কাউখালী হইতে আঞ্চলিক দলের সম্পৃক্ততায় পাচার হচ্ছে অবৈধ কাঠ।

0
ছবি: অবৈধভাবে পাচার করার জন্য মজুত করা সেগুন কাঠ

প্রতিবেদক: সৌমেন ভৌমিক 

পার্বত্য চট্টগ্রামে পরিবেশের ভারসাম্য, জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষার স্বার্থে সরকারের বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় পাহাড়ে পারমিটবিহীন সবধরনের গাছপালা কাটা ও অবৈধভাবে পাচার নিষিদ্ধ করেছে৷ অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট (কাঠ চোরাকারবারি) আঞ্চলিক সন্ত্রাসীদলকে মোটা অংকের চাঁদা দিয়ে নিষিদ্ধ কাঠ ও লাকড়ি পাচার করে আসছে।

রাঙ্গামাটি জেলার কাউখালী উপজেলার মুবাইছড়ি, পানছড়ি, তালুকদার হইতে রাত-দিন ২৪ ঘন্টা বিভিন্ন মাধ্যমেকে চাঁদা দিয়ে অবিরত যাচ্ছে অবৈধ সেগুন-গামারি গাছসহ পাহাড়ি বিলুপ্ত গাছগাছালি। আরো যাচ্ছে ইটভাটার জ্বালানি হিসেবে নিষিদ্ধ লাকড়ি৷ ছোটছোট সেগুন-গামারি ও বিলুপ্ত গাছগাছালি কেটে কাউখালীর পাহাড়গুলো ন্যাড়া করে ফেলছে অবৈধ কাঠ চোরাকারবারি সিন্ডিকেট৷ উপজেলার বটতলী, কাশখালী, পোয়াপাড়া, চেলাছড়া, যৌথখামার এলাকার পাহাড় গুলো ন্যাড়া করে বন ও পরিবেশ আইন লঙ্ঘন করে আঞ্চলিক দলের সম্পৃক্ততায় নিষিদ্ধ কাঠ ও লাকড়ি পাচার করে আসছে। প্রশাসনের ছত্রছায়ায় কাঠ পাচারকারীরা সিন্ডিকেট সক্রিয়। এতে পরিবেশের ভারসাম্য যেমন হুমকির সম্মুখীন তেমনি দিনদিন পাহাড় ধসের আশঙ্কা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সর্বত্র এই নিয়ে সমালোচনা ও বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিদিন রাত্রে কাউখালী উপজেলা সদর সড়ক, চেলাছড়া-বেতছড়ি সড়ক ও পোয়াপাড়া সড়ক দিয়ে নিষিদ্ধ কাঠ ও জ্বালানি লাকড়ি বোঝাই শতাধিক গাড়ি যায়। রাত্রে মানুষ ঘুমাতে পারে না গাড়ির আওয়াজে। বেপরোয়া গতির নিষিদ্ধ কাঠ ও লাকড়ি বোঝাই গাড়ি যে কোনো মূহুর্তে কেড়ে নিতে পারে প্রাণ। কয়দিন আগে বেপরোয়া গতির কাঠের গাড়ি কাউখালী রানিরহাট সড়কে ২টি তাজাপ্রাণ কেড়ে নেয়৷

কাউখালী উপজেলা প্রশাসন ও আইন- শৃঙ্খলা বাহিনীর নাকের ডগায় দিয়ে নিষিদ্ধ কাঠ ও লাকড়ি রাত ৮/৯ টার পরপর হইতে সারারাত যেতে দেখা যায়৷ স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, নিষিদ্ধ কাঠ বোঝাই প্রতিটি গাড়ি হইতে মোটাঅংকের চাঁদা নিয়ে এসব গাড়ি নির্বিঘ্নে পারাপার করতে কাজ করে কাঠ চোরাকারবারি অসাধু সিন্ডিকেট৷ এই সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করে এখানকার সব প্রশাসন। নিষিদ্ধ সেগুন-গামারি ও বিলুপ্ত গাছগাছালি পাচার করতে গিয়ে তারা সার্বক্ষণিক আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নজরদারিতে রাখেন। এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর আগাম তথ্য আঞ্চলিক দলগুলো নিকট সরবরাহ করেন। এতে বাধাপ্রাপ্ত হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যক্রম৷ কাঠ চোরাকারবারিরা রাষ্ট্রের বৃহৎ ক্ষতি করলেও সংশ্লিষ্ট মহল এর বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে বরাবরই ব্যর্থ হয়েছে।

