সশস্ত্র গ্রুপ থেকে আত্মসমর্পণ করা শেখর চাকমার স্বাভাবিক জীবনে আলোর দেখা!

0

আজ আমি আপনাদের সাথে এমন একজন ব্যক্তির সশস্ত্র নরক জীবন এবং পরবর্তীতে স্বাভাবিক উজ্জ্বল জীবনের কথা শেয়ার করবো। তিনি তার সশস্ত্র জীবনের অপ্রকাশিত কথা শেয়ার করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন।

শেখর চাকমা (ছদ্মনাম) খাগড়াছড়ি জেলার পানছড়ি উপজেলার শান্তিপুরের বাসিন্দা। প্রথম পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি বা জেএসএসের সশস্ত্র শাখায় থাকার পর সংগঠনটি ছেড়ে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ প্রসিত) গ্রুপের সশস্ত্র শাখায় যোগদান করেন। কালেক্টর থেকে সেকশন কমান্ডার পর্যন্ত প্রায় ৩০ বছর ধরে জেএসএস ও ইউপিডিএফ-এর সাথে কাজ করে দলের তথাকথিত আদর্শ ও নির্দেশনা মেনে চলার সময় অনেক নিরীহ মানুষকে খুন-গুম করেন। পাহাড়ী হিসেবে শেখর চাকমা তার জাতিসত্তার অধিকার নিয়ে সবসময়ই সোচ্চার এবং প্রতিবাদী মানসে ছিলেন। চুক্তির পূর্ববর্তী সময়ে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের দাবিতে সশস্ত্র জীবন বেছে নেন। তারুণ্যের অনেক আশা ও স্বপ্ন নিয়ে জেএসএসে যোগদান করে দীর্ঘদিন ধরে সংগঠনের কল্যাণ ও জাতির অধিকার আদায়ে অবদান রাখার ব্যর্থ চেষ্টা করে আসছিলেন তিনি। সংগঠনের জন্য কাজ করে মাসে কখনো পরিবারের জন্য ৩/৪ হাজার টাকার বেশি পাননি কিন্তু চাঁদাবাজি হয়েছে লাখ টাকার বেশি। এভাবে চলতে থাকায় একবার তিনি অনুভব করলেন যে, জেএসএস তার সাথে প্রতারণা করছে। তাকে ন্যায্যতা দিচ্ছে না বরাবরই ঠকাচ্ছে। তাই চুক্তির পরপরই প্রসিত বিকাশের নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফ-এ যোগদান করেন। ইউপিডিএফ তাকে স্বায়ত্তশাসন ও লাভজনক জীবনের স্বপ্ন দেখান। কিন্তু এত বছর পরও স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন আলোর মুখ দেখেনি। সংঘাতে হানাহানি, হত্যা ও রক্তপাত ছাড়া মুক্তির আলো নেই। জনগণকে ভয় দেখিয়ে জেএসএসে থাকাকালীন সময়ে যেভাবেই চাঁদাবাজি করতে হয়েছিল একইভাবে ইউপিডিএফ-এ যোগদান করেও চাঁদাবাজি করতে হচ্ছে। নিরিহ মানুষ থেকে চাঁদা আদায় করা হয় কিন্তু মানুষের কল্যাণে কিছু করা হচ্ছে না বিষয়টি তার নজরে এসেছে।

সারা পার্বত্য চট্টগ্রামের রক্তের দাগ এখনো শুকায়নি লক্ষ্যহীন সংগ্রামে শতশত সশস্ত্র কর্মী বা সাধারণ মানুষ নিরন্তর জীবন দিয়ে। তার থেকে অনেক জুনিয়র সংগঠনে যোগ দিয়ে কোটি টাকার মালিক বনে গেছে কিন্তু শেখরের জীবনে কোনো পরিবর্তন আসেনি। কারণ সবাই চাঁদার একটা অংশ নিজে রেখে দেন আর বাকী অংশ পার্টি বা সংগঠনের কাছে জমা প্রদান করেন! আবার অনেকে ক্ষমতা দেখিয়ে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে জাতির অধিকার দাবিতে কিন্তু এখানে অধিকারের চেয়ে চাঁদাবাজি ও সাধারণ মানুষের ক্ষতিসাধন বেশি করা হচ্ছে। বলাবাহুল্য যে, এখানে অর্জন জিরো টলারেন্স আর আদর্শবাদ বর্জিত। জাতির অধিকারের কথা বললেও বাস্তবে তা হচ্ছে চাঁদাবাজি আর ক্ষমতার রাজত্ব। বিষয়টি দীর্ঘ সশস্ত্র জীবনে টের না পেলেও পাকাপোক্ত বয়সে এসে জাজমেন্ট করতে পেরেছে শেখর।

