১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর পাকিস্তান প্রত্যাবর্তনের ২০ দিন পর মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা পাহাড়ি প্রতিনিধি দল স্বতন্ত্র আইন প্রননয়ের ক্ষমতা সহ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের এক দাবী তুলে ধরেন। যখন সামগ্রিক ভাবে দেশ ছিলো যুদ্ধ বিধ্বস্ত ও নানান জটিলতার আবর্তে প্রায় দিশেহারা। বঙ্গবন্ধু কে কোন রূপ সময় না দিয়ে এবং তার রাঙামাটিতে প্রদও ভাষনকে আমলে না নিয়ে সশস্ত্র সংগ্রামের পূর্ব প্রস্তুতিকে বেগবান করেন। যার প্রস্তুতি তিনি অবশ্যই স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় থেকেই নিচ্ছিলেন। রাজাকার বাহিনীতে চাকমা সম্প্রদায়ের ব্যাপক অংশগ্রহণ, প্রশিক্ষন গ্রহন এবং অস্ত্র সংগ্রহ তখন থেকেই নিচ্ছিলেন।যা পরবর্তীতে শান্তি বাহিনী নামে আত্মপ্রকাশ করে।
এম এন লারমা ১৯৭১ সালের বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের মডেলকে পুরোপুরি অনুসরণ করে আশা করছিলেন, ভারতের সহায়তায় বাংলাদেশের মানচিত্র থেকে বেরিয়ে একটা স্বাধীন জুম্মল্যান্ড তৈরি করে শত বছর আগের হারানো চাকমা রাজ্য কে পুনরুজ্জীবিত করবেন। তা করতে না পারলেও ১৯৪৭’র ভারত অন্তর্ভুক্তির ইচ্ছে কে বাস্তবায়ন করা।
তিনি ভেবেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশ সামরিকভাবে দূর্বল, আভ্যন্তরীন নানান দূর্বলতায় জর্জরিতঃ সর্বহারা, জাসদ সহ নানান রাজনৈতিক বিভাজনে ব্যতিব্যস্ত। এরকম লেজেগোবরে অবস্থায় একটু টোকা দিলেই পার্বত্য চট্টগ্রাম টুপ করে ম্যাপ থেকে আালাদা হয়ে যাবে। তিনি ধর্না দিলেন মহামতি ইন্দিরা গান্ধীর কাছে সামরিক সাহায্য চাইলেন পার্বত্য চট্টগ্রামকে আলাদা করে ফেলতে।
ইন্দিরা গান্ধী সে কথা তো কানে নিলেনই না,উপরন্তু বঙ্গবন্ধু কে ঘরের শত্রু বিভীষণের তৎপরতার কথা জানিয়ে দেন।
পরে অবশ্য ১৯৭৫’র ১৫ আগষ্টের মর্মান্তিক ঘটনার পর ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বদলে যায়।
দিল্লিতে ডাক পান মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ও সন্তুলারমা। তারপর ১৯৭৬ সালের মাঝামাঝিতে ভারত থেকে অস্ত্রের প্রথম চালান আসে। ১৯৭৬ সালের প্রথমদিকেই শান্তি বাহিনী সামরিক অ্যাকশনে নেমে পরে। প্রথম দিকে তাদের কর্মসূচি ছিলো থানা আক্রমণ করে অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহ করা। পরবর্তী পর্যায়ে নাশকতামূলক কাজ যেমন ; পুল কালভার্ট ধৃবংস করা সরকারি সম্পওির ক্ষতিসাধন করা, অপহরণের মাধ্যমে মুক্তিপন আদায়, প্রয়োজনে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী ও অন্যান্য বাহিনীর উপর ঝটিকা আক্রমণ করা।
