সেই দুই যমজ বোন এখন মিলিয়নিয়ার

0

অনলাইন ডেস্ক- আনাই মগিনি ও আনুচিং মগিনি দুজনে প্রায় এক সঙ্গে পৃথিবীতে আসায় হতাশ হয়েছিলেন তাঁদের বাবা-মা। অথচ দুই বোনই এখন পরিবারটির আশার প্রদীপ।

‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ, মাতৃ জরায়ু থেকে নেমেই জেনেছি আমি…’ কবিতার এই লাইনটি যেন দুই যমজ বোনের জীবন থেকে নেওয়া। তাঁরা পৃথিবীর আলোয় আসায় উৎসব হয়নি। দুজনেই কন্যা সন্তান হওয়ায় বাবা-মার দুশ্চিন্তা ছিল। সময়ের পালা বদলে সেই দুশ্চিন্তা আজ উৎসবের শঙ্খধ্বনি।

পাহাড়ি অঞ্চলে বসবাস। এক বেলা মুখে খাবার উঠলে আরেক বেলা উপোস। এমন পরিবারে অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীর জন্য ছিল না কোনো বিশেষ ব্যবস্থা। একদিন আপ্রুমা মগিনি বুঝতে পারলেন, তাঁর বাচ্চা নড়াচড়া করছে না! পরিবারটির উৎকণ্ঠা বেড়ে গেল। সুস্থ-সবল বাচ্চার জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করা ছাড়া আর কিছুই তো করার নেই রিপ্রু-আপ্রমা মগিনি দম্পতির। কিন্তু ঘর আলো করে ঠিকই এল ফুটফুটে এক শিশু। তাকে নিয়ে সবাই ব্যস্ত হয়ে ওঠার মধ্যেই বিস্ময়করভাবে দুই মিনিটের ব্যবধানে আরেক নবজাতকের আগমন। কোথায় উৎসব হবে, তা না, পরিবার তখন দুশ্চিন্তার ঘেরাটোপে। কারণ দুই যমজ শিশু যে কন্যা সন্তান!

তিন ছেলে ও দুই মেয়ে নিয়ে এমনিতেই রিপ্রু-আপ্রমা মগিনি দম্পতির বড় পরিবার। সেখানে যোগ হলো আরও দুটি মুখ। খাবারের সংস্থান নিয়ে বাড়ির কর্তা কৃষক রিপ্রু মগিনি ভীষণ দুশ্চিন্তায়। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি হয়ে উঠল এমন—‘যমজ দুই মেয়ে পরিবারের আপদ।’ হতাশার সেই গল্পটা দুই যমজ মেয়ের বাবা রিপ্রুর মুখ থেকেই শুনুন, ‘পরিবারের কেউ জানতাম না আমার স্ত্রীর গর্ভে দুটি বাচ্চা। প্রথম বাচ্চা জন্ম নেওয়ার পর ভালোই লাগল। কিন্তু যমজ বাচ্চা দেখে অবাক হলাম, খারাপও লাগল। অভাবের পরিবার। কী দিয়ে কী করি?।’ দিনটা রবিবার মনে থাকলেও দুই যমজ মেয়ের পৃথিবীর আলো দেখার দিন-তারিখ এমনকি বছরও মনে নেই বাবার!

সেই দুই যমজ শিশুই আজকের জাতীয় নারী দলের দুই ফুটবলার আনুচিং মগিনি ও আনাই মগিনি (বড়)। দুই বোনই কয়েক বছর ধরে খেলছেন জাতীয় দলে। একই সঙ্গে বয়সভিত্তিক দলেরও নিয়মিত মুখ। গত মাসে তাঁদের দুর্দান্ত নৈপুণ্যের ওপর ভর করে এএফসি অনূর্ধ্ব বাছাইপর্বে ‘এফ’ গ্রুপের চ্যাম্পিয়ন হয়ে দ্বিতীয় পর্বে পা রেখেছে বাংলাদেশ। বৃহস্পতিবার গণভবনে ডেকে দলের প্রত্যেক সদস্যের হাতে ১০ লাখ টাকা করে তুলে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর এতেই ‘মিলিয়নিয়ার’ হয়ে গিয়েছে দুই বোন—সেই দুই যমজ মেয়ে, যারা পৃথিবীতে এসেছিলেন পরিবারের আপদ হয়ে!

