জিহান মোবারক
বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম বহু দশক ধরে রাজনৈতিক অস্থিরতা, সন্ত্রাসবাদ এবং চাঁদাবাজির এক আতঙ্কময় অধ্যায়ের মধ্যে রয়েছে। ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চুক্তির মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা নেওয়া হলেও, ইউপিডিএফ নামক সংগঠনটি এই চুক্তির বিরোধিতা করে এবং নতুন করে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও বিচ্ছিন্নতাবাদী কর্মকাণ্ডের বিস্তার ঘটায়।
১৯৯৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর ঢাকায় এক কনফারেন্সর মাধ্যমে জেএসএস ছাত্র সংগঠন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি প্রসিত বিকাশ খীসা, রবি শংকর চাকমা ও প্রদীপন খীসার নেতৃত্বে ইউপিডিএফ আত্মপ্রকাশ করে। মূলত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বিরোধিতা করা এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে স্বায়ত্তশাসনের নামে রাষ্ট্রবিরোধী কার্যক্রম পরিচালনা করাই তাদের উদ্দেশ্য ছিল। সংগঠনটি চুক্তির বিরোধিতা করেই থেমে থাকেনি; বরং তারা পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর অবস্থান দুর্বল করতে এবং বাঙালিদের বিতাড়িত করতে সক্রিয়ভাবে কাজ করতে থাকে। ফলে তারা পার্বত্য অঞ্চলে নতুন করে সন্ত্রাসের বিস্তার ঘটায়, যা এ অঞ্চলের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
২০০১ সালে ইউপিডিএফ নানিয়ারচর থেকে তিনজন বিদেশি নাগরিককে অপহরণ করে, যা আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে এবং বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়। আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি হলে সংগঠনটি তিন কোটি টাকা মুক্তিপণ আদায় করে অপহৃতদের মুক্তি দেয়। এর ফলে ইউপিডিএফকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে পরিষ্কারভাবে প্রতীয়মান হয় যে, ইউপিডিএফ শুধু দেশীয় পর্যায়ে নয়, আন্তর্জাতিকভাবেও বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। তারা শুধু পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বিরোধিতাই করেনি; বরং এই অঞ্চলে সেনাবাহিনী প্রত্যাহারের দাবিও তুলেছে। তাদের মতে, পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালিদের থাকার অধিকার নেই এবং সেনাবাহিনীও এখানে থাকার যোগ্য নয়। মূলত এই দাবির মধ্য দিয়ে ইউপিডিএফ পার্বত্য চট্টগ্রামকে বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা চালাচ্ছে, যা রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রেরই নামান্তর।
পার্বত্য চট্টগ্রামের উত্তরাঞ্চল বর্তমানে ইউপিডিএফের নিয়ন্ত্রণে, যেখানে তারা সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও অস্ত্রব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। সংগঠনটি বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের কাছ থেকে নিয়মিত চাঁদাবাজি করে এবং সেই অর্থ দিয়ে তারা অবৈধ অস্ত্র সংগ্রহ, জনবল বৃদ্ধি, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ষড়যন্ত্রকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন, মিডিয়া প্রচারণা বৃদ্ধি, ব্লগার কার্যক্রম সম্প্রসারণ এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় বিভ্রান্তিকর প্রচার চালিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্থিরতা বজায় রাখছে। তাদের চাঁদাবাজির শিকার শুধু ব্যবসায়ী বা সাধারণ মানুষই নয়; বরং পাহাড়ে বসবাসকারী সকল সম্প্রদায়ের মানুষ ইউপিডিএফের আরোপিত করের আওতায় রয়েছে। এই সংগঠনটি একদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বের দাবি করে, অন্যদিকে তারাই সাধারণ পাহাড়িদের ওপর অবর্ণনীয় অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে।
ইউপিডিএফের শক্তিশালী একটি হাতিয়ার হলো তাদের নারী সংগঠন ‘হিল উইমেন্স ফেডারেশন’। এই সংগঠনটি ইউপিডিএফের সাংগঠনিক রক্ষার অন্যতম বাহু হিসেবে কাজ করে। তারা পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনা অভিযানের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচারণা চালায়, সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানে গ্রেফতারকৃত ইউপিডিএফ সদস্যদের মুক্তির জন্য সোচ্চার হয় এবং আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচারণা চালায়। মূলত, হিল উইমেন্স ফেডারেশনকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে ইউপিডিএফ তাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকে ‘মানবাধিকার লঙ্ঘন’ বলে প্রচার করতে চায়।
ইউপিডিএফ যে শুধু রাষ্ট্রবিরোধী কার্যক্রম পরিচালনা করছে তা-ই নয়, বরং তারা পার্বত্য চট্টগ্রামে জাতিগত বিদ্বেষও ছড়িয়ে দিচ্ছে। তারা পাহাড়ি জনগোষ্ঠী ও বাঙালিদের মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করতে উস্কানিমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে, যাতে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে দাঙ্গা বাধে এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি অস্থিতিশীল অঞ্চলে পরিণত হয়। এই সংগঠনটি তথ্য সন্ত্রাসের মাধ্যমেও বিভ্রান্তি ছড়ায়। তারা নিজেদের নিরপরাধ বলে প্রচার করলেও বাস্তবে তারা নিয়মিতভাবে খুন, অপহরণ, চাঁদাবাজি, এবং সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। চুক্তির পর তাদের তৈরি সংঘর্ষে ৮ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে।
সরকারের উচিত দ্রুততম সময়ের মধ্যে ইউপিডিএফের অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করা, তাদের চাঁদাবাজির নেটওয়ার্ক ধ্বংস করা এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। বাংলাদেশের ভূখণ্ডের অবিচ্ছেদ্য অংশ পার্বত্য চট্টগ্রামে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য ইউপিডিএফের মতো সংগঠনগুলোর কার্যক্রম কঠোরভাবে দমন করা অত্যন্ত জরুরি। দেশের সাধারণ জনগণকেও এই রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে, যাতে পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি স্থিতিশীল ও শান্তিপূর্ণ অঞ্চলে পরিণত হতে পারে।