লেখক: আল শাহরিয়ার রোকন, মানবাধিকার কর্মী
তীব্র তাপদাহে জুমের আগুনে জ্বলছে বিস্তীর্ণ পাহাড় প্রকৃতি, ধ্বংসের মুখে বনাঞ্চল, আশ্রয়স্থল হারাচ্ছে বন্যপ্রাণী; এর ফলে পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট হচ্ছে।
পাহাড় বা প্রকৃতি ও পরিবেশ আমাদের জীবন ধারণের জন্য অপরিহার্য। প্রকৃতিকে আশ্রয় করেই সভ্যতার সূচনা হয়েছে এবং বিকাশ লাভ করছে। গাছপালা বা বৃক্ষরাজির সঙ্গে জীবশ্রেণির সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। বন্যপ্রাণী, কীটপতঙ্গ তথা প্রাণীর অস্তিত্ব বজায় রাখতে বৃক্ষরাজি মুখ্য ভূমিকা পালন করে। পাহাড় প্রকৃতি কিংবা পরিবেশের জীব ও জড় উপাদান যদি মানব সৃষ্ট আগুন থেকে ধ্বংস হয়ে যায় তাহলে পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব পড়াই অবধারিত। পার্বত্য চট্টগ্রামে জুমের আগুনের বিরূপ প্রভাবে পাহাড় ধস বাড়ছে, সেসাথে জীববৈচিত্র্য, বন্যপ্রাণী ও পাহাড়ি গাছগাছালি বিলুপ্তির পথে। বিষয়টির উপর পরিবেশবাদীদের সজাগ দৃষ্টি রাখা উচিত। পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম চাষাবাদের নামে তীব্র তাপদাহের মধ্যে জুমে আগুন দিয়ে পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট করা অনুচিত।
বর্তমানে সারাদেশের ন্যায় পাহাড়েও তীব্র তাপদাহে বিপর্যস্ত বয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টি নেই, শুষ্ক মৌসুম। অনাবৃষ্টি ও খরার কারণে পাহাড় হাহাকার। এসময় জুমে দেওয়া আগুন দাবানলের মত ছড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা। এমন তাপদাহের মধ্যে আমাদের উপজাতিরা জুমে আগুন দিয়ে গাছপালা ও কীটপতঙ্গ পুড়িয়ে ফেলছে। খবর পাচ্ছি জুমের আগুনে পুড়ছে রাঙ্গামাটি ফুরমোনসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের বিস্তীর্ণ এলাকা ও অনেক ঘর-বাড়ি ঝুঁকিপূর্ণ। তথাকথিত পদ্ধতিতে শত শত পাহাড়ের ঝোপ-জঙ্গল, গাছপালা কেটে আগুনে পোড়ানো হচ্ছে জুম চাষের জন্য। জুমের আগুনে পার্বত্যাঞ্চলের সবুজ শ্যামল প্রকৃতি পুড়ে সৃষ্টি হয়েছে ন্যাড়া পাহাড়। বছরের পর বছর পাহাড়ে আগুন দিয়ে জুম চাষের ফলে হারিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীজ সম্পদ। পাহাড়ের গাছগাছালি ও কীটপতঙ্গ পুড়ে জুমচাষ করেই প্রাকৃতিক পরিবেশকে বিপন্ন করার পাশাপাশি মাটি ক্ষয় এবং প্রাণীজ সম্পদের খাদ্য ও বসবাসের আশ্রয়স্থলও ধ্বংস করে দিচ্ছে। এ কারণে পাহাড়ে পরিবেশ সম্মতভাবে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে জুম চাষের পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
তীব্র তাপদাহের কারণে পাহাড় বা জুমে দেওয়া আগুন বিস্তীর্ণ এলাকায় দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা। বিগত বছর গুলোতে দেখা গেছে, পাহাড় জুমে দেওয়া আগুনে ঘর-বাড়ি ও পশুপাখি পুড়ে যাওয়ার নির্মম দৃশ্য৷ সাম্প্রতিক সময়েও জুমের আগুনে অনেক উপজাতি-বাঙ্গালী পরিবারকে গৃহহীন হতে হয়েছে। এর আগে সাজেকে জুমচাষের জন্য জুমে আগুন দিয়ে প্রস্তুত করতে গিয়ে বসতঘর পুড়ে এক হতদরিদ্র বয়োবৃদ্ধ দম্পতি গৃহহীন হয়েছিলো। এই হৃদয়-বিধায়ক ঘটনা সমগ্র পার্বত্যবাসীকে নাড়া দিয়েছিল। তখন সকলেই দাবি করেছিলো জুম পুড়ানো চাষাবাদ বাদ দিয়ে বিকল্প পদ্ধতি অবলম্বনের। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে আরও অধিক ফলনও সম্ভব। কিন্তু বিষয়টি মানতে নারাজ আমাদের উপজাতিরা। যার ফলে মাটি ক্ষয় হয়ে অল্প বৃষ্টিতে পাহাড় ধসের সৃষ্টি হচ্ছে। সবুজ পাহাড়গুলো ন্যাড়া পাহাড়ে পরিণত হচ্ছে। তবে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে জুম চাষ করা গেলে গাছপালা, বন্যপ্রাণী এবং পাহাড়ধস রোধ করা সম্ভব হবে। জুম চাষের মাধ্যমে আরো অধিক ফলনও উৎপাদন সম্ভব হবে। মৃত্তিকা ও পরিবেশবাদী সংস্থার জরিপে দেখা গেছে, জুম চাষের ফলে বনজ সম্পদ ধ্বংস হয়ে পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। পক্ষান্তরে মাটির উর্বরতা শক্তি হ্রাস করে ভূমি ক্ষয় হচ্ছে। পাশাপাশি বন্যপ্রাণীর নিরাপদ আশ্রয়স্থল ধ্বংস হচ্ছে এবং ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। এ কারণে প্রাকৃতিক পরিবেশ বিপন্ন হতে চলেছে। ভূমি অবক্ষয় সম্পর্কিত একজরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশে মোট পাহাড়ি ভূমির প্রায় ১৭ হাজার বর্গকিলোমিটার ভূমি এখন ক্ষয়ের মুখে। তার জন্য প্রধানত আমাদের জুমচাষকে দায়ী করা হয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড় ও প্রকৃতি আগুনে পুড়িয়ে যে জুম চাষ করার মাধ্যমে পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট করা হয় তা বন্ধে পরিবেশবাদীরা সজাগ দৃষ্টি রাখলে গাছপালা, কীটপতঙ্গ, বন্যপ্রাণী এবং পাহাড়ধস রোধ করা সম্ভব হবে।