দুর্গম পাহাড়ে সশস্ত্র জীবন কতটা কঠিন তার বাস্তবতা হয়তো অনেকেই উপলব্ধি করতে পারবে না। ঝড় বৃষ্টি, মশা, পোকামাকড়সহ নানা প্রতিকূল পরিবেশে পাহাড়ে গহীন অরণ্যে সশস্ত্র জীবন। এইভাবে শেখর দিনের পর দিন পাহাড়ের জঙ্গলে, ভয়ে নিদ্রাহীন কাটিয়েছেন। প্রশাসনের হাতে ধরা পড়ার বা প্রতিপক্ষের হাতে খুন হওয়ার ভয় সব সময়ই ছিল। স্ত্রী-সন্তানের মুখও দেখা হত না। পরিবারের সদস্যের ঠিকভাবে ভরণ-পোষণ দিতে পারেননি। দলের দেওয়া সামান্য টাকা দিয়ে সংসার চালানো কষ্টসাধ্য ছিল। তবুও জাতির জন্য কাজ করছি এই ভেবে ভেবেই জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সময় কেটে গেল তার।

শেখর চাকমা বলেন, “এক সময় মনে হতো আর কতদিন এভাবে চলবে? জাতির অধিকার বা স্বায়ত্তশাসন কবে অর্জিত হবে? জনগণকে ভয়ভীতি দেখিয়ে সংগ্রহ করা এই বিপুল পরিমাণ অর্থ কোথায় যায়? প্রসিত বিকাশকে কখনো সরাসরি দেখার সুযোগ হয়নি। আমরা যারা প্রসিতের নির্দেশে সশস্ত্র জীবন বেছে নিয়েছি তারা জানিনা প্রসিত কোথায় আছে! দলের সিনিয়র নেতাদের নিয়ে কথা বলা নিষেধ। দলের সিনিয়র নেতাদের বিলাসবহুল জীবন ও অনিয়মের কথা বললে, নজরদারি করা হয় তারপর মেরে ফেলা হয়। দলের বিরুদ্ধে কথা বললে এমন শাস্তি অবধারিত। হতাশা আর ক্ষোভের মধ্যেও জঙ্গল থেকে জাতির অধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য নিবেদিত হয়ে কাজ করেছি। কিন্তু তা ছিল উদ্দেশ্যহীন। একবার শুনেছিলাম সশস্ত্র সদস্যরা সরকারী বাহিনীর হাতে ধরা পড়লে দল আর তাদের গ্রহণ করেনা এবং তাদের বিশ্বাস করেনা। এই কথা শোনার পর বিস্মিত হয়েছিলাম! শুধু এটা ভাবতেছি আমি কার জন্য আমার মূল্যবান তরুণ জীবন শেষ করছি? তারা স্বায়ত্তশাসনের মিথ্যা স্বপ্ন দেখিয়ে আমাদের মত সল্পশিক্ষিত বা অশিক্ষিত মানুষকে ব্যবহার করছে না তো? আমি নিজেকে এই প্রশ্নগুলো প্রতিনিয়ত করতাম। কারণ বাহিরে এ প্রশ্নগুলো করার সুযোগ কারোরই নেই। যখন আমার বোধগম্য হয়েছিলো, আমি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে দু’টি বিকল্প খুঁজে পেয়েছি (১) আমি আত্মসমর্পণ করব, (২) আমি আত্মহত্যা করব! এই দুই পথ ধরে সামনের দিকে এগোতে লাগলাম। কিন্তু আমি কীভাবে নিজেকে শেষ করব? আমার তো স্ত্রী ও দুই মেয়ে আছে! তাদের কী হবে? তারা তো কোনো ভুল করেনি। বরং আমি তাদের কষ্ট দিয়েছি এবং তাদেরকে অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছি। জীবনের মূল্যবান সময় তাদের দিতে পারিনি। আমার অন্ধকার জীবন থেকে আমি কখনই দু’টি মেয়েকে আলিঙ্গন করতে