শান্তি বাহিনীর ব্যবহৃত অস্ত্রের মধ্যে ছিলো ৩০৩ রাইফেল, এসএসসি, বৃটিশ এলএমজি, হ্যান্ড গ্রেনেড, এসবিবিএল বন্দুক ও হাতে তৈরি বিস্ফোরক। শান্তি বাহিনীর এসব অস্ত্র রাজাকার বাহিনীতে যোগদানের কারনে পাকিস্তানি সেনাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত মজুদ ও লোগাং এর ভগবানটীলার পাশ দিয়ে নেমে আসা ভারতীয় ভগবানের আশীর্বাদ স্বরূপ “র” কর্তৃক হস্তান্তারিত কয়েকটি চালান।।
শান্তি বাহিনীর প্রথমদিকের ব্যবহৃত অস্ত গুলোর মধ্যে চাইনীজ বা চেকোশ্লোভাকিয়ার তৈরি অস্ত্র খুবই কম ছিলো। আরপিজি, হেভিমেশিনগান, মর্টার বা আক্রমণাত্বক অস্তের ব্যবহার দেখা যায়নি।
শান্তি বাহিনীর রনকৌশল ছিলো খুবই রক্ষনাত্বক। এবং বেসামরিক টার্গেট নির্ভর। ১.বাঙালী বসতি গ্রামগুলোতে আক্রমণ চালিয়ে ঘুমন্ত নারীশিশুদের পাইকারি হারে হত্যা, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া।
২. রাস্তা ঘাট নির্মাণরত বাঙালী শ্রমিক হত্যা ও অপহরণ ক্ষেত্র বিশেষে মুক্তিপণ আদায়।
৩. সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারী যেমন ফরেস্ট বিভাগে কর্মরতদের অফিস লুন্ঠন ও অপহরণ।
৪. জরিপ কাজে নিয়োজিত দেশি বিদেশি কর্মীদের অপহরণের মাধ্যমে মুক্তিপন আদায়।
৫. থানা লুট। বাজার লুট।
৬. যাত্রীবাহী লঞ্চে আক্রমণ ও লুট।
৭. সীমান্ত পোস্টে আক্রমণ।
৮. ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, মেম্বার হেডম্যান কারবারিেদের হয় হত্যা, না হয় অপহরণ করে মুক্তিপন আদায় করা।
৯. কোন কোন ক্ষেত্রে অবাধ্য অন্য নৃগোষ্ঠীকে ( মুরং) হত্যা করা।
১০.বিস্ফোরকের সাহায্যে ব্রীজ কালভার্টে উড়িয়ে দেওয়া।
১১. সেনাবাহিনীর টহলদলের উপর অতর্কিত হামলা।
মেজর জেনারেল (অবঃ) সৈয়দ মোহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক লিখিত ” পারবত্য চট্টগ্রাম শান্তি প্রক্রিয়া ও পরিবেশ – পরিস্থিতির মূল্যায়ন গ্রন্হের ১১০-১১৮ পৃষ্ঠায় বর্নিত শান্তিবাহীনির উল্লেখ যোগ্য অপারেশন সমূহ অধ্যায়ে মোট ৮৮ টি ঘটনার কথা উল্লেখ আছে।
যেখানে ১৯৭৬ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত সংঘটিত ঘটনাগুলোর তথ্য সন্নিবেশিত করা আছে। এসব ঘটনাগুলোকে খাত অনুযায়ী ভাগ করলে দেখা যায় প্রায় ৫৫% শতাংশ আক্রমণের শিকার নিরস্ত্র বাঙালী বসতিস্হাপনকারী।
