বান্দরবানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সিনিয়র ওয়ারেন্ট অফিসার জেএসএস সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত!
গতকাল বুধবার (২ ফেব্রুয়ারি) বান্দরবান জেলার রুমা উপজেলার রুমা জোন (২৮ বীর) আওতাধীন রাইখ্যং লেক পাড়া আর্মি ক্যাম্প হতে একটি সেনাদল গোপন সংবাদের ভিত্তিতে বথি ত্রিপুরা পাড়া (সেপ্রু পাড়া) পার্বত্য চুক্তি পক্ষ জেএসএস সন্তু লারমার সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের গোপন আস্তানায় সেনা অভিযান পরিচালনা করেন। উক্ত অভিযানে জেএসএস সন্ত্রাসীরা সেনাদলের উপস্থিতির টের পেয়ে এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ করলে ঘটনারস্থলে সেনা অভিযানের নেতৃত্ব দেওয়া সিনিয়র ওয়ারেন্ট অফিসার হাবিব রহমান মাথায় গুলিবিদ্ধ হন ও সেনাসদস্য ফিরোজ হোসেন গুলিবিদ্ধ হয়। তাৎক্ষণিক সেনারা পাল্টা গুলি ছুঁড়লে জেএসএস সন্তু গ্রুপের তিনজন সশস্ত্র সন্ত্রাসী ঘটনাস্থলে নিহত হয়।
উক্ত স্থান হতে সেনারা তল্লাশি চালিয়ে সন্ত্রাসীদের ব্যবহৃত ১ টি এসএমজি, ২৭৫ রাউন্ড তাজা গুলি, ৩ টি এম্যোনিশন ম্যাগাজিন, ৩ টি গাদা বন্দুক, গাদা বন্দুকের ৫ রাউন্ড গুলি, ৪ জোড়া ইউনিফর্ম এবং চাঁদাবাজির নগদ ৫২৯০০ টাকা উদ্ধার করেন।
উপরোক্ত ঘটনার বিষয়ে অনেকেই বলবেন, সেনাবাহিনীর ১ জন নিহত হয়েছে ১ জন আহত হয়েছে, আর সেনাবাহিনী তো সন্ত্রাসীদের ৩জনকে নিহত করেছে। এখানে সেনাবাহিনী তাদের চেয়ে অনেক এগিয়ে৷ যারা এটা বলেন এবং মনে করেন তারা নিঃসন্দেহে বোকার স্বর্গে বাস করেন। তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীর মধ্যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী অন্যতম। যেখানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে। এমনকি যে সেনাবাহিনীকে নিয়ে আমরা সবসময় গর্ববোধ করি। সেই সেনাবাহিনী নিজদেশের খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান তথা পার্বত্য চট্টগ্রামে বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী দমন করতে গিয়ে বারবার মার খাচ্ছে এবং নিহত হচ্ছে। এটাকেই কীভাবে আমরা হাল্কা বিষয় মনে করি এবং সেনাবাহিনী এগিয়ে আছে মনে করি??? অসংখ্য বার পাহাড়ে সেনাবাহিনী হামলার সম্মুখীন হচ্ছে। গত ২০০৭ সালে রাঙ্গামাটি নানিয়ারচর সেনা ক্যাপ্টেন গাজী হত্যা, রাজস্থলী সেনাসদস্য মো. নাছিম হত্যা ও আজ বান্দরবান জেসিও হত্যাকে আমরা কোনমতেই হাল্কা ভাবেই নিতে পারছি না৷ পার্বত্য চুক্তির পর তো পাহাড়ে অস্ত্রধারী থাকার কথা নয়? কেন সেনাদের উপর হামলা হবে? তাদের এমন দুঃসাহস ও ধৃষ্টতা কীভাবে হয় যে, তারা আমাদের রাষ্ট্রীয় বাহিনীর ওপর হামলা করে? তাদের বিষদাঁত উপড়ে ফেলা এখন সময়ের শ্রেষ্ঠ দাবি। পার্বত্য চুক্তির মাধ্যমে তাদের সব দাবিদাওয়া মেনে নেওয়ার পরেও কেন তারা আমাদের সেনাবাহিনী উপর হামলা করবে? কেন পাহাড়ে সেনারা রক্তাক্ত হবে? সেনাবাহিনীর একজন সদস্যও কেন মরবে?
