পার্বত্য চট্টগ্রাম, পার্বত্য চুক্তি- প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা-মেজর জেনারেল মো: নাঈম আশফাক চৌধুরী।

0

প্রেক্ষাপট

পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের একটি অত্যন্ত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত অঞ্চল। মুঘল আমল থেকে (১৬৬৬ থেকে ১৭৬০ সাল) যা কর্পাস মহল নামে পরিচিত ছিল এবং ব্রিটিশ আমলে তা Chittagong Hill Tracks সংক্ষেপে CHT নাম ধারণ করে। অঞ্চলটি পার্বত্য ও জঙ্গলাকীর্ণ হওয়ায় দুটি কারণে বিভিন্ন উপজাতিরা অত্র অঞ্চলে আগমন করে এবং বসবাস শুরু করে। প্রথমত: দূর্গম ও বিশেষ ব্যবস্থায় বসবাস, চাষাবাদ, জীবিকা অর্জন ও পার্শ্ববর্তী দেশ গুলোর তুলনায় অপেক্ষাকৃত নীচু ও ভাল ভূমিপ্রকৃতি, চলাচলের উপযোগী বিধায় দূর্গম পাহাড়ে বসবাসে অভ্যস্ত বিশেষ সম্প্রদায়ের লোকেরা ত্রিপুরা, মিজোরাম, আসাম, আরাকান ইত্যাদি অঞ্চল থেকে এই অঞ্চলে এসে প্রথম বসবাস শুরু করে। দ্বিতীয়তঃ আরকান রাজ্যের অস্থিরতা, যুদ্ধ বিগ্রহের কারনে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে আগমন। এরমধ্যে ১৭৮৪ সালে বার্মার (মধ্যবার্মা) রাজা বাদপায়া’র আরাকান রাজ্য আক্রমণ ও রাজ্য দখল অন্যতম। এই যুদ্ধের ফলে অনেক উদ্বাস্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে আশ্রয় নেয়। বিশেষ করে আরাকান থেকে খুমি, চাকমা ও মারমাদের আগমন উল্লেখযোগ্য। ইংরেজ শাসনামলে (১৭১০ সাল থেকে) এই দূর্গম অঞ্চলে খাজনা আদায়ের জন্য চাকমা সার্কেল, মারমা সার্কেল ও বোমাং সার্কেল নামে তিনটি ভাগে বিভক্ত করে এবং প্রত্যেক সার্কেলে একজন করে চীফ নির্ধারণ করে দেয়, যা ব্রিটিশ আমলের রাজ্য প্রথারই শামিল। পাকিস্তান স্বাধীন হবার পর, ১৯৪৭ সালে স্নেহকুমার চাকমা রাঙামাটিতে ভারতের পতাকা উড়িয়েছিলেন। আবার ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানের পতাকা উড়ানো হয়েছিল। চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় (বর্তমান চাকমা সার্কেল চীফ ব্যরিষ্টার দেবাশীষ রায় এর পিতা) পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধীতা করে পাকিস্তানে চলে যান। পাকিস্তানে রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ ও পরবর্তীতে মন্ত্রিত্বও পান। ২০১২ সালে পাকিস্তানেই মৃত্যুবরণ করার পর সেখানেই সমাধিস্থ করা হয়। পাকিস্তান শাসনামলে ১৯৬২ সালে ৮০ মেগাওয়াটের (পরবর্তিতে ২৩০ মেগাওয়াট) জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্যে ৪৫.৭ মিটার উচ্চতার কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে প্রায় ৫৪,০০০ একর জলমগ্ন ও ডুবে যাওয়াতে এই এলাকায় প্রায় ১,০০,০০০ বসবাসকারী চাকমা জনগোষ্ঠী বাস্তুচ্যুত হয় এবং যা প্রথম অসন্তোষের বীজ বপন করে। ক্ষতিপূরণ বাবদ ৪ কোটি ১৫ লক্ষ টাকা বরাদ্দ হলেও চাকমাদের দাবী অনুযায়ী সব অর্থ তা ক্ষতিগ্রস্থদের কাছে পৌঁছায়নি বা তাদের ন্যায্য হিস্যা পায়নি বলে দাবী করে। ফলে অসন্তোষ আরো গভীর হতে গভীরতর হতে থাকে।

