বরকল ভূষণছড়া সেদিন সৃষ্টি হয়েছিল এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য!

0

মোঃ সোহেল রিগ্যান

১৯৮৪ সালের ৩১ মে, ভয়াল দুঃস্বপ্নের দিন। ৩১ মে মানেই গা শিউরে ওঠা, পার্বত্য বাঙালিদের থমকে যাওয়া একটি দিন। যে দিনে পার্বত্য ইতিহাসে রচিত হয় এক রক্তাক্ত অধ্যায়। সেদিন উপজাতি শান্তিবাহিনী সন্তুর সন্ত্রাসীরা ১৪ (চৌদ্দ) শতাধিক পার্বত্য বাঙালিকে নিঃশেষ করে দেয়। একটি জাতির অস্তিত্ব বিলিন করতে যত প্রচেষ্ঠা ছিল সব প্রচেষ্টাই করেছিল সন্তু লারমার দলের রক্তপিপাসু মেজর রাজেশ চাকমা। কে এই মেজর রাজেশ চাকমা? মেজর রাজেশ চাকমা হচ্ছে বিএনপি জোট সরকারের ২০০১ সাল হতে ২০০৬ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালের উপমন্ত্রী মণি স্বপন দেওয়ান। তাকে উপমন্ত্রী বানিয়ে পার্বত্য বাঙালিদের রক্তের সঙ্গে বেইমানি করেছে বিএনপি জোট সরকার৷ একজন খুনিকে এমপি- মন্ত্রী বানানো, স্বাধীন সার্বভৌমত্ব রাস্ট্রের জনগণের সাথে বিশ্বাসঘাতকতার শামিল।

কী ঘটেছিল সেদিন রাতে রাঙামাটি বরকল উপজেলার ভূষণছড়াতে?

তখন পার্বত্য চট্টগ্রামে ম্যালেরিয়া ও কলেরার প্রাদুর্ভাব ছিল মারাত্মক, মানুষ বন-জঙ্গলে টিকে থাকাও ছিল অকল্পনীয়। এমন প্রতিকূল প্রাকৃতিক পরিস্থিতি মোকাবেলা সরকারের পক্ষ হতে সহযোগিতা ছিল অতি সামান্য। বাঙালিরা জীবন ঝুঁকি নিয়ে কোনমতেই মাটি ও বাঁশের ঘর নির্মাণ করে দিন পার করত। প্রতিদিনের নিয়মে আর সারাদিনের কর্মব্যস্তায় ভূষণছড়ার বাঙালিরা যেদিন যে যার যার মত গভীর ঘুমে বিভোর৷ এমন সময় সন্তু সন্ত্রাসীদের ১৬৫ জনের একটি সশস্ত্র দল ৫ ভাগে বিভক্ত হয়ে ভূষণছড়া ১৬ (ষোল) শতাধিক পরিবারের মধ্যে ৩ (তিন) শতাধিত পরিবারের আবাসস্থল ঘেরাও করে নির্বিচারে গুলি বর্ষণ এবং অবুঝ শিশুদের টেনে টুকরোটুকরো করে মস্তক ছিন্ন করার বিভৎসতায় সে সময়ের প্রত্যক্ষদর্শীদের মনে এখনো দাগকাটে।

ঘরের দরজা লাথি মেরে ভেঙে নারী-পুরুষদের সবাইকে ঘর থেকে বাহির করে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে। কাউকে পালানোর সুযোগ দেওয়া হয়নি, এবং কাউকে এগিয়ে আসারও সুযোগ দেওয়া হয়নি। নির্বিচার হত্যাকাণ্ড চালিয়ে পরিপার্শ্বে ভয়ংকর ত্রাসের জন্ম দেওয়া হয়। প্রায় চৌদ্দ শতাধিক ঘুমন্ত বাঙালিকে ৭১ সালের হানাদারদের মত হত্যা করে পার্বত্য উপজাতি শান্তিবাহিনীর সদস্যরা।