একটি রাষ্ট্রীয় বৃহৎ বাহিনী কেন বারবার মার খাবে কেনই বা হত্যাকাণ্ডের শিকার হবে? যারা সেনাবাহিনীর উপর হামলা করছে নিজেদের শক্তিসামর্থ্য জানান দিচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে আমাদের সরকার কী ব্যবস্থা নিয়েছে? তাদের লাগাম টেনে ধরার মতো কী সরকার সেনাবাহিনীকে ক্ষমতা দিয়েছে? পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্রিটিশদের দাবার গুটি হিসেবে ব্যবহৃত হওয়া এই বিশেষগোষ্ঠী আজকে খুবি গর্ব করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিজয়ের আভাস দিচ্ছে। তারা বলছে তারা নাকি সেনাদের ছেড়ে কথা বলবে না। তারাও নাকি মারতে পারে চার, ছক্কা! কতটুকু দুঃসাহস হলে তারা এমনটা বলার সামর্থ্য রাখে? তাদের প্রতি রাষ্ট্রের নমনীয়তা ও সহনশীলতার কারণে আজ তারা এতবড় দুঃসাহস দেখায়। এটা রাষ্ট্রের জন্য কতটাই হুমকি তা বিশ্লেষণ করার জন্য বিবেকবানের উপর ছেড়ে দিলাম।
পার্বত্য চট্টগ্রামকে বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ড হইতে বিচ্ছিন্ন করতে সক্রিয় থাকা এ অঞ্চলের ৪টি সন্ত্রাসীগোষ্ঠী যে, কতটা শক্তিসাধন করেছে এবং পার্বত্য চুক্তির সুবিধা ভোগ করে পাকাপোক্ত হয়েছে তা নিয়ে আমাদের সরকারের বিন্দুমাত্র ধারণা নেই আর যদি ধারণা থাকেও সরকার প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলকে ঘায়েল করতে রাষ্ট্রের বৃহৎ স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়েছে। সরকার সারাদেশের ন্যায় পার্বত্য চট্টগ্রামেও সেনাবাহিনীকে মেরুদণ্ডহীন করে রেখেছে শুধুমাত্র রাজনৈতিক কারণে। যার দৃষ্টান্ত বিগত কয়েক বছরে পার্বত্য চট্টগ্রামে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর উপর হামলার মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে। এটা সত্যি দুঃখজনক ও লজ্জাজনকও বটে। পরিতাপের বিষয় এদেশের বৃহৎ বাহিনী অথাৎ সামরিক বাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামের বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসীদের হাতে প্রায়শই মার খাচ্ছে এবং হত্যাকাণ্ডের শিকার হচ্ছে। এটা নিয়ে আমাদের দেশের সুশীল, সরকার তথা নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের কোনো চিন্তা-ভাবনা নেই। তারা পার্বত্য চট্টগ্রামে পান থেকে চুন খসলে সেনাবাহিনী ও বাঙ্গালীকে দোষারোপ করে। সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে সন্ত্রাসবাদ কায়েম করতে গিয়ে হত্যা, অপহরণ ও চাঁদাবাজির পাশাপাশি রাষ্ট্র বিরোধী তৎপরতা করছে সে বিষয়ে তাদের কারোরই ভ্রুক্ষেপ নেই। এখানেই দুঃখ ও আফসোস হয়।
উল্লেখ করা প্রয়োজন, পার্বত্য চট্টগ্রামের সন্ত্রাসীগোষ্ঠী থেকে সেসমস্ত অত্যাধুনিক অস্ত্র ও প্রযুক্তি রয়েছে তা আমাদের দেশের বাহিনী গুলো থেকেও নেই। এই অত্যাধুনিক অস্ত্র ও প্রযুক্তি প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলো থেকে সীমান্ত দিয়ে অবাধে নিয়ে এসে এদেশের জনগণ ও সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের ৭৪ কিলোমিটার এলাকায় কাঁটাতারের বেড়া নেই। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে পার্বত্য সন্ত্রাসীরা প্রতিবেশী দেশগুলো হতে অবৈধ অস্ত্র সরবরাহ ও অস্ত্র প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এখানে অবাক করা তথ্য হচ্ছে, যখন তারা এদেশে সেনা অভিযানে টিকতে পারেনা তখন তারা প্রতিবেশী দেশগুলোতে আশ্রয়-প্রশয় গ্রহণ করে। এই দিকগুলো নিয়ে কখনো আমাদের দেশের সরকার ও প্রশাসনকে তদারকি করতে দেখিনি! তাদেরকে দেখা যায় শুধুই পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ গোষ্ঠীর পক্ষে সাফাই গাইতে।