স্বাধীনতা পরবর্তীর্তে ১৫ ফেব্রুয়ারী ১৯৭২ সালে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস) গঠন করেন। পরবর্তীতে ১৯৭৩ সালে পিসিজেএসএস শান্তিবাহিনী নামে সশস্ত্র শাখা প্রনয়ন করে এবং গোপনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, তৎকালীন বিডিআর, পুলিশ, আনসার সহ অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে ১৯৭৬ সাল থেকে সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত হয়। যা একটি স্বাধীন দেশের ভিতর থেকে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম ও দেশদ্রোহীতার শামীল। ফলশ্রুতিতে বহু দেশপ্রেমিক সেনা সদস্য, নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য, নিরাপরাধ বেসামরিক ব্যক্তিবর্গের (আনুমানিক ৩০,০০০) প্রাণহানি ঘটে। শান্তিবাহিনী একদিকে যেমন স্থানীয় বাংগালী ও উপজাতিদের জুলুম, নির্যাতন, চাঁদাবাজিতে মেতে উঠেছিল, অন্যদিকে পার্শ্ববর্তী দেশের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে নিজেদের বিপথে যাবার পথকে আরো সুগম করেছিলো। প্রাথমিকভাবে নব্য গঠিত বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দূর্গম অঞ্চলে অভিযান পরিচালনা করতে গিয়ে অত্যন্ত দুর্গম এলাকা, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন, প্রতিকূল পরিবেশ ও ম্যালেরিয়া, কাউন্টার ইন্সারজেন্সি অপারেশন ইত্যাদি কারণে সেনাবাহিনীসহ নিরাপত্তা বাহিনীর হতাহতের পরিমান বাড়তে থাকে। কিন্তু পরবর্তীতে সরকারের সঠিক দিক নির্দেশনা, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, স্থানীয় পাহাড়ী-বাঙ্গালী জনগণের সমর্থন এবং সর্বোপরি কাউন্টার ইন্সারজেন্সি অভিযানে সেনাবাহিনীসহ আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর দক্ষতা ও উপর্যোপরি আক্রমনের মুখে টিকে ওঠতে না পেরে শান্তিবাহিনী সরকারের সাথে আলোচনায় বসতে বাধ্য হয়। সরকারের সাথে দীর্ঘ আলাপ আলোচনার পর ২ ডিসেম্বর ১৯৯৭ সালে তৎকালীন আওয়ামীলীগ সরকারের সাথে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি এর ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা পার্বত্য চুক্তি হিসেবে পরিচিত এবং এই চুক্তির ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামে দীর্ঘ ২২ বছরের সশস্ত্র সংগ্রামের কিছুটা পরিসমাপ্তি ঘটে।

পার্বত্য চুক্তি

পার্বত্য চুক্তির চারটি অধ্যায়, সাধারন, পার্বত্য জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদ/পার্বত্য জেলা পরিষদ, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ এবং পুনর্বাসন, সাধারণ ক্ষমা প্রদর্শন ও অন্যান্য বিষয়াবলি। চুক্তিটি পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিদের স্বতন্ত্র জাতিস্বত্তা এবং বিশেষ মর্যাদাকে স্বীকৃতি দিয়েছে। পার্বত্য চুক্তির পর শান্তিবাহিনীর কিছু সংখ্যক সদস্য আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের অস্ত্র সমর্পন করে। আর্থিক ক্ষতিপুরনসহ জীবিকা অর্জনের জন্য বহু প্রাক্তন শান্তিবাহিনীর সদস্যকে পুনর্বাসন করা হয়। ইতিমধ্যে সাত শতাধিক অস্ত্র সমর্পনকৃত শান্তিবাহিনীর সদস্যকে পুলিশে চাকুরী প্রদান করা হয়েছে। প্রায় ৫০,০০০ এর বেশী ব্যাস্তচ্যুত উপজাতিকে তাদের স্বীয় বাড়িতে পুনঃস্থাপন করা হয়। পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে ইতিমধ্যে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ৩২টি বিষয়াবলীর ২২টি জেলা পরিষদকে হস্তান্তর করা হয়েছে। নতুনভাবে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন করা হয়েছে। পক্ষান্তরে পার্বত্য চুক্তির বিভিন্ন ধারা উপধারা নিয়ে পাহাড়ী-বাঙ্গালী ও সচেতন মহলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন ১৯৯৮, পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন ২০০১, পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন (সংশোধিত) ২০১৬ ইত্যাদি প্রণয়ন করা হয়। সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার, উপজাতিদের অংশগ্রহণ, পুলিশ ফোর্স গঠনসহ পার্বত্য চুক্তির বেশীর ভাগ (৭২ টি ধারার ৪৮ টি) ধারা বাস্তবায়ন হলেও কিছু কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যেমন ভূমি সমস্যা সমাধান, কার্যকরী জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদ গঠন ইত্যাদি বিষয়ে যৌক্তিক ও আইনগত জটিলতার সৃষ্টি হয়।

পার্বত্য চুক্তির সবচেয়ে বড় অর্জন হলো সশস্ত্র অধ্যায়ের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি এবং সংক্ষুব্ধ গোষ্ঠির দাবীর প্রতি সরকারের যথাযথ সম্মান প্রদর্শন, দৃষ্টিপাত ও বাস্তবায়ন। সামগ্রিক বিবেচনায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীসহ আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর রক্ত, ঘাম, শ্রম, বুদ্ধিমত্তা, প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও অন্যান্য সংশ্লিষ্টদের কঠোর পরিশ্রম, সাধারন জনগনের সমর্থন এবং সর্বোপরি রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, সংলাপ ও সঠিক দিক নির্দেশনা এবং বাঙ্গালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের কন্যা তৎকালীন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও সদিচ্ছার কারণে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে পার্বত্য চট্টগ্রামে অর্থনৈতিক, অবকাঠামোগত, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পর্যটন, ব্যবসা-বাণিজ্য, যোগাযোগ ব্যবস্থা ইত্যাদির উন্নয়ন হয়েছে। এতে পাহাড়ী জনগোষ্ঠী তাঁদের উৎপাদিত পণ্য স্থানীয় জেলা শহর হয়ে, ঢাকাসহ সারাদেশ এমনকি বিদেশেও রপ্তানি করছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার আমুল পরিবর্তনের ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের দূর্গম অঞ্চলে বিদ্যুৎ, শিক্ষা, ব্যবসা বাণিজ্যেও প্রসার ঘটেছে। সমতলের জনগোষ্ঠীর সাথে পাহাড়ের জনগোষ্ঠীর সংযোগ আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। যে পাহাড়ী জনগোষ্ঠী পার্বত্য চট্টগ্রামের ভিতরেই তাঁদের সকল সামাজিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয়, শিক্ষা, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড সীমাবদ্ধে থাকত, আজ তাঁদের সকল কর্মকান্ডের বিস্তৃতি দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও ছড়িয়েছে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মহল বিশেষ করে INGO, NGO বিভিন্ন পশ্চিমাদেশ, দেশে সুশীল সমাজ আগ্রহী হয়ে উঠেছে এই পার্বত্য জনগোষ্ঠী নিয়ে।

চলমান পরিস্থিতি

পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে ভূ-কৌশলগত রাজনীতি বহুদিনের পুরোনো। এ অঞ্চলকে পৃথকিকরণ জনগোষ্ঠীর ভারসাম্য বিনষ্টিকরণ এবং ধর্মান্তকরণের এই অপচেষ্টা সবই চলমান। পার্বত্য চট্টগ্রামের দীর্ঘদিনের চাকুরীর অভিজ্ঞতায় অনেক কিছু প্রত্যক্ষ করেছি সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি অত্যন্ত স্পষ্ট যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিভক্তিরণের রাজনীতি কখনো উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রার সহায়ক নয়। এই ধারা পরবর্তী প্রজন্মকে পথভ্রষ্ট করতে সহায়ক হচ্ছে এবং হবে, যদি না এখনি কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। পার্বত্য অঞ্চল ভূমির প্রকৃতিগত গঠন অনুযায়ী বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে ভিন্নতর। দুর্গম ও জঙ্গলাকীর্ণ হওয়ায় এই অঞ্চল বাংলাদেশের মূল ধারা ও অন্যান্য জেলা থেকে পিছিয়ে পরেছিল। তাই বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের অগ্রযাত্রার সাথে সাথে পার্বত্য চট্টগ্রামকে মূল ধারায় ফিরিয়ে আনতে কাজ করছে সরকার। সে সাথে জাতিগত বৈশিষ্ট্য, ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালনের অধিকারও নিশ্চিত করেছে বাংলাদেশ সরকার। পার্বত্য চট্টগ্রামে বর্তমানে যে সকল উপজাতি সম্প্রদায় বসবাস করছে তারা কেউই এই অঞ্চলের মূল অধিবাসী নয়। বিগত কয়েকশো বছরের মধ্যে তারা সকলেই পার্শ্ববর্তী অঞ্চল হতে আগমন করে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসতি স্থাপন করছে। অথচ ২০০৯-১০ সালে কিছু কুচক্রিমহল আদিবাসী ইস্যু তুলে এ দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করেছিল। এমনকি তাদের এই ষড়যন্ত্রের তীর জাতিসংঘ পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল। সরকারের যথাযথ ও সময়োপযোগী পদক্ষেপের কারনে তাদের এই ষড়যন্ত্র বাস্তবায়িত হয়নি। পরবর্তীতে সরকারী প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে এই ‘আদিবাসী বা indigenous’ শব্দটি রহিত করে ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী বা উপজাতি হিসাবে আখ্যা দেওয়া হয়। যা এখন সকলের মেনে চলাই শ্রেয়।

২০১১ সালে চট্টগ্রামের ২৪ পদাতিক ডিভিশনে চাকুরীর সুবাদে অনন্য ও বিষ্ময়কর এক অভিজ্ঞতা হয়েছিলো। স্বচক্ষে দেখেছি বাংলাদেশের স্বনামধন্য কিছু ব্যক্তিরা সুশীল সমাজ, INGO, NGO ও বামপন্থী লোকজন টাকার বিনিময়ে কিভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের দোহাই তুলে সরকারের ও আইনশৃংখলা বাহিনীর কার্যক্রমের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলেছেন। গুইমারার এলাকায় এক ছোট মেয়ের গায়ে লাল রং মাখিয়ে ছবি তুলে তাকে অত্যাচার করা হয়েছে বলে নিরাপত্তা বাহিনীর উপর কটাক্ষ করা হয়েছিল। ঐ সকল তথাকথিত মানবাধিকার কর্মীকে যখন সকল প্রমাণ সহ ঘটনার মূল চিত্র দেখানো হলো তখন সেসব দেশদ্রোহীদের ষড়যন্ত্র নিমিষেই চুকিয়ে যায়। সচেতনমহল, বাঙালী ও বুদ্ধিজীবি তাদের এই হীন উদ্দেশ্য, অর্থায়ন উৎস এবং অবিচ্ছিন্ন আঞ্চলিক দলগুলোর অহরহ চাঁদাবাজি ও অপকর্ম নিয়ে প্রশ্ন তুলতেই পারেন।

পার্বত্য চট্টগ্রামের আরেকটি মূল সমস্যা হলো ভূমি সমস্যা। পার্বত্য চুক্তি অনুযায়ী সরকার ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন ২০০১ আইন ও তার সংশোধন করে দিয়েছে। ভূমি কমিশন গঠন করা হলেও বিভিন্ন আইনি জটিলতা, কমিশন চেয়ারম্যানের (একমাত্র বাঙ্গালী) ক্ষমতা, ভূমি জরীপ করার সিদ্ধান্ত, বাঙালী ও উপজাতি জনগোষ্ঠীর সুষম প্রতিনিধিত্ব, জমির প্রকৃতি, জমির মালিকানা নির্ধারণ, ইত্যাদি বহুবিধ কারনে কমিশন অদ্যবদি কোন কাজ করতে পারেনি এবং ভূমি সমস্যারও সমাধান হয়নি। সরকার সারা বাংলাদেশের ভূমি জরিপ করতে পারলেও বিভিন্ন বাঁধার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি জরিপ এখনও করতে পারেনি। চলমান পরিস্থিতিতেই আঞ্চলিক রাজনীতিতে বিশ্বাসী পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর একাংশ আগ্রহী ও ব্যস্ত। আগ্রহের মূল কারণ অর্থ-সম্পত্তি, ক্ষমতার লোভ ইত্যাদি। অর্থ লাভের মূল উৎস চাঁদাবাজি, অস্ত্র ব্যবসা, মুখ বন্ধ রাখার শর্তে অর্থ লাভ, টেন্ডারবাজি, বিদেশে স্কলারশীপ পাইয়ে দেয়া, বিভিন্ন ঘুষ, জমি বা সম্পদ দখল বা উদ্ধারে চাঁদাবাজি ইত্যাদি। আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও রয়েছে দ্বিধা বিভক্তি পাহাড়ী জনগোষ্ঠী। মতানৈক্যের মূল কারণ অর্থ-সম্পত্তি ও তৎসম্পর্কিত ক্ষমতা লাভ। চাঁদাবাজির ব্যাপ্তি পাহাড়ী নিরীহ কলা বিক্রেতা থেকে শুরু করে দোকান, যানবাহন, বাঁশবিক্রেতা, কন্ট্রাক্টর, কৃষক, পেশাজীবি পর্যন্ত বিস্তৃত। একসময় এই চাঁদার টাকা অঞ্চলভিক্তিক প্রতিনিধির মাধ্যমে উত্তোলিত হলেও বর্তমানে চাঁদা আদায়ের নতুন মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে বিকাশ, নগদ ও রকেটের মতো প্রযুক্তি। তার মানে হচ্ছে এখন আর চাঁদা হাতে হাতে প্রদান করা হয়না। তার উপরে রয়েছে আবার জাতিগত বৈষম্য। চাকমা জনগোষ্ঠী অন্য সকল জনগোষ্ঠীর চেয়ে অধিক সুবিধাভোগী। তারপর রয়েছে মারমা, ত্রিপুরা ও অন্যান্যদের অবস্থান। তাদের এমন জাতিগত বৈষম্যের কারণে বম জনগোষ্ঠী ও অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী কুকি, খুমি, তঞ্চঙ্গা, খেয়াং, ম্রোসহ সুবিধাবঞ্চিত হওয়ায় গড়ে তোলে কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (KNF), এছাড়াও রয়েছে মগ লিবারেশন পার্টি (MLP)। পরবর্তীতে আর্মড সংগঠন কুকি চিন ন্যাশনাল আর্মি (KNA) সাম্প্রতিক সময়ে তারা আবার মুসলিম জঙ্গি সংগঠনের সাথে আতাঁত করে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে বলে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।

১৯৯৭ সালে ২রা ডিসেম্বর পার্বত্য চুক্তি সম্পাদিত হয়। এই চুক্তির অধিকাংশ ধারা বাস্তবায়ন করার কথা ছিল সরকারের যার অধিকাংশ ইতিমধ্যে বাস্তবায়িত হয়েছে৷ পক্ষান্তরে চুক্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির ২টি ধারা বাস্তবায়নের কথা বলা হয়। একঃ সকল অস্ত্র জমা দেওয়া। দুইঃ সকল সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ছেড়ে দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা। দুটি শর্তের মধ্যে তারা একটি শর্তও পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়ন করেনি। বিপরীতে পার্বত্য চুক্তির শর্ত অনুযায়ী সেনাবাহিনীর ক্যাম্পের সংখ্যা কমে যাওয়াতে যে শুন্যতার সৃষ্টি হয়েছে, ঐ সব অঞ্চলে এই আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোর সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা সুযোগ নিচ্ছে চাঁদাবাজির। জেএসএস শীর্ষ নেতারা অধিপত্য বিস্তার ও চাঁদা আদায়ের দ্বন্দে লিপ্ত হয়ে ৪টি সশস্ত্র গ্রুপে বিভক্ত হয়েছে। জেএসএস (মূল), জেএসএস (সংস্কার), ইউপিডিএফ (মূল) ও ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক)। চাঁদা আদায়ের দ্বন্দ্বে এই সশস্ত্র গ্রুপগুলো সুযোগ পেলেই অন্যদলের কর্মী সমর্থকের উপর ঝাপিয়ে পড়ছে। তারা তিন পার্বত্য জেলাকে মোটামুটি তারা ভাগ করে নিয়েছে নিজ নিজ নিয়ন্ত্রিত এলাকা রূপে। নিরীহ সাধারন পাহাড়ী বা বাঙালী তাদের স্বাভাবিক জীবন পরিচালনা বা জীবিকা অর্জনে প্রতিনিয়ত এসব সন্ত্রাসীদের বাঁধার সম্মুখীন হচ্ছে। উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রার পথে এক বিশাল বাঁধা হয়ে দাড়িয়েছে আঞ্চলিক দলগুলোর এই অপরাজনীতি ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ড। ২০১১-১২ সালেও থানচির দক্ষিনে অতি দুর্গম লিক্রি, পানঝেরী ইত্যাদি স্থানে পপি চাষ হতো। থানচি থেকে ঐসব এলাকায় পায়ে হেটে এবং নৌকায় পৌছাতে প্রায় দুই দিন সময় লাগত। বছরে কমপক্ষে ২বার আমরা পপি চাষ ধ্বংসের জন্য অপারেশন করেছি। পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্ত পরিবেশকে কতিপয় স্বার্থন্বেষী মহল স্বীয় স্বার্থ চরিতার্থে অশান্ত করে তুলেছে। অথচ এখন আমাদের হাটা উচিৎ উন্নয়নের পথে, হাটা উচিৎ ইউনিটি ইন ডাইভার্সিটির পথে, সম্প্রীতির পথে। তবেই অর্জিত হবে প্রত্যাশিত লক্ষ্য।

প্রত্যাশা
এক দশমাংশে এই পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ। দেশের সার্বভৌমত্ব ও অখন্ডতা কোন পরিস্থিতিতেই আপোষ করা যায় না। বাংলাদেশের কোন অংশকেই বিদেশী সন্ত্রাসীদের আশ্রয়স্থল করতে দেয়া যাবে না। একই সাথে দেশের অভ্যন্তরের কোন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে পাহাড়ী সন্ত্রাসী অথবা পার্শ্ববর্তী দেশের সন্ত্রাসীদের সাথে হাত মিলাতে দেয়া যাবে না। পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত উপজাতিদের নিজস্ব সংস্কৃতি, ধর্মীয়, সামাজিক স্বত্তা রয়েছে। তাঁদের স্বত্তার শুধু স্বীকৃতি নয়, চর্চারও সুযোগ দিতে হবে। যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করতে হবে তাঁদের সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানকে। পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত সকল জনগোষ্ঠী মিলেমিশে থাকতে হবে। প্রত্যেকে বাংলাদেশের নাগরিক এবং সকলের সমান অধিকার থাকবে। পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসকারী যে কোন নাগরিকের যেমন বাংলাদেশের অভ্যন্তরের যে কোন সম্পদের মালিক হবার অধিকার আছে, বাংলাদেশের যে কোন নাগরিকের ও পার্বত্য অঞ্চলে বৈধ ভাবে সম্পত্তি ক্রয়ের অধিকার রয়েছে। কেননা বাঙ্গালীরা মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে এদেশকে স্বাধীন করেছে। পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসকারী পিছিয়ে পড়া প্রতিটি জনগোষ্ঠি, প্রতিটি নাগরিক সম্ভাব্য সকল নাগরিক সুবিধা পাওয়ার অধিকার রাখে। উপজাতিদের মধ্যেও যারা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী তাঁদের সার্বিক উন্নয়নে মনোযোগ দিতে হবে। তা না হলে KNF/MLP এর মত সন্ত্রাসী গোষ্ঠী মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে পারে। KNF আবার পার্শ্ববর্তী দেশের সশস্ত্র গোষ্ঠীর সাথে হাত মিলিয়ে এ অঞ্চল অশান্ত করে তুলতে পারে।

নিরাপত্তা পরিস্থিতি বিবেচনায় আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি আরো বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। আঞ্চলিক ক্ষুদ্র বা স্বীয় স্বার্থের উর্ধে উঠতে হবে সকল আঞ্চলিক রাজনৈতিক নেতা, শিক্ষিত সমাজ, ব্যবসায়ী, পেশাজীবি, ধর্মীয় নেতাসহ সকল সচেতন নাগরিককে। প্রত্যেকের একটাই লক্ষ্য হওয়া দরকার কিভাবে সবাই সবার সাথে হাত মিলিয়ে এ অঞ্চলের অবকাঠামোগত, সামাজিক, পরিবেশগত, প্রশাসনিক, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক উন্নয়ন করা যায়। বয়কট করতে হবে অস্ত্রধারীদের হীন স্বার্থ চরিতার্থকারীদের, চাঁদাবাজদের, সন্ত্রাসীদের, বৈষম্য সৃষ্টিকারীদের, উন্নয়নে বাধা সৃষ্টিকারীদের, দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব হরনে ষড়যন্ত্রকারী অপশক্তিদের, শান্তি বিনষ্টকারীদের। সাধারণ নিরীহ মানুষ অস্ত্রের ঝলকানি দেখতে চায় না। ঘুষ, চাঁদা দিতে চায় না। মুখ ফুটে তাদের মনের কথা বলতে চায়। স্বীয় উৎপাদিত পণ্য নির্বিঘ্নে, নিশ্চিন্তে, ন্যায্য মূল্যে বিক্রি করতে চায়। শান্তিপূর্ণ পরিবেশে পেতে চায় সকল নাগরিক সুবিধা। তবেই হবে আমাদের শান্তির পার্বত্য চট্টগ্রাম তথা সোনার বাংলাদেশ।

লেখক: মেজর জেনারেল মো: নাঈম আশফাক চৌধুরী!
এসবিপি, ওএসপি, এসইউপি, পিএসসি, পিএইচডি (অব:)

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More