ধর্ষণের মত ঘৃণিত অপরাধও সংগঠিত করে সন্ত্রাসীরা।
ভোলার চরফ্যাশন থেকে ১৯৭৯ সালে ভূষণ ছড়া পূর্নবাসিত হয় আমির হোসেন, আমির হোসেনের পরিবারের সদস্য সংখ্যা স্বামী-স্ত্রী ও তিন কন্যা সন্তান সহ মোট ৫জন। আমির হোসেন ও আমির হোসেনের স্ত্রী জহুরা বেগম, এবং ছোট দুই মেয়েকে গুলি করে হত্যা করার পরে লাশ নৃশংসভাবে কুপিয়ে লাশের উপর আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। এমন ভয়ালভাবে পিতামাতা ও বোনদের মৃত্যু দেখেছে কিশোরী বকুল আক্তার।
আমির হোসেনের তিন মেয়ের মধ্যে বড় মেয়ে হচ্ছে ১৫ বছরের কিশোরী বকুল আক্তার। সে দেখতে অনেকটা সুন্দরী। সুন্দরী হওয়ার কারণে তাকে পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে হত্যা করে লাশ পুড়িয়ে দেয়নি।
মেজর রাজেশ চাকমা আজকের মণি স্বপন দেওয়ান কিশোরী বকুল আক্তারের চুল ধরে শুয়ে দিয়ে ক্ষিপ্ত পশুর মত ঝাপিয়ে পড়ে ধর্ষণ করে। এরপর ২১ জন নরপশু কিশোরী বকুলকে গণধর্ষণ করে রক্তাক্ত করে। ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে কান্না কণ্ঠে এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, যখন বকুলকে গণধর্ষণ করা হয় তখন বকুলের হৃদয় নিংড়ানো আর্তচিৎকারে চারদিকের পরিবেশ ভারী হয়। সন্ত্রাসীদের ভয়ে কেউ এগিয়ে আসার দুঃসাহস দেখায়নি। গণধর্ষণের সময় বকুল আক্তারকে কান্না কণ্ঠে বলতে শুনা যায় আমি আর পারছি না দাদা তোমরা আমাকে ছেড়ে দাও আর না হয় গুলি করে একদম মেরে দাও, তার পরেও আমাকে এভাবেই যন্ত্রনা দিওনা দাদা। এরপরও নরপশু উপজাতি সন্ত্রাসীরা ছেড়ে দেয়নি বকুলকে। অতঃপর গণধর্ষণে নিস্তেজ হয়ে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করে বকুল আক্তার। পরে তার মৃত্যু নিশ্চিত করতে মেজর রাজেশ চাকমার হাতে থাকা একটি ৩ ফুটের কাঁচা বাঁশের লাঠি কিশোরী বকুল আক্তারের যৌন অঙ্গে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়! মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর কেরোসিন ঢেলে আগুন দিয়ে সবকিছুই ছাই করা হয়।
এমন বিভৎসতায়র বিবরণ দিতে গিয়ে বারবার দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল প্রত্যক্ষদর্শীর। হৃদয়বিদারক দৃশ্য দেখে অনেকেই জ্ঞানও হারিয়ে ফেলেছিল।

গণহত্যা চালিয়ে যাওয়ার সময় বাঙালিদের নিধন করতে, এবং গবাদিপশু সহ প্রতিটি বাড়ি ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয় সন্ত্রাসীরা। এরপর ৩৭০ টি লাশের নাম ঠিকানা ও পরিচয় পাওয়া যায়। বাকিরা আগুনে পুড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।

এমন ভয়াল ঘটনাটি তৎকালীন দায়িত্বরত কর্মকর্তারা ও সরকার দামাচাপা দেয়। যদিও তৎকালীন প্রেসিডেন্ট এইচ এম এরশাদ ঘটনারস্থল পরিদর্শন সহ নিহত বাঙালি পরিবারগুলোর বেঁচে থাকা সদস্যদের সাথে কথা বলে বিচার ও সহযোগিতার আশ্বাস দেয়। কিন্তু ঘটনার ভয়াবহতা আঁচ করতে পেরে সম্পূর্ণভাবে বাঙালি গণহত্যাকে দামাচাপা দিতে গণমাধ্যম প্রবেশ নিষিদ্ধ করে ভূষণছড়া। এর ফলে বাঙালি গণহত্যার সঠিক ইতিহাস দামাচাপা পড়ে যায়। স্বজন হারা পরিবারগুলো সরকারি সাহায্য সহযোগিতা আর পায়নি, এবং বিচারের বাণী নিভৃতে কেঁদেছে।

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More