যেমনঃ
১. বাঙালী বসতিতে আক্রমণ অগ্নিসংযোগ নারী ও শিশু হত্যার ঘটনাঃ ৪৭ টি।
২.সেনা টহলের উপর আক্রমণঃ১৩ টি
৩. অপহরণ ও মুক্তিপন আদায়ঃ ৮টি।
৪. বিস্ফোরক ব্যবহারঃ৩টি
৫. লঞ্চ লুটঃ ৩টি
শান্তিবাহিনীর প্রথমদিকের রনকৌশল ছিলো ব্যাপকভাবে সন্ত্রাস ও নৃশংসতা চালিয়ে ভীতি সন্চার করা এবং চলাচলের পথকে অনিরাপদ করে তার সুরক্ষার জন্য বেশি বেশি নিরাপত্তা বাহিনীর লোক নিয়োগের মাধ্যমে সরকারের আক্রমণাত্বক শক্তিকে বেধে ফেলা। এক্ষেত্রে তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সফলতা লাভ করেছিলো।
তবে তাত্বিকভাবে বলা যায় শান্তিবাহিনী তার প্রাথমিক সাফল্য সত্বেও বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের যে চারটি ধাপঃ
১. প্রাথমিক ভাবে সংগঠন তৈরি, জনমত সৃষ্টি, বিরোধী নেতৃত্ব কে নির্মূল করে নিজেদেরকে জনগনের একক নেতৃত্বদানকারী সংগঠন হিসাবে প্রতিষ্ঠা করা। নিরাপওা বাহিনীর উপর হিট এন্ড রান ট্যাক্টিকস এপ্লাই করে ক্ষতিগ্রস্ত করা।
২. নিরাপত্তা বাহিনী কে কোনঠাসা করে আক্রমণাত্বক অভিযান পরিচালনা করা।অর্থাৎ “স্ট্যান্ড এন্ড ফাইট” সক্ষমতা অর্জন করা। নিরাপওা বাহিনীর কোন স্হাপনা দখলে নেওয়া।
৩. নিজেদের জন্য নিজ দেশের অভ্যন্তরে মুক্তাঞ্চল তৈরি করে নিরাপওা বাহিনীকে প্রবেশাধিকারে কার্যকর ভাবে বাঁধা দেওয়া এবং নিজস্ব প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ কায়েম করা।
৪. ওপেন হস্টিলিটি বা কনভেনশনাল যুদ্ধের মাধ্যম চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করা।।
শান্তিবাহিনী তার ২৩ বছরের সাংঘর্ষিক ইতিহাসে কখনোই প্রথম ধাপ থেকে দ্বিতীয় ধাপে উওীর্ন হতে পারেনি। শান্তি বাহিনীর মিএরা কখনোই শান্তিবাহিনী কে কোন মারাত্মক আক্রমণাত্বক অস্ত্রে সজ্জিত করেনি। পরিসংখ্যান বলে শান্তি বাহিনী কখনোই সেনাবাহিনীর কোন পোস্ট বা ক্যাম্প দখলে নিতে পারেনি। বা তাকে অবরোধের মধ্যে ফেলে ক্যাম্প ছেড়ে যেতে বাধ্য করতে পারেনি।
শান্তি বাহিনীর সংঘর্ষ জনিত সাফল্যগুলি রক্ষণাত্মক অপারেশন যেমন চলাচলের পথে এম্বুশ থেকে এসেছে। এবং এসব অপারেশনাল সাফল্যগুলো সেনাটহল দলের ক্যাম্পে ফেরার সময় ঘটেছে। এসব ক্ষেত্রে প্রথমদিকে (৭৬-৮০) নিয়োজিত সেনা ইউনিটগুলো যারা পাহাড়ে প্রথমবার এসেছে তারা অনভিজ্ঞতা এবং ফেরার পথে হালকা চালে পথ চলার কারনে ঘটেছে।
সেনাবাহিনীর কোন ক্যাম্পে প্রলয় সৃষ্টিকারী রেইড করেনি, কোন মর্টার বা হেভীমেশিনগানের ব্যবহার করেনি শান্তি বাহিনী। যা হয়তো তাদের অস্ত্র ও যথাযথ প্রশিক্ষনের অভারজনিত করানে হতে পারে।