পারিনি। রাতে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে একসঙ্গে নিরাপদে খেতে পারিনি। সশস্ত্র জীবনে সবসময় রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও প্রতিপক্ষ দলের ভয় ছিল। এভাবেই চলছিল জীবন। তাই আমি সরকারী বাহিনীর সাথে যোগাযোগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি এবং যাই ঘটুক না কেন আত্মসমর্পণ করবো। অনেকে হয়তো বলবেন আমি অবিশ্বস্ত, কিন্তু তাদের কাছে আমার প্রশ্ন এত বছর স্বায়ত্তশাসন দাবি করে ইউপিডিএফ কী অর্জন করেছে? গোত্রের লাশ পাওয়া ছাড়া আর কী? সঠিক গন্তব্যে পৌঁছানোর লক্ষ্য অর্জনের জন্য ইউপিডিএফকে জীবনের মহামূল্যবান সময় ব্যয় করেছি। সংগঠনের সশস্ত্র গ্রুপে এখন আর জীবন কাটাতে ইচ্ছে করেনা। তাই আমি নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে যোগাযোগ করে আত্মসমর্পণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। প্রথমে কিছুটা ভয় কাজ করেছিল। কিন্তু নিরাপত্তা বাহিনীর আন্তরিকতা ও উদারনীতি আমার মন থেকে সমস্ত কালো মেঘ ও শঙ্কা দূর করে আমাকে নতুন এক উজ্জ্বল জীবন দিয়েছে। আমি যে অপরাধ করেছি তা সরকার ক্ষমা করে দেন। সাধারণ ক্ষমার আওতায় সরকারি সুবিধা পেয়েছি। আজ আমার মেয়েরা বাবার আদর পাচ্ছে আর স্ত্রী তার অধিকার পাচ্ছে। আমি আমার অনেক মূল্যবান সময় নষ্ট করেছি আমার ভুলের কারণে আমি অন্ধকার জীবনে অনেক কষ্ট পেয়েছি। এখন আমি অন্ধকার সশস্ত্র জীবন থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছি এবং আলোর জগৎ ফিরে পেয়েছি। আমি খোলা আকাশের নিচে স্বাধীন মানুষ। আমি আমার সমস্ত আত্মীয়দের সাথে সুশীতল ছায়ায় বসবাস করছি। এখন সরকারি বাহিনীর ভয় নেই। আঞ্চলিক গোষ্ঠীর হাতে খুন হওয়ার ভয় নেই। আমার মতো অনেক বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র লোক স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে মরিয়া। একটু রাষ্ট্রীয় সুযোগ পেলে তারাও আলোর পথে ফিরতে ইচ্ছুক। সশস্ত্র বা রাজনৈতিক দলগুলি আর মিথ্যা স্বায়ত্তশাসন এবং আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের উপর টিকে থাকতে পারবে না। মানুষ ফিরে আসতে চায় তার আপনরূপে। সশস্ত্র গ্রুপগুলোর নজরদারি আর কড়াকড়ি আরোপ না থাকলে হয়তো সারিবদ্ধভাবে আআত্মসমর্পণের পথ বেছে নিত আঞ্চলিক দলের সশস্ত্র সদস্যরা। পাহাড় জঙ্গলের অন্ধকার জীবন পরিত্যাগ করে আলোর পথ বেছে নিতে শতশত সশস্ত্র সদস্য অপেক্ষার পহর গুনছেন।”

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More