পার্বত্য চট্টগ্রামে ‘সেটেলমেন্ট’ ও বাঙালি জনগণ: ইতিহাস, বাস্তবতা ও বিতর্ক।
কিশোর মাহমুদ
পার্বত্য চট্টগ্রামে ‘সেটেলমেন্ট’ শব্দটি ১৯৮০-এর দশকে বাংলাদেশ সরকারের বাঙালি পুনর্বাসন নীতির মাধ্যমে প্রচলিত হয়। এই শব্দটি এখন একটি বিতর্কিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে, যা বাঙালি জনগণের ঐতিহাসিক অবস্থান এবং পার্বত্য অঞ্চলের রাজনৈতিক ও সামাজিক গতিশীলতার সঙ্গে জড়িত। এই লেখায় সেটেলমেন্টের ঐতিহাসিক পটভূমি, এর উদ্দেশ্য, বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া, ‘সেটেলার’ শব্দের অপব্যবহার এবং বাঙালি জনগণের প্রকৃত অবস্থান বিশদভাবে আলোচনা করা হয়েছে।
সেটেলমেন্টের ঐতিহাসিক পটভূমি—
পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের একটি ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন এবং জাতিগতভাবে বৈচিত্র্যময় অঞ্চল। এখানে উপজাতি সম্প্রদায়ের পাশাপাশি বাঙালি জনগণ দীর্ঘকাল ধরে বসবাস করে আসছে। ১৯৮০-এর দশকে বাংলাদেশ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙাল
‘পুনর্বাসন’ নীতি গ্রহণ করে, যার মাধ্যমে সমতলের বাঙালি জনগণকে এই অঞ্চলে স্থানান্তর করা হয়। এই নীতির পেছনে ছিল রাষ্ট্রীয় স্বার্থ, যার মধ্যে পার্বত্য অঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন দমন এবং রাষ্ট্রের আধিপত্য জোরদার করা অন্যতম।
‘পুনর্বাসন’ শব্দটি সাধারণত ভূমিহীন, বেকার বা শরণার্থীদের জন্য ব্যবহৃত হয়। কিন্তু এই ক্ষেত্রে বাঙালি জনগণ এই শ্রেণিতে পড়েনি। তারা স্বাধীন, স্বনির্ভর এবং কর্মক্ষম ছিল। তবুও, সরকার তাদের ‘ভূমিহীন’ হিসেবে চিহ্নিত করে খাসজমি বা বেসরকারি জমিতে বসতি স্থাপনের সুযোগ দেয়। সরকারি নথিতে এই প্রক্রিয়াকে ‘পুনর্বাসন’ বা ‘সেটেলমেন্ট’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়, যা পরবর্তীতে ‘সেটেলার’ শব্দে রূপান্তরিত হয়।
সেটেলমেন্টের বাস্তবায়ন—
সরকারি নথি, যেমন রাঙ্গামাটির ডেপুটি কমিশনারের কার্যালয় থেকে জারি করা মেমো (নং ১০২৫(৯)সি, ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৮০), এই প্রক্রিয়ার বিস্তারিত বিবরণ দেয়। এই নথি অনুযায়ী, প্রতি পরিবারকে পুনর্বাসন কেন্দ্রে পৌঁছানোর জন্য ২০০ টাকা, পুনর্বাসন ব্লকে পৌঁছানোর পর ৫০০ টাকা এবং পরবর্তী ৫ মাসের জন্য মাসিক ২০০ টাকা অনুদান দেওয়া হতো। এছাড়া, ৬ মাসের জন্য প্রতি পরিবারকে সপ্তাহে ১২ সের আটা প্রদান করা হতো ‘ফুড ফর ওয়ার্ক’ কর্মসূচির আওতায়। এই কর্মসূচির মাধ্যমে বাঙালি পরিবারগুলো বাড়ি নির্মাণ, জমি পুনরুদ্ধার, গ্রামীণ সড়ক নির্মাণ এবং পুকুর খননের কাজে নিয়োজিত হতো।
