ভারতে গিয়েও ‘উস্কানিমূলক’ বক্তব্য দিচ্ছেন, জেএসএস সন্তু গ্রুপের নেতারা।

0

পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির প্রায় ৮০ শতাংশই যখন সরকার বাস্তবায়ন করেছে ঠিক তখনই চুক্তি বাস্তবায়ন করা হয়নি বলে সরকার বিরোধী আন্দোলনের পথে নেমেছে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সংহতি সমিতি (জেএসএস) বা তথাকথিত শান্তিবাহিনী। শুধু বাংলাদেশের অভ্যন্তরেই নয়; দেশের বাইরে ভারতের গিয়েও সরকার বিরোধী উস্কানিমূলক বক্তব্য দিচ্ছেন পার্বত্য অঞ্চলের জেএসএস সন্তু গ্রুপের শীর্ষ নেতারা। এই যাত্রায় রয়েছে রাঙ্গামাটি সাবেক স্বতন্ত্র এমপি উষাতন তালুকদার।

গতকাল শনিবার (২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ) কলকাতায় একাডেমি অফ ফাইন আর্টের সভাগৃহে অল ইন্ডিয়া রিফিউজি ফ্রন্টের উদ্যোগে মুক্ত আলোচনায় পার্বত্য এলাকার জনতার পাশে দাঁড়াতে সরসারি ভারত সরকারের কাছে আবেদন জানালেন জেএসএস এর দু’জন শীর্ষ নেতা, যা নিয়ে শুরু হয়েছে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা।

ওদিকে বাংলাদেশ-বিরোধী প্রচারণা চালানোর অভিযোগ রয়েছে যে পার্বত্য বৌদ্ধ ভিক্ষুর বিরুদ্ধে, সেই করুণালঙ্কার ভান্তেও ছিলেন ওই অনুষ্ঠান। সেখানেও তাকে দিতে দেখা গেছে দেশ-বিরোধী উস্কানিমূলক নানা রকম বক্তব্য দিতে; যা নিয়েও শুরু হয়েছে তর্ক-বিতর্ক।

করুণালঙ্কার ভিক্ষু প্রকাশ মনোগিত জুম্ম জেএসএস এর স্বঘোষিত কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি এবং জুম্মল্যাণ্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দাবিকারী। এই বৌদ্ধ ভিক্ষু প্রায় সময় সেনাবাহিনী ও বাঙালী বিরোধী কুৎসা ও অপপ্রচার রটিয়ে দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করতে তৎপর থাকে। সেনাবাহিনীর মধ্যে বিদ্রোহ লাগাতে উস্কানিমূলক প্রচারণা চালায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। উগ্রবাদী এই ধর্মীয় ভিক্ষু প্রবল মুসলিম বাঙ্গালী এবং সেনাবাহিনী বিরোধী। তার বাড়ি খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালা উপজেলায়। সে বেশ কয়েকবছর ধরে ভারতের নয়াদিল্লিতে থাকে। ভারতের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছে বলেও জানা যায়। এই ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী প্রতিনিয়ত বাংলাদেশ ভেঙে আলাদা রাষ্ট্র গঠনে জনমত তৈরিতে প্রচারণা চালায়। কথিত আছে ভারত থেকে জেএসএস এর প্রধান অস্ত্র সরবরাহকারী এই বৌদ্ধ ভিক্ষু।

সময় টিভির বরাত দিয়ে সাংবাদিক সুব্রত আচার্য জানায়, ভান্তে বাংলাদেশ ছেড়ে গা-ঢাকা দিয়ে এই মুহূর্তে দিল্লি রয়েছেন বলে দাবি করা হয়। একটি ফেসবুক পেজে নিয়মিত তাকে বাংলাদেশ-বিরোধী উস্কানিমূলক বক্তব্য দিতে দেখা যায় বলেও অনেকে অভিযোগ করেছেন।

যদিও করুণালঙ্কার ভান্তে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে উল্টো বলেন,

