বিলুপ্তপ্রায় রেংমিটচ্য ভাষা রক্ষায় স্কুল নির্মাণ; সেনাদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ উপজাতিরা।

0

গবেষণায় দেখা গেছে যে, মাতৃভাষায় সাবলীলভাবে জ্ঞানীয় বিকাশ এবং বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ তুলনামূলকভাবে দ্রুত হয়। তাদের মাতৃভাষার সাফল্য তাদের মাতৃভাষা ব্যতীত অন্য ভাষায় শেখানো কারও চেয়ে বেশি। ভাষা প্রতিটি জাতির সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার প্রাথমিক মাধ্যম। প্রায়শই, একটি ভাষার অন্য ভাষায় সরাসরি অনুবাদ উৎস ভাষার মতো একই সারমর্ম প্রকাশ করতে পারে না। অতএব, একটি সংস্কৃতিকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জানার সর্বোত্তম উপায় হল ভাষা বোঝা। মাতৃভাষা প্রতিটি জাতির ঐতিহ্যগত, সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ এবং শিকড়ের সাথে সংযুক্ত থাকতে সাহায্য করে। একটি জাতির যদি ভাষা হারিয়ে যায় সে জাতি তার ঐতিহ্যগত, সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ বলতে আর কিছু থাকবে না। মাতৃভাষা এমনই গুরুত্বপূর্ণ৷ আমরা বাঙ্গালীরা মাতৃভাষা রক্ষায় ৫২’ তে ভাষা আন্দোলন করেছি। শহীদদের রক্তের বিনিময়ে আমরা মাতৃভাষার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায়। তাই আমরা বাঙ্গালীরা অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষা নিয়ে যথেষ্ট সচেতন৷ আমাদের দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠায় শত বাধা-বিপত্তি ও প্রতিকূল পরিস্থিতিতে মানুষের নিরাপত্তার পাশাপাশি মানবসেবা দিয়ে যাচ্ছে। সেনাবাহিনী কর্তৃক ম্রো সম্প্রদায়ের মাতৃভাষা রক্ষায় স্কুল নির্মাণ করে দেওয়াও পাহাড়ে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং একটি জাতির ঐতিহ্যগত, সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ অক্ষুণ্ন রাখার কাজ।

প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যে ভরা বান্দরবান আলীকদম উপজেলা। তাছাড়া স্থানীয়রা মনে করেন যে, ৩৬০ আউলিয়া এ উপমহাদেশে ইসলাম প্রচারের জন্য এসেছিলেন। তাদের মধ্যে আলী নামে কোন এক সাধক এ অঞ্চলে আসেন। ওনার পদধুলিতে ধন্য হয়ে এ এলাকার নাম করণ হয় আলীকদম। এই উপজেলায় বিভিন্ন বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীর বসবাস করেন৷ এর মধ্যে ম্রো একটি জাতি যাদের ভাষা বিলুপ্তপ্রায়। উপজেলায় সদর ইউনিয়নের তৈন মৌজার তৈন খালের ওপরে দূর্গম এলাকা ক্রাংসি পাড়া গ্রামে ম্রো জনগোষ্ঠীর ২৮ পরিবার মানুষের বসবাস। নিজস্ব ভাষা থাকলেও তাদের মাত্র ছয় জনই বলতে পারেন ‘রেংমিটচ্য ভাষা’। তারা সবাই ষাটোর্ধ্ব। এই ভাষা হারিয়ে যাওয়া নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে শঙ্কা তৈরি হলে রেংমিটচ্য ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আলীকদম সেনা জোন উদ্যোগে ‘ক্রাংসিপাড়া সেনা মৈত্রী প্রাথমিক বিদ্যালয়’ নামে একটি স্কুল নির্মাণ করে দেওয়া হয়। সেনাবাহিনী নিজ উদ্যােগে ভাষা রক্ষায় স্কুলটি করে দেয়। অথচ উপজাতিদের মাথা বিক্রি করা সংগঠনগুলো ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য রক্ষায় এগিয়ে আসেনি। এদেশের সুশীল, বাম ও প্রগতিশীলরা সবসময় পাহাড়ের উপজাতিদের ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য হারিয়ে যাওয়ার শঙ্কা প্রকাশ, কিন্তু তাদেরকে এই ভাষা রক্ষায় এগিয়ে আসতে দেখা যায়নি! যে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে তারা সবসময় মিথ্যা ও বানোয়াট অপপ্রচার করেছে সে সেনাবাহিনীই দিনশেষে ভাষা রক্ষায় এগিয়ে এসেছে।
সাম্প্রতিক সময়ে জাতীয় সংগীত পরিবেশনের পর প্রধান অতিথি সদ্য বিদায়ী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল গোলাম মহিউদ্দিন আহমেদ এই স্কুল উদ্বোধন করেন। সেই সঙ্গে এ স্কুলে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা সামগ্রী, ক্রিড়া সামগ্রী, ও ক্রাংসি পাড়াবাসীদের চিকিৎসা সহায়তা দেওয়া হয়েছে।
স্কুল উদ্বোধনের পর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল গোলাম মহিউদ্দিন আহমেদ তাঁর বক্তব্যে বলেন, বিলুপ্ত প্রায় রেংমিটচ্য ভাষার সম্পর্কে গণমাধ্যম থেকে জানতে পেরেছি। এই ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখতে শুধুমাত্র সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছি। যেখানেই আমাদের কাজ করার সুযোগ রয়েছে সেখানেই কাজ করছি। শিক্ষা প্রসার, চিকিৎসা সহায়তা ও স্থানীয় বাসিন্দাদের জীবন মান উন্নয়ন করতে বান্দরবান সেনা জোন নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।