সেনাবাহিনীর পার্বত্য চট্টগ্রামে অসহায়ত্বের কারণ হচ্ছে জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলোর পরষ্পর বিরোধী তৎপরতা ও রেষারেষি এবং প্রতিপক্ষকে দমিয়ে দীর্ঘসময় ক্ষমতায় টিকে থাকার চিন্তা-চেতনায় সেনাবাহিনীর স্বাধীনতা হরণ করা। যে সরকার ক্ষমতায় আসে সেই সরকারই সেনাবাহিনীকে মেরুদণ্ডহীন করে রাখে৷ বলাবাহুল্য যে, ১৯৯৭ সনের অসাংবিধানিক পার্বত্য চুক্তির মাধ্যমে সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের উপর কর্তৃত্ব হারিয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে সরকারের বর্তমান কোনো মাথা ব্যথা নেই। এখানকার নিরাপত্তা পরিস্থিতি ও সংকট নিয়ে সরকারের বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। একতরফাভাবে জেএসএসসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে সরকার বরাবরই পার্বত্য চট্টগ্রামের অখণ্ডতাকে হুমকির সম্মুখীন করেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঙ্গালী জনগোষ্ঠীর মৌলিক সাংবিধানিক অধিকার হরণ করেছে। জেএসএস তথা তাদের সহায়তাকারী আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারী গোষ্ঠীকে খুশি করতে সরকার একের পর এক পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বার্থবিরোধী কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন করেছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে অসাংবিধানিক পার্বত্য চুক্তির শর্তের দোহাই দিয়ে সেনাক্যাম্পগুলো প্রত্যাহার করে নিয়ে সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের নিরাপত্তা পরিস্থিতি সংকটময় করেছে। এর ফলে এ অঞ্চলের মানুষের জননিরাপত্তা ব্যাহত হয়েছে। স্বাধীনতার পূর্ব হতে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা এ অঞ্চলকে বাংলার অংশ হতে বিচ্ছিন্ন করতে তৎপর। তারা চায় এ অঞ্চলকে আলাদা করে একটি নতুন জম্মল্যান্ড নামক রাষ্ট্র গঠন করতে। সেসব বর্ণনা এই লেখায় লিখতে গেলে লেখা অনেক লম্বা হবে পাঠক বিরক্ত হবে, তাই লিখলাম না। সর্বশেষ শুধুই এতটুকু উল্লেখ্য ও স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, পার্বত্য চুক্তির সময় পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সংহতি সমিতি (জেএসএস) সরকারের নিকট সম্পূর্ণ অস্ত্র জমা দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার কথা ছিল। সরকার সে শর্তে তাদেরকে ৭২ টি ধারা-উপধারায় সুযোগ-সুবিধা পার্বত্য চুক্তির মাধ্যমে দিয়েছে এবং সরকার তার দেওয়া কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করছে। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো চুক্তির ২৪ বছর পরেও জেএসএস অবৈধ অস্ত্র নিয়ে বিদ্যমান! এটা কী পার্বত্য চুক্তির মৌলিক শর্ত লঙ্ঘন নয়? এদিকে জেএসএস সন্তু লারমা প্রায়শই অভিযোগ করে আসছে সরকার চুক্তি বাস্তবায়নে আন্তরিক নয়; সরকার চুক্তি বাস্তবায়ন করছে না। কিন্তু তারা যদি অবৈধ অস্ত্র পরিহার না করে সরকার কীভাবে সম্পূর্ণ পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন করবে?