খারাপ কিছুর প্রতিবাদ করার অধিকার সবার আছে। দেশ বিরোধী প্রচারণা নয়, তিনি পার্বত্য এলাকায় যে খারাপ কাজ হচ্ছে তারই সমালোচনা করেন।

ইতিহাস ও বাস্তবতাকে সামনে রেখে সরকারি সূত্র বলছে, ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর চুক্তির মধ্যদিয়ে বাংলাদেশের পার্বত্য এলাকার দীর্ঘদিনের অশান্তির অবসান হয়। এরপর নানা বাস্তবতার মধ্যদিয়ে চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে বাংলাদেশ সরকার ৬৫টি ধারা পুরোপুরি বাস্তবায়ন করে। এর মধ্যে ৩টি ধারা বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। ৪টি ধারা আংশিক বাস্তবায়ন করেছে সরকার।

পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে শুধু সরকারই নয় পার্বত্য জনসংহতি সমিতি বা জেএসএসও শর্ত মানতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কিন্তু তাদের চুক্তির শর্ত মানার আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন আছে অনেকের।

এমনই যখন বাস্তব চিত্র, তখন পার্বত্য চুক্তির ২৫ বছরে দাঁড়িয়ে জনসংহতি সমিতি দাবি তুলছে, চুক্তি বাস্তবায়ন করেনি সরকার। শুধু দেশের অভ্যন্তরেই নয়। এখন বিদেশের মাটিতেও বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে নেতিবাচক বক্তব্য রাখছেন পাহাড়ের জেএসএস নেতারা।

জনসংহতি সমিতি সরকারের বিরুদ্ধে জোরজুলুমেরও অভিযোগ তুলছে; কলকাতায় দাঁড়িয়ে তাদের দাবি, সেখানে জোর করে ধর্মান্তরিতও করা হচ্ছে।

তাদের চাওয়া, শুধু গাণিতিকভাবে চুক্তি বাস্তবায়ন দেখালে হবে না। চুক্তি বাস্তবায়ন করতে হবে বাস্তব ভিত্তিতে।

ভারতের বিচ্ছিনতাবাদী সংগঠন দমনে বাংলাদেশের কঠোর ভূমিকা বরাবর দিল্লি প্রশংসার চোখেই দেখে আসছে। কিন্তু বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ণ করে এমন কিছু নেতাকে নিয়ে কলকাতায় আলোচনাসভা আয়োজন নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন অনেকেই। বিশেষ করে বাংলাদেশ-বিরোধী প্রচারণা করে দিল্লিতে গা ঢাকা দেয়া পার্বত্য নেতা করুনালঙ্কার ভান্তের উপস্থিতি এদিন অন্য মাত্রা যোগ করে। যদিও বাংলাদেশ-বিরোধী কোনও প্রচারণা চালান না বলে দাবি করেন করুনালঙ্কার নিজে।

এদিকে মুক্ত আলোচনার আয়োজক অল ইন্ডিয়া রিফিউজি ফ্রন্ট-এর নেতা অধ্যাপক ড. মুহিত রায় বলেন, করুনালঙ্কার ভান্তের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ রয়েছে তারা সেটা জানেন না। এমনকি তিনি বাংলাদেশ-বিরোধী প্রচারণায় অংশ নিচ্ছেন বলেও তাদের জানা নেই।

তিনি বিশ্বাস করেন, পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার এবং জনসংহতি সমিতি উভয় পক্ষই ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবে। আর পার্বত্য অঞ্চলের নেতাদের নিয়ে কলকাতায় এ ধরনের বৈঠক করায় দুই দেশের ঐতিহাসিক সম্পর্কে কোন ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না বলেও দাবি করেন তিনি।