কারন নিখুঁত মর্টার ফায়ার করার জন্য প্রচুর প্রশিক্ষন ও অনুশীলন দরকার। যদি শান্তি বাহিনী মর্টার ব্যবহারে পারদর্শী হতো তবে বিদ্যমান ক্যাম্পগুলোতে ওভারহেড প্রটেকশনের ব্যবস্হা থাকতে হতো। আমাদের সেনা ক্যাম্পগুলো প্রায় সবাই অবকাশ কেন্দ্রের মতো আরামদায়ক।
ভিয়েতনাম যুদ্ধের যেসব ফুটেজ আমরা দেখতে পাই বা ভারত- পাকিস্তানের সীমান্তের ‘এল ও সি’ বরাবর স্হাপনাগুলো আমাদের আক্রমণের ভয়াবহতাকে মনে করিয়ে দেয়।
শান্তিবাহিনীর অভিযানগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায় উওর-পূর্বে মিজোরাম বরাবর বা নদীপথে যাতায়াত করতে হয় এমন স্হানগুলোতো সেনাবাহিনীর হতাহতের সংখ্যা বা আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা বেশী
যেমনঃ এস ব্যান্ড, বরকল,ফারুয়া, ঘন্টিছড়া, কুকিছড়া,,,
শান্তি বাহিনীর সশস্ত্র সংগঠনে চাকমা-মারমা- এিপুরা ছাড়া বাকী অন্যান্য ক্ষুদ্রতর নৃগোষ্ঠির কারো কোন অংশগ্রহণ ছিলো না। নেতৃত্ব পর্যায়ে তো নয়ই।
১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৮৩ সালের ১৪ জুন পর্যন্ত শান্তি বাহিনীর ১২ জনের যে নেতৃত্বের প্যানেল ছিলো তার কোন স্হানেই কুকি বম- লুসাই ম্রো,মুরং,,,কারো কোন প্রতিনিধিত্ব নেই।
শান্তি বাহিনীর সীমান্ত পেরিয়ে বেশির ভাগ ক্যাম্প ( হেড কোয়ার্টার সহ) ছিলো ত্রিপুরা রাজ্যে যেখানে একটি বিরাট সংখ্যক চাকমা ও এিপুরা জনগোষ্ঠী বাস করে। এই রাজ্য থেকেই তারা যাবতীয় সাহায্য সহযোগিতা পেয়ে থাকে।
শান্তি বাহিনীর মূল স্হায়ী ক্যাম্পগুলো এই এিপুরা রাজ্যে অবস্থিত।
শান্তিবাহিনীর অস্থায়ী ক্যাম্পগুলোই শুধু দেশের অভ্যন্তরে ছিলো, যা তারা সময়ে সময়ে নিরাপওার খাতিরেই পরিবর্তন করতো। এসব ক্যাম্পে গেরিলাদের জীবন যাপন অত্যন্ত কষ্টকর। জোকঁ সাপ, পোকামাকড়, ম্যালেরিয়া ডায়রিয়া সহ যাবতীয় রোগ মোকাবিলা না করতে পেরে অনেকেই দল ছেড়ে চলে যেত। তাছাড়া প্রতিনিয়ত সেনাবাহিনী কর্তৃক আক্রান্ত হওয়ার মানসিক চাপ, কঠিন নিয়মশৃঙ্খলা মানা অনেকের জন্য অসহনীয় হয়ে উঠায় প্রচুর দল ত্যাগের ঘটনা ঘটতো। একসময় শান্তি বাহিনীর সংখ্যা ৮ হাজারের ঘরে ঠাঁই পেয়েছিলো। নেতৃত্বের কন্দোল ও জনপ্রিয়তা কমে যাওয়ায় তা একসময় অর্ধেকে নেমে আসে।