কয়েকজন কাঠ ব্যবসায়ী ও স্থানীয়রা অভিযোগ করে বলেন, আঞ্চলিক দলকে প্রতিফুট কাঠ প্রতি ১০০ টাকা চাঁদা দিতে হয়। ৫ হাজার ফুট কাঠ হলে ৫ লাখ টাকা চাঁদা দিতে হয়। বৈধ হোক আর অবৈধ হোক সবধরনের কাঠ হইতে চাঁদা দিতে হয়। কাঠ ও জ্বালানি লাকড়ি থেকে চাঁদার টাকা আদায় করে আঞ্চলিকদলগুলো৷ পাহাড়ে যেখানে একটি মুরগী বিক্রি করলে চাঁদা দিতে হয় সেখানেই চাঁদা ছাড়া পাহাড়ের ভিতর থেকে কাঠ নিয়ে আসা কোনভাবেই সম্ভব না। কাঠ পাচার রোধে নেই বন বিভাগ ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা।

সূত্রগুলো জানায়, পাহাড়ের ভিতর থেকে অবৈধ কাঠ, জ্বালানি লাকড়ি নিয়ে আসতে প্রথম আঞ্চলিক দল থেকে ব্যবসায়ীদের মাসিক, বাৎসরিক বা এককালীন চাঁদা পরিশোধ করে টোকেন সংগ্রহ করতে হয়। এরপর চাঁদা দিতে হয় ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়কে। এমনকি এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলকে চাঁদা দিতে হয়। এভাবেই চাঁদা দিয়ে আঞ্চলিক সন্ত্রাসী দলগুলোর সাংগঠনিক সক্ষমতা শক্তিশালী করা হয়। বর্তমানে বান্দরবানে কুকি চিন সন্ত্রাসীদের লাগাম টেনে ধরতে সরকারকে বেগ পেতে হয়। এখন যদি এই অঞ্চলের আঞ্চলিক দলগুলোর অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি ভেঙে দেওয়া না হয় অচিরেই তাদের মোকাবিলা করতে সরকারকে আরো কঠিন বেগ পেতে হতে পারে।

প্রতিবেদক সৌমেন ভৌমিক সরেজমিনে কাউখালী উপজেলা ঘুরে এসে জানান, উপজেলার কচুখালীতে থাকা চিরাই কাঠের স.মিলে অবৈধ কাঠের বিপুল সমাহার৷ চতুর্দিকে সব অবৈধ কাঠ আর কাঠ। যেনো দেখার কেউ নেই! স.মিল এর পূর্ব দিকে একটি খালি মাঠ রয়েছে, যেখানে মজুত আছে বিপুল পরিমাণ নিষিদ্ধ সেগুন-গামারিসহ পাহাড়ি বিলুপ্ত গাছগাছালি। এসব কাঠ যখন চোরাকারবারিরা নিয়ে আসে তখন তারা বিপুল পরিমাণ চাঁদা দেয় আঞ্চলিকদল ও কাঠ সমিতিকে। প্রকাশ্যে দিবালোকে কচুখালী কলেজ সড়ক দিয়ে কাঠ আসে। নিষিদ্ধ কাঠের গাড়ি উপজেলা প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর একদম নাগালের মধ্য দিয়ে রানিরহাট চলে যায়৷ অবৈধ কাঠ পাচার নিয়ে তীব্র সমালোচনা হলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ গুলোর এই ব্যাপারে ভ্রুক্ষেপ নেই। মূলত চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্যে অবৈধ কাঠ ধরতে অনিহা।

সচেতন মহল মনে করে এভাবেই অবৈধ কাঠ গেলে সরকার কোটি কোটি টাকা রাজস্ব হারাবে৷ সবচেয়ে চিন্তার বিষয় আঞ্চলিক দলগুলো অবৈধ কাঠের চাঁদা দিয়ে অস্ত্র ক্রয় করে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে। বিগত বছরগুলো কাঠের বিরুদ্ধে অভিযান থাকলেও চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্যের কারণে বর্তমানে কাঠের বিরুদ্ধে অভিযান জিরো পরিমাণ নেই। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কাঠ ব্যবসায়ী জানান, অবৈধ কাঠ পাচারে বন বিভাগ জড়িত রয়েছে। সবার সম্পৃক্ততায় অবৈধভাবে কাঠ পাচার হয়।

এলাকাবাসী দাবি করেন, বন ও পরিবেশ এবং প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষার অংশ হিসেবে অবৈধ কাঠ পাচার বন্ধে প্রশাসন ও আইন- শৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর ভূমিকা পালন করা উচিত।

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More