লিপ এসেছে খাগড়াছড়ি জেলার যুগান্তর পত্রিকার প্রতিবেদকের হাতে। অডিও ক্লিপে শোনা গেছে, ভুক্তভোগী এক ব্যক্তি নামজারির পরিপ্রেক্ষিতে রেকর্ড সংশোধনের জন্য হেডম্যানের নিকট গেলে তিনি তার কাছে রশিদ সংগ্রহ ও অন্যান্য খরচের কথা উল্লেখ করে ঘুস দাবি করেন এবং অর্থের পরিমাণ নিয়ে দর কষাকষি করেন। এছাড়া অন্য একটি ভিডিও ক্লিপে হেডম্যান শুভ রঞ্জন রোয়াজাকে ভুক্তভোগী ব্যক্তির কাছ থেকে ঘুস নিয়ে টাকা গুনতে দেখা যায়। আরেকজনকে বলতে শোনা যায়, ভূমি অফিসে চাকরি করা স্বত্বেও নিজ নামজারির জন্য তার বাড়ি থেকে ঘুস নিয়ে আসেন হেডম্যান। এ সময় বিষয়টি স্বীকারও করেন হেডম্যান শুভ রঞ্জন রোয়াজা।

ভুক্তভোগী মো. আসমাউল হোসেন জানান, ‘আমি একটা হেডম্যান প্রতিবেদনের জন্য শুভ রঞ্জন রোয়াজার কাছে গেলে তিনি আমার কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা দাবি করেন। আমি প্রথমে ৫ হাজার টাকা দেই বাকি ৫ হাজার টাকা দিতে দেরি হওয়ায় তিনি আমার কাগজপত্র রেখে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। পরে আরও ৫ হাজারসহ মোট ১০ হাজার টাকা দিয়ে হেডম্যান প্রতিবেদন পাই। আবার নুটিং শেষে খাজনা দাখিলা আনতে গেলে হেডম্যান আরও ২ হাজার টাকা ঢায়। টাকা না দিলে তারা কোন কাগজ দিতে পারবে না বলে জানিয়ে দেয়।’ মাটিরাঙ্গা ভূমি অফিসের এক কর্মকর্তা মো. সালাহউদ্দিন বলেন, ‘প্রতিবেদনের জন্য আমি হেডম্যানের কাছে গেলে তিনি ১০ হাজার টাকা দিতে বলেন। আমি টাকা কেন দেব বললে, আমাকে বলেন যে ঘর থেকে বের করে দেয়। তবে অভিযোগ অস্বীকার করে হেডম্যান শুভ রঞ্জন রোয়াজার বলেন, আমি প্রতিবেদন নেওয়ার জন্য কারও কাছ থেকে কোন ধরনের অর্থ লেনদেন করিনি। খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক মো. সহিদুজ্জামান বলেন, ‘হেডম্যানের অবৈধভাবে অর্থ লেনদেনের মৌখিক অভিযোগ পেয়েছি। তদন্ত সাপেক্ষে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’

পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রায় মৌজাতে হেডম্যানের ঘুস বাণিজ্যের শিকার হয় বাঙ্গালীরা। ভূমি কেনা-বেচা ও অন্যান্য কাজে হেডম্যান প্রতিবেদন পেতে বাঙ্গালীদের মোটা অংকের ঘুস দিতে হয় মৌজা হেডম্যানকে। এই ঘুস বাণিজ্য প্রকাশ্যে-গোপনে চললেও জেলা প্রশাসকদের এই নিয়ে ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না। যার কারণে হেডম্যানরা বেপরোয়াভাবে ঘুস বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়ছে। এর শিকার হচ্ছে বাঙ্গালীরা। হেডম্যান প্রথা অসাংবিধানিক। এটি চলছে পার্বত্য শাসন বিধি ও ১৯৮৯ সানের তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনে (১৯, ২০ ও ২১ নং আইন) প্রদত্ত ক্ষমতাবলে এবং পার্বত্য চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়েই৷

আগের পোস্টমিজোরামের ভোট, বাংলাদেশে সংসদ নির্বাচন ও পার্বত্য চট্টগ্রাম-ড. মাহফুজ পারভেজ।
পরের পোস্টপার্বত্য বাঙ্গালীদের চরম দুঃখদুর্দশা কবে গোছবে?

রিপ্লাই দিন

আপনার কমেন্ট লিখুন
আপনার নাম লিখুন