শান্তিবাহিনীর জন্য যুতসই নিরাপদ অস্হায়ী ক্যাম্প পাওয়া দূরুহ হয়ে উঠে যখন পার্টি বিভক্ত হয়। তারা অনেক সময়ে বহু আগে পরিত্যাক্ত ক্যাম্প বা আস্তানায় আবার ফিরে যায়। কারন রনকৌশল গত ভাবে সকল বিষয় মানা যায় এমন স্হান পাওয়া অতো সহজ নয়। যেমনঃ ১.আশেপাশের পাড়ার মানুষের বিশ্বস্ততা।
২. পাহাড়িদের সাধারণ চলাচলের পথের আশে পাশে না হওয়া। জুম বা বাঁশ গাছ কাটতে যেন আস্তনার আশেপাশে যেতে না হয়।
৩. মাথার উপরে সবুজ ক্যানোপি যেন হেলিকপ্টারের নজরে না পড়ে।
৪. উচঁ পাহাড় যেন দূরে স্পষ্ট দেখা যায়।
৫. সুপেয় পানির সংস্হান আছে কাছাকাছি কোন ঝর্না।
৬. পলায়নের গোপন পথ আছে। সেনাবাহিনীর আক্রমণ ঠেকিয়ে গোপন পথে আস্তনা ত্যাগ করা যায় এমন স্হান যেন সেনাবাহিনী ৩৬০ডিগ্রী ঘেরাও না করতে পারে।
এসব অস্হায়ী আস্তানার শেড বা ছাউনী গুলোতে কোন বেড়া থাকে না। তা মাটি থেকে একফুট উচ্চতার বাশেঁর মাচায় বিছানা। অকস্মাৎ গোলাগুলি শুরু হলে সবাই যার যার অস্ত্র নিয়ে ঢালু পাহাড়ের গা ধরে নীচে ঝাপিয়ে পড়ে। এসব পোস্টে কখনোই বাংকার থাকে না। কারন বাংকার এখানে তাদের অবস্হান ছিলো এ তথ্য প্রকাশ করে দিবে তাই পুনরায় কখনো এখানে ফেরত আসলে বিপদ বয়ে আনবে।।
দলগতভাবে শান্তি বাহিনীর কেউ পাড়ায় রাএিযাপন করে না। কারন পাড়ার সব লোক বিশ্বস্ত নয়। সাধারণ ভাবে তারা এিপুরা বা মারমা পাড়ায় অবস্থান করে না। দলনেতার জাত যে জাতিসত্বার তিনি সে রকম পাড়াতেই অবস্থান করেন। এিপুরাদের আর্থিক সংগতি কম বিধায় তারা কোন এিপুরা পাড়ায় খাবার বা আশ্রয় খোঁজেন না। রাএিযাপনের জন্য পরিত্যক্ত জুমঘর বা খোলা আকাশের নীচে পলিথিন ব্যবহার করে। এদের প্রত্যকের কাছে এক টুকরো নীল পলিথিন থাকে।
শান্তিবাহিনীর সদস্যরা তাদের প্রতি জনগনের কোন উৎসুক্যতা কে প্রশয় দেয় না। তাদেরকে কোন প্রশ্ন করা বা কোথায় যাবেন, কোথা থেকে এসেছেন এসব প্রশ্ন করাকে দারুন সন্দেহ দৃষ্টিতে দেখে।
শান্তি বাহিনী তাদেরে সশস্ত্র সংগ্রামের শুরুতে দারুন এবং একক জনপ্রিয়তা ও আনুকূল্য পেয়েছে। দলনেতাদের কথায় বিশ্বাস করেছে পাহাড় খুব দ্রুত স্বাধীন হয়ে যাবে। কোন বাঙালী থাকবে না ইত্যাদি ইত্যাদি। ১৯৮৩ সালে পার্টি বিভাজিত হলে সাধারণ মানুষ দারুন হতাশাগ্রস্হ হয়।