পরবর্তীতে, প্রতি পরিবারকে ৩ থেকে ৫ একর জমি বন্দোবস্ত হিসেবে দেওয়া হয় এবং রেশন কার্ড প্রদান করা হয়। এই সুবিধাগুলো সাধারণত ভূমিহীন বা শরণার্থীদের জন্য নির্ধারিত থাকলেও, এই ক্ষেত্রে বাঙালি জনগণকে রাষ্ট্রীয় স্বার্থে এই সুবিধা সরবরাহ করা হয়। এই প্রক্রিয়া থেকে স্পষ্ট যে, সরকার বাঙালিদের ‘মানবঢাল’ হিসেবে ব্যবহার করেছে, যাতে পার্বত্য অঞ্চলের উপজাতি জনগণের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
সেটেলমেন্টের উদ্দেশ্য ও রাষ্ট্রীয় স্বার্থ—
পার্বত্য চট্টগ্রামে সেটেলমেন্ট নীতির পেছনে রাষ্ট্রীয় স্বার্থ ছিল প্রধান চালিকাশক্তি। ১৯৭০-এর দশকের শেষভাগে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিবাহিনীর নেতৃত্বে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন শুরু হয়। এই আন্দোলন দমনের জন্য সরকার সামরিক ও বেসামরিক উভয় কৌশল গ্রহণ করে। বাঙালি পুনর্বাসন ছিল এই কৌশলের একটি অংশ। সরকারের উদ্দেশ্য ছিল পার্বত্য অঞ্চলে বাঙালি জনসংখ্যা বৃদ্ধি করে জাতিগত ভারসাম্য পরিবর্তন করা এবং রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ জোরদার করা।
তবে, এই নীতি বাঙালি জনগণের জন্যও চ্যালেঞ্জিং ছিল। সমতলের বাঙালিরা পাহাড়ি পরিবেশ, ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক পার্থক্য এবং স্থানীয় উপজাতি জনগণের বিরোধিতার মুখোমুখি হয়। সরকারি সহায়তা সত্ত্বেও, অনেক পরিবার জীবিকা নির্বাহে হিমশিম খায়। উপরন্তু, এই নীতি বাঙালি ও উপজাতি সম্প্রদায়ের মধ্যে উত্তেজনা বাড়িয়ে দেয়, যা আজও অমীমাংসিত রয়েছে।
‘সেটেলার’ শব্দের অপব্যবহার—
‘সেটেলমেন্ট’ থেকে ‘সেটেলার’ শব্দটি উদ্ভূত হয়, যা পরবর্তীকালে বাঙালি জনগণের প্রতি অপমানজনক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সরকার ও সেনাবাহিনী এই শব্দটি ব্যবহার করে বাঙালিদের এমনভাবে চিহ্নিত করে, যেন তারা এই অঞ্চলে বহিরাগত বা আক্রমণকারী। পার্বত্য উপজাতি সম্প্রদায়ের মধ্যে এই শব্দটি ঘৃণা ও তাচ্ছিল্যের প্রতীক হয়ে ওঠে। ফলে, বাঙালিরা নিজেদের পরিচয় নিয়ে অস্বস্তিতে পড়ে এবং তাদের ঐতিহাসিক অবস্থান প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
‘সেটেলার’ শব্দের এই অপব্যবহার জনগণের প্রতি একটি সামাজিক ও মানসিক চাপ সৃষ্টি করে। এটি এমন একটি ধারণা তৈরি করে যে, বাঙালিরা এই অঞ্চলে অবৈধভাবে বসবাস করছে, যা ঐতিহাসিকভাবে ভুল। এই শব্দটি বাঙালি ও উপজাতি সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভাজনকে আরও গভীর করে এবং পারস্পরিক অবিশ্বাস বাড়ায়।
বাঙালির ঐতিহাসিক অবস্থান—
পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালির বসবাস শতাব্দীপ্রাচীন। ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী, উপজাতি সম্প্রদায় যখন ১৭০০ সালের দিকে এই অঞ্চলে আসে, তখন বাঙালি সম্প্রদায়ের উপস্থিতি ছিল। ব্রিটিশ আমলে এবং তারও আগে বাঙালিরা এই অঞ্চলে ব্যবসা, কৃষি এবং প্রশাসনিক কাজে নিয়োজিত ছিল। তারা কখনোই ‘আক্রমণকারী’ বা ‘বহিরাগত’ হিসেবে বিবেচিত হয়নি। বরং, তারা পার্বত্য অঞ্চলের স্বাভাবিক বাসিন্দা হিসেবে জীবনযাপন করেছে।
বাঙালির এই ঐতিহাসিক অবস্থান সত্ত্বেও, ‘সেটেলার’ শব্দটি তাদের পরিচয়কে বিকৃত করে। এটি এমন একটি ধারণা তৈরি করে যে, বাঙালিরা এই অঞ্চলে সাম্প্রতিক সংযোজন, যা তাদের অবদান ও অধিকারকে অস্বীকার করে। বাঙালিরা পার্বত্য চট্টগ্রামের অর্থনীতি, শিক্ষা এবং সংস্কৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, যা এই শব্দের মাধ্যমে অবমূল্যায়িত হয়।
‘সেটেলার’ চিহ্নিতকরণ: রাজনৈতিক কৌশল—
বাঙালিদের ‘সেটেলার’ হিসেবে চিহ্নিত করা একটি রাজনৈতিক কৌশল, যার উদ্দেশ্য বাঙালি ও উপজাতি সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করা। এটি পার্বত্য চট্টগ্রামের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঐক্যকে দুর্বল করে এবং রাষ্ট্রীয় নীতির সমালোচনাকে অন্যদিকে সরিয়ে দেয়। এই শব্দটি বাঙালিদের প্রতি একটি নেতিবাচক ধারণা তৈরি করে, যা তাদের সামাজিক মর্যাদা ও নিরাপত্তার ওপর প্রভাব ফেলে।
এই চিহ্নিতকরণ ঐতিহাসিকভাবে ভুল এবং অযৌক্তিক। বাঙালিরা কখনো বন্দি শিবিরে বাস করেনি বা সরকারি আশ্রয়ের জন্য আবেদন করেনি। তারা এই অঞ্চলের স্থানীয় বাসিন্দা হিসেবে বহু বছর ধরে বসবাস করছে। ‘সেটেলার’ শব্দটি তাদের প্রকৃত অবস্থানকে বিকৃত করে এবং তাদের অধিকার ও পরিচয়ের প্রতি অবিচার করে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালিদের ‘সেটেলার’ হিসেবে চিহ্নিত করা একটি ঐতিহাসিক ভুল এবং অবমাননাকর পদক্ষেপ। এই শব্দটি বাঙালি জনগণের ঐতিহাসিক অবস্থান, অবদান এবং অধিকারকে অস্বীকার করে। পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস ও সমাজে বাঙালিরা একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাদের ‘সেটেলার’ হিসেবে চিহ্নিত করার পরিবর্তে, তাদের স্থানীয় বাসিন্দা হিসেবে সম্মান করা উচিত।
বাঙালি ও উপজাতি সম্প্রদায়ের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সহযোগিতা প্রতিষ্ঠার জন্য এই বিভাজনকারী শব্দ ও ধারণা পরিহার করা প্রয়োজন। পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তি ও সমৃদ্ধি নির্ভর করে সকল সম্প্রদায়ের ঐক্য ও সহাবস্থানের ওপর। সরকার, সমাজ এবং গণমাধ্যমের উচিত বাঙালিদের প্রকৃত ইতিহাস ও অবদানকে স্বীকৃতি দেওয়া এবং তাদের প্রতি ন্যায্য আচরণ নিশ্চিত করা।