ওদিকে জেএসএসের কেন্দ্রীয় সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা যাকে সবাই সন্তু লারমা নামে চেনেন, পার্বত্য অঞ্চলের কথিত বর্ষীয়ান এই নেতা সম্প্রতি চুক্তি বাস্তবায়নের অগ্রগতি নিয়ে প্রশংসা করে বিবৃতি দিয়েছিলেন। কিন্তু তারই দলের অন্য নেতাদের দেশ-বিদেশে সরকারে বিরুদ্ধে দেয়া বক্তব্য সন্তু লারমার বক্তব্যের সাথে সাংঘর্ষিক বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। একই সঙ্গে বাংলাদেশের শাসক দল আওয়ামী লীগ নিধন মিশনেও জনসংহতি সমিতির সদস্যরা সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছে বলে মনে করেন অনেকেই।

এ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে সাবেক এমপি ও জনসংহতি সমিতির নেতা ঊষাতন তালুকদার বলেন,

প্রশংসা করা মানেই চুক্তি বাস্তবায়ন হয়েছে সেরকমটি নয়। আমরা মনে করি, চুক্তির যে ধারাগুলো আছে তার মধ্যে ২৫টি বাস্তবায়ন হয়েছে। চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো এখনও বাস্তবায়ন হয়নি। তাছাড়া এ ধরনের আলোচনা সভা কিংবা প্রতিবাদ সভা একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ারই অংশ। আমরা পার্বত্যববাসী সংখ্যাগুরু হওয়া সত্বেও সেখানে আমাদের অধিকার ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতের সাহায্য প্রার্থনা করেছি।

আরেক প্রশ্নের উত্তরে জনসংহতি সমিতির শীর্ষ নেতা গৌতম দেওয়ানও জানান, চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যেভাবে গাণিতিক সংখ্যাকে সামনে আনা হয়েছে সেটা না করে বরং চুক্তির বাস্তব ভিত্তি কতটা স্থাপিত হয়েছে, পাহাড়ে সংখ্যালঘু হিন্দু বৌদ্ধ এবং খ্রিস্টানরা কতটা নিরাপদে রয়েছেন সেটা নিশ্চিত করতে হবে সরকারকে। ভারত প্রতিবেশী দেশ, তাই এসব বিষয়ে তাদেরও সহযোগিতা প্রত্যাশা করা দোষের কিছু নয় বলেও মনে করেন তিনি।

আওয়ামী লীগ নেতাদের হত্যা করা হচ্ছে এমন অভিযোগের প্রেক্ষিতে তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলাবাহিনী সেটা তদন্ত করে দেখুন। দেশে তো পুলিশ প্রশাসন আছে।

কলকাতায় এদিনের সভায় উপস্থিত থেকে পার্বত্য জনসংহতি সমিতির আন্দোলনের সমর্থন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মেজবাহ কামাল। ত্রিপুরার সাবেক রাজ্যপাল ও বিজেপি নেতা তথাগত রায়সহ অনেকে এই আলোচনায় অংশ নেন।

জেএসএস ১৯৯৭ সনের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির শর্ত মোতাবেক সরকার থেকে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করে এখনো পূর্বের ন্যায় অবৈধ অস্ত্র নিয়ে বিদ্যমান থেকে পার্বত্যাঞ্চল অস্থিরতা তৈরি করছে। তার পাশাপাশি সশস্ত্র জনবল বৃদ্ধি করে চাঁদাবাজি, অপহরণ, খুন-গুম এবং রাষ্ট্র বিরোধী তৎপরতা চালাচ্ছে। এর ফলে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন যেমন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে তেমনি পাহাড়ের মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে রক্তারক্তি সংঘর্ষ এবং বাঙ্গালী ভূমি বেদখলের পেছনে জেএসএস দায়ী। পার্বত্য চট্টগ্রামে জেএসএস যদি অবৈধ অস্ত্র নিয়ে শান্তি সম্প্রীতি এবং উন্নয়নে বাধা প্রদান করে পার্বত্যবাসী তথা দেশবাসী তা প্রতিহত করবে।

 

 

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More