বিপ্রু ও আপ্রমা মগিনির ছেলেরা বিয়ে করে আলাদা হয়ে গিয়েছেন। বড় দুই মেয়েও বিয়ে করে স্বামীর পরিবারে। বাবা-মায়ের ভরণ-পোষণের ভারটা আনাই ও আনুচিং তাই নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে ১০ লাখ টাকার চেক পেয়েই ওঁরা বাবা-মাকে জানিয়ে দিয়েছে, ‘তোমাদের আর কষ্ট করতে হবে না।’ ফুটবল খেলে এর আগেও তাঁদের উপার্জন হয়েছিল বেশ। যা দিয়ে অসচ্ছল পরিবারের মুখে ফুটেছিল হাসি। আর এখন দুই হাত মিলে এক সঙ্গে ২০ লাখ টাকা।

টাকা দিয়ে কী, কী করবেন তাও ঠিক করে ফেলেছেন আনুচিং-আনাইয়ের বাবা-মা। মেয়েদের ভবিষ্যতের কথা ভেবেই কিছু পরিকল্পনার কথা শোনালেন তাঁদের বাবা রিপ্রু, ‘আমি খেতে কাজ করে যা আয় করি, তা দিয়ে সংসার এখন চলে যাচ্ছে। তাই চিন্তা করেছি এবারের পাওয়া টাকার থেকে কিছু ব্যাংকে রাখব। জায়গা দেখছি, দুই বোনের নামে কিছু জায়গা কিনব।’

খাগড়াছড়ির সাতভাইয়া গ্রামে এরই মধ্যে প্রবারণা পূর্ণিমার হাওয়া লাগতে শুরু করেছে। বিপ্রু ও আপ্রমা মগিনি অপেক্ষায়। এবারের প্রবারণা পূর্ণিমায় তাঁদের দুই যমজ প্রদীপের দেখা মিলবে তো? প্রতিবেশীরা এসেও দুই বোনের কথা জানতে চায়, তোমাদের মেয়ে দুটি এবার থাকছে তো? ওদিকে দম ফেলার ফুসরত নেই দুই বোনের। প্রায় সারা বছরই ঢাকায় ক্যাম্প। একটির পর একটি টুর্নামেন্ট লেগেই থাকে। আজ এই দেশ তো কাল অন্য দেশে। এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ প্রাক-বাছাইয়ের পর ভুটানে অনূর্ধ্ব ১৮ সাফে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে দল। সামনে এখন আরও বড় চ্যালেঞ্জ এএফসি অনূর্ধ্ব-১৯ নারী বাছাইপর্ব। এ জন্য সপ্তাহখানেক পরেই ছুটতে হবে তাজিকিস্তানে। দুই যমজ বোনকে ছাড়া এখন বাংলাদেশ দলের কথা ভাবাই যায় না।

মেয়েদের খেলা থাকলেই দুই বোনের ছবি ভেসে ওঠে টিভির পর্দায়, পত্রিকার পাতায় বড় ছবি। রিপ্রু ও আপ্রুমা মগিনির তখন ভীষণ গর্ব হয়। এই আধুনিক সময়েও কন্যা শিশুকে খাটো চোখে দেখা প্রচলিত সমাজকে তাঁরা মেয়েদের ছবি দেখান। আর হয়তো আনমনে বলে ওঠেন, যাঁদের আবির্ভাবে একদিন চোখে আঁধার দেখেছি আজ তাঁরা-ই আমাদের আশার প্রদীপ।

 

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More