জনগনের এই হতাশা দূর করার জন্য এবং জেএসএস তাদের আন্দোলন কে আন্তর্জাতিকীকরনের জন্য বাঙালী পাড়ায় ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। তখন বাঙালী পাড়া গুলো বিভিন্ন জায়গায় অরক্ষিত বা নিরাপত্তা বলয়ের বাহিরে ছিলো বলে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়। সন্তুলারমা পরিকল্পিত ভাবে স্হানীয় পাহাড়ি জনগনকে বাধ্য করেছিলেন সীমান্ত পাড় হয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে যেন ভারতের একটা চাপ বাংলাদেশ সরকারের উপর আনা যায়। জেএসএস নেতৃত্ববৃন্দ সকল ক্ষেএে বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে যা যা ঘটছিলো তার হুবহু একটা কার্বনকপি পাহাড়েও চেয়েছিলেন।
আজ কেএনএফ র কর্মকাণ্ডও তাদের বড়জ্ঞাতি ভাই চাকমাদের অনুরূপ।
যেমনঃ
১. গতকিছুদিন থেকে দেখা যাচ্ছে তারা পাহাড়ে সফ্ট টার্গেট সড়ক নির্মাণ কাজে রত শ্রমিকদের অপহরণ করছে। ঠিক এমনটাই জেএসএস করতো।
২. কুকিরা রা আজ পাহাড়ে চাকমাদের মত বড়ভাই সেজে বসে আছে। তারা চাচ্ছে এখান থেকে সকল বম বা অন্যান্যদের মিজোরামে নিয়ে যেয়ে একটা শরনার্থী ইসূ তৈরি করতে। মায়ানমার থেকে বার্মাসেনাদের তৎপরতার কারনে যেসব জনজাতি ভারতে এসেছে এবং মিজোরাম সরকার তাদের শরনার্থী শিবিরে স্হান দিয়েছে কেএনএফ আজ তেমনটা চাচ্ছে।
৩. রুমা,থানচি বা বান্দরবানের এই এলাকায় তেমন বড় বাঙালী বসতি না থাকায় তারা এখনই কোন ব্যাপক বাঙালী নিধনে যাচ্ছে না, তবে পাহাড়ের নতুন সূর্য ” পর্যটন” এর আলোকে সন্ত্রাস দিয়ে ঢেকে দিতে বদ্দপরিকর।
৪. আগামীতে বাঙালী ভ্রমনকারীদের উপর আক্রমণ করে সকলের টনক নড়িয়ে দিতে চায় কেএনএফ।
৫. পাহাড়ের পর্যটনের বাড় বাড়ন্তকে জেএসএস এবং কেএমএফ উভয়েই দারুন ঈর্ষার চোখে দেখছে কারন এই ব্যবসাটা তারা ধরতে পারছে না। ব্যবসা করার জন্য যে বিনিয়োগ এবং বানিজ্যিক ভাবনা-কৌশল এসবে পারদর্শী না হওয়ায় সব রাগ ক্ষোভ ঠেকেছে সেনাবাহিনীর পরিচালিত কেন্দ্রে কিভাবে পর্যটক ঠেকানো যায় সেই ভাবনাতে।
৬. আগামী তে আমরা বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর ঘটনা দেখতে পারি কেএমএফ র দিক থেকে।যেমনঃ নারীশিশু সহ সপরিবারে কোন পর্যটকবাহী গাড়ীতে আক্রমণ ও অপহরণ। নিঃসন্দেহে দেশের আগামীতে নির্বাচন কে কেন্দ্র করে যে পরিবেশ বিরাজ করবে তাতে ওরকম কোন ঘটনা ঘটলে সেনাবাহিনীর কমান্ড সেন্টারকে দারুণভাবে বিব্রত করবে।
কেএনএফ র রনকৌশলঃ
আজকের কেএনএফ র সদস্যরা বেশ লেখাপড়া জানা এবং স্মার্ট প্রযুক্তিজ্ঞান সম্পন্ন। ইন্টারনেটে সহজলভ্য অন্য জাতির ট্রেনিং ভিডিও বা প্রোপাগান্ডা ভিডিও তাদেরকে জংগলে বসেই অনেক কিছু জানতে সহায়তা করে।
কেএনএফ র সদস্যদের গড় বয়স ২২/২৩। এই বয়সে একটা একে-৪৭ রাইফেল হাতে থাকলে নিজেকে দারুণ শক্তিশালী মনে হওয়া স্বাভাবিক। তার উপর “জাতির জন্য লড়াই করছি”- এই চেতনাবোধ একজন “চাকুরীরত সৈনিকের ” মানসিকতা কে ছাড়িয়ে যায়।
নিজের ভূমিতে আধুনিক অস্ত্রসম্বলিত এবং ‘জাতিবোধে’ উদ্বুদ্ধ তরুন খুবই মারাত্মক।
কেএনএফ র বর্তমান সদস্যদের সিংহভাগই বাংলাদেশের নাগরিক নয়। তারা মায়ানমার এবং ভারতের বৃহওর কুকি-চিন গোষ্ঠীর। এদের মধ্যে শিক্ষার হার অত্যন্ত বেশী হওয়ায় স্হানীয় পর্যায়ে তারা যুতসই চাকরী বা কর্মসংস্থানের সুযোগ না পাওয়ায় বা সর্বভারতীয় পর্যায়ে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে অনেকটা হতাশাগ্রস্ত। আর এটাই তাদের রিক্রুটমেন্টের হাই সেলিং পয়েন্ট।
শান্তি বাহিনীর অনেক গেরিলা তাদের রিক্রুটমেন্টের জন্য তৎকালীন নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে হেনস্তা, নিপীড়ন, গ্রেফতার বা অন্যান্য কারন উল্লেখ করলেও তেমনটা কেএনএফ দের ক্ষেত্রে শোনা যায়নি। কারন স্হানীয় কুকি রা সংখ্যায় যেমন কম শিক্ষাতেও পিছিয়ে পড়া। এখানে বছর খানেক আগেও কোন সন্ত্রাসী তৎপরতা ছিলো না। সেনাবাহিনীর হাতে নিপীড়িত হওয়ার মত কোন পরিবেশই ছিলো না। এটা হঠাৎ করে সীমান্তের ওপার হতে আসা এক উপদ্রুব।
কেএনএফ ব্যবহৃত অস্ত্র সরন্জাম পোশাকের সাথে মায়ানমার ভিওিক বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সাথে মিল খুবই তাৎপর্য পূর্ণ। এদের ব্যবহৃত অস্ত্রের মধ্যে গাধা বন্ধুক,কয়েকটি অটোমেটিক AK 47 মায়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠীর মতো আছে বলে প্রমাণ মিলে। এদের অবস্থান গুলোর চারপাশে ক্রল ট্রেন্চ, ওভারহেড প্রটেকশন সমৃদ্ধ বাংকার বলে দেয় তারা, স্ট্যান্ড এন্ড ফাইট” করার মত মনোবল সম্পন্ন। এটা অনুমেয় হয় যে এদের অবস্থানের চারপাশে মাইন পুঁতে রাখে যা রাখাইন ও আরাকান রাজ্যের মিয়ানমার সাময়িক জানতা ট্যাকটিস ফলো করে। তাদের এসব কৌশলের শিকার হচ্ছেন সেনাবাহিনীর টহল ও তাদের সাথে থাকা পাহাড়ি গাইড। স্হানীয় পাহাড়িদের কেউ এসব মাইনে হতাহত হলে তারা এর ভয়াবহতাকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছেড়ে একটা ভীতি ছড়াতে চায়। থানচি রোয়াংছড়ি রুমা এসব এলাকা রাঙামাটি খাগড়াছড়ির মত অতোটা ঘন বসতিপূর্ন না হওয়ায় মাইনপোতার তথ্য প্রায় সময়ই জনগনের মাধ্যমে নিরাপত্তা বাহিনীর কাছে পৌঁছায় না। তবে মাইন পোতার কৌশল কুকিদের ঐতিহ্যগত ফাঁদ পাতার কৌশলের সাথে মিলে যায়। কুকিরা বিভিন্ন বন্যপ্রানী শিকারে, প্রানীর আচার আচরণ সম্পর্কে দীর্ঘ পর্যবেক্ষণ করে এবং নানান কৌশলে শিকারকে ফাঁদ এলাকায় প্রবেশ করতে উৎসাহিত করে।।
কুকিরা স্নাইপার রাইফেলের উপর দক্ষ। ইসরায়েলের সেনাবাহিনীতে এদের অনেকেই স্নাইপার হিসাবে কাজ করছে।
কেএনএফ যে পর্যায়ে বর্তমানে প্রতিরোধ করছে তা খুবই অকল্পনীয় এবং শান্তি বাহিনীর প্রতিরোধ বা আক্রমণের ধারা থেকে ভিন্ন। আমার মতে কারন গুলো নিম্নরূপঃ
১. কেএনএফ র সদস্যরা তরুন, তুলনামূলক ভাবে বেশি শিক্ষিত এবং ইন্টারনেট প্রযুক্তির কারনে নানাভাবে স্বশিক্ষিত। ইন্টারনেট বা গুগলের কারনে বিশ্বের নানান প্রান্তের সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর ব্যবহৃত কলাকৌশল সহজেই রপ্ত করতে পারছে। উদাহরণঃ আই ই ডি র ব্যবহার। ইন্টারনেটের মাধ্যমে যে কেউ এখন যে কোন বিস্ফোরক তৈরির কৌশল, এর ডেটোনেটিং ডিভাইস তৈরি করতে পারে।
২. শিক্ষিত ও বেকার হওয়ায় তারা সহজেই হতাশা দূর করার জন্য এসব দলের মধ্যে বন্চনা লাঘবের উপায় খুঁজে পাচ্ছে। সীমান্তবর্তী দেশের মধ্যে ক্রিয়াশীল জ্ঞাতি গোষ্ঠীর দ্বারা আর্থিক, রাজনৈতিক, অস্ত্র ও সরঞ্জামাদির নিয়মিত সরবরাহ এবং মিজোরাম, মনিপুর, বার্মার চিন প্রদেশের কুকিরাও ব্যাপকভাবে সশস্ত যুদ্ধে স্হানীয় কুকিদের সাথে অংশ গ্রহন করছে। জেএসএস র সশস্ত্র সংগঠনে বিদেশি চাকমার উপস্থিতি দেখা যায়নি।
৩. তাদের প্রশিক্ষনে বিদেশি সহায়তা স্পষ্ট, তাদের আভ্যন্তরীন গোয়েন্দা কার্যক্রমও শক্তিশালী।
৪. তারা এ পর্যন্ত পুলিশ ও বিজেবিকে টার্গেট করেনি। স্হানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তা কাউকে টার্গেট করেনি। তারমানে হলো তারা এদের সবাইকে সেনাবাহিনী থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে চায়। সেনাবাহিনীর সাথে গেলে বা সহায়তা করলে তাদের বিপদ হবে। অতীতের স্মৃতি তাই বলে,প্রশাসনের অনেকে গোপন আঁতাতের মাধ্যমে তাদের কাছে থাকা গোপন সংবাদ প্রদান করে নিজেরা নিরাপদে থাকবে।
৫. নাসাকা বাহিনীর উখিয়া সীমান্ত বরাবর যততত্র মাইন পুঁতে রাখার সাথে কুকিদের বর্তমান কৌশলের মিল বার্মার কোন গোষ্ঠী বা সরকারের সাথে তাদের সহায়তার কোন যোগসূত্র থাকতে পারে।
৬. আগামীতে কুকিরা হাট বাজার বাসস্ট্যান্ড সহ জনবহুল এলাকায় বিস্ফোরণের মাধ্যমে আরো বড় চমক সৃষ্টি করতে পারে নিজেদের সক্ষমতা প্রমান করার জন্য। এরকম ঘটনা নির্বাচনের আগে ঘটার সমুহ সম্ভাবনা আছে।
লেখক-মেজর নাসিম হোসেন (অব:)
২২ জুন ২০২৩
লেখক-পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সামরিক বিশ্লেষক