রেংমিটচ্য ভাষা রক্ষায় সেনাবাহিনীর ভূমিকার প্রশংসায় পঞ্চমুখ উপজাতিরা। স্থানীয় উপজাতিরা সেনাবাহিনীর এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছে। তারা বলেন, “সেনাবাহিনী এক মানবতাবাদী বাহিনী, যারা পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠায় কাজ করছেন নিরলসভাবে৷ সেসাথে স্থানীয় উপজাতিদের আপদ-বিপদে এগিয়ে আসেন। আমাদের ভাষা বিলুপ্তপ্রায়। এমন সময় সেনাবাহিনী উদ্যোগ নিয়ে স্কুল করে দিয়েছে৷ যার মাধ্যমে ভাষা ও জ্ঞানের চর্চা হবে।” তারা আরো বলেন, বিলুপ্তপ্রায় ভাষা আমাদের মাঝে টিকে থাকবে।” গবেষণায় দেখা গেছে একটি জাতি ভাষা ছাড়া অর্থহীন। যে জাতির মাত্র ষাটোর্ধ ৬ জন ভাষা জানে বাকীরা ভাষা হারিয়ে ফেলেছে সে জাতির ভবিষ্যতে মাতৃভাষা টিকে থাকা নিয়ে শঙ্কা তৈরি হওয়াটা স্বাভাবিক৷ এমন মূহুর্তে সেনাবাহিনী এগিয়ে এসেছে ভাষা রক্ষায়। যা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার।

নবনির্মিত ক্রাংসিপাড়া সেনা মৈত্রী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক চিংরাও ম্রো বলেন, অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে দারিদ্র্যের কশাঘাতে পিষ্ট এই মানুষগুলো শিক্ষার ক্ষেত্রেও অনেক পিছিয়ে। আমাদের রেংমিটচ্য ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখতে এতদিন নিজের বাড়িতে ছেলেমেয়েদের পড়িয়েছি। পাড়াবাসী ও রেংমিটচ্য ভাষাভাষীর পরিবারের স্কুল নির্মাণে ইচ্ছা থাকলেও আর্থিক অস্বচ্ছলতা কারণে নির্মাণ করতে পারিনি। সেনাবাহিনীর উদ্যোগে স্কুল নির্মাণ হয়েছে। এই স্কুলের মাধ্যমে রেংমিটচ্য ভাষা নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের শিক্ষাতে পারবো।

বলতে পারি ভাষার গুরুত্ব মানবজীবনে অপরিসীম অপরিহার্য। সভ্যতার সবটুকুই মূলত ভাষার অবদান। তাই বলতে পারি ভাষা রক্ষায় সেনাবাহিনীর এই উদ্যোগ অনস্